23 Apr 2024, 05:25 pm

তুরস্কের বাধ নির্মাণে মুসলিম দেশগুলোর নদী শুকিয়ে যাচ্ছে ; পরিবেশ বিপর্যয়ে গোটা অঞ্চল

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

অনলাইন সমিান্তবাণী ডেস্ক :  হাজার হাজার বছর ধরে পশ্চিম এশিয়ার উত্তরাঞ্চলের পাহাড় থেকে নেমে আসা খরস্রোতা নদীর পানি দক্ষিণের অঞ্চলগুলোকে সমৃদ্ধ করেছে। নদীকেন্দ্রিক মানব বসতি গড়ে উঠেছে এবং বহু সভ্যতার জন্ম হয়েছে। এ অঞ্চলের নদী ও পানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে তুরস্ক এবং এসব নদী দক্ষিণের অন্যান্য অঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে গেছে। কৃষি, শিল্প সব কিছুই এ পানির ওপর নির্ভরশীল।

বলা যায়, এ অঞ্চলের জাতি ও সভ্যতাগুলোর অস্তিত্বের সঙ্গে নদীর পনির সম্পর্ক রয়েছে। তবে এই পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে তুরস্কের সাম্প্রতিক ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপ নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা জোরদার হচ্ছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা এ বিষয়ে কথা বলবো। আশা করি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাব।

পৃথিবীর কিছু দেশ পানি সংকটকে অপব্যবহার করে পাহাড় থেকে প্রবাহিত পানিকে অভ্যন্তরীণ ভূমিতে ব্যবহার করে তবে একই সাথে তারা অন্য দেশকে এ মিষ্টি পানির ব্যবহার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করে যা খুবই অমানবিক। কেননা এতে করে ভাটি অঞ্চলের দেশগুলোর শহর ও গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা ব্যহত হয়।

পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তুরস্ক অসংখ্য পাহাড় ও নদীতে ভরপুর। দজলা, ফোরাত, আরাস ও আরভান্দের মতো গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর উৎসভূমি হচ্ছে তুরস্ক। এই নদীগুলো তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় মুসলিম দেশগুলোর বিশাল জনপদের শিল্প, কৃষি ও বেঁচে থাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গত বেশ ক’বছর হলো পশ্চিম এশিয়াসহ বিশ্বব্যাপী পানি সংকট দেখা দিয়েছে। তুরস্ক সরকার নদীগুলোর ওপর একতরফাভাবে বাধ নির্মাণ করে নদীর গতিপথ বদলে দিয়েছে। তুরস্কের কর্মকর্তারা চাইছেন দজলা, ফোরাত, আরাস ও আরভান্দ নদীর পানি দেশের অভ্যন্তরেই ব্যবহার করতে। একদিকে, দজলা নদীতে তুরস্কের বাধ নির্মাণ প্রকল্প অন্যদিকে বৃষ্টির স্বল্পতার কারণে গত কয়েক বছরে ইরাকে মারাত্মক পানি সংকট দেখা দিয়েছে।

তুরস্ক সরকার দজলা ও ফোরাত নদীর উজানের এলাকায় পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়ার জন্য দক্ষিণ-পূর্ব আনাতোলিয়া এলাকার নদীগুলোর ওপর এ পর্যন্ত ২২টি বাধ ও  (gap) ‘গ্যাপ প্রকল্প’  নামে পরিচিত ১৯টি জল প্রকল্প নির্মাণ করেছে। এর ফলে ইরাক ও সিরিয়ার নদীর পানি অনেক শুকিয়ে গেছে এবং এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়েছে ওই অঞ্চলের জনগণ ও ভূ-প্রকৃতির ওপর।

ইরাকের কর্মকর্তারা বহুবার বলেছেন, দজলা ও ফোরাতের মতো আন্তর্জাতিক নদীর পানি ন্যায়ভিত্তিক বণ্টনের বিষয়ে যদি তুরস্কের সঙ্গে কোনো সমঝোতা না হয় তাহলে ইরাকে মারাত্মক পানি সংকট দেখা দেবে এবং এর ফলে ইরাকের কৃষি ও খাবার পানির পরিমাণ ৫৪ শতাংশ হ্রাস পাবে যা কিনা তাদের জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।  উল্লেখ্য, দজলা ও ফোরাত নদীর পানি তুরস্ক থেকে শুরু করে ইরাক ও সিরিয়ার ওপর দিয়ে দুই হাজার ৮০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে তা পারস্য উপসাগরে গিয়ে মিশেছে।

মৃতপ্রায় দজলা নদীর করুণ  চিত্র

ইরাক ও সিরিয়ার কর্মকর্তারা সম্প্রতি এক বৈঠকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিতে সম্মত হয়েছে।

এর আগে তুরস্কের কর্মকর্তারা ওই দুই দেশের কর্মকর্তাদের প্রতিবাদ উপেক্ষা করায় গত বছর অক্টোবরে দামেস্কে ইরাক ও সিরিয়ার বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং নদীর পানি আটকে দেয়ার তুরস্কের পদক্ষেপের পরিণতির বিষয়ে তারা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এ বৈঠকে ইরাকের পানি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এক বিবৃতিতে পানির অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাতে ইরাক ও সিরিয়ার গুরুত্বারোপের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এই দুই দেশের সহযোগিতা পানি আদায় ও এ অঞ্চলের জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারবে।

দামেস্ক ও বাগদাদ দজলা ও ফোরাত নদীর পানির প্রবাহ কমিয়ে দেয়ার তুর্কি পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করে বলেছে, এতে করে এ অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি ও জীব-বৈচিত্র্যে বিরূপ প্রভাব পড়বে। দুই দেশই অভিযোগ করেছে নদীর ওপর তুরস্কের বাধ নির্মাণের ফলে নদীর উজানের বিশাল এলাকাজুড়ে মরুকরণ শুরু হয়েছে এবং আবহাওয়ায় পরিবর্তন এনেছে।

এদিকে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানও তুরস্কের গুরুত্বপূর্ণ আরাস নদীর ওপর বাধ নির্মাণ পরিকল্পনার তীব্র সমালোচনা একে বেআইনি ও অগ্রহণযোগ্য বলে অভিহিত করেছে। ইরান ও আর্মেনিয়ার মধ্যকার অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিষয়ক যৌথ কমিশনের ১৭তম বৈঠক শেষে ইরানের জ্বালানি বিষয়ক মন্ত্রী আলী আকবর মেহরানিয়ান সাংবাদিকদের বলেছেন, এই নদীর সাথে কয়েকটি দেশ সংযুক্ত থাকলেও এ দেশগুলোর সাথে কোনো সমন্বয় না করেই তুরস্ক সরকার বাধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বাধ নির্মাণ ও পানি বণ্টনের বিষয়ে এ দেশগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের আহ্বান জানান। কেননা তুরস্ক যেভাবে বাধ নির্মাণ শুরু করেছে তাতে আরাস নদীতে বিপর্যয় সৃষ্টি হতে  পারে।

ইরানের কর্মকর্তারা বহুবার তুরস্কের কাছে এ ব্যাপারে তাদের উদ্বেগের কথা  জানিয়েছেন। এ বিষয়ে আলোচনার জন্য দুদেশের কর্মকর্তারা একাধিক বৈঠকেও মিলিত হয়েছেন। তুরস্কের কর্মকর্তারা বারবারই ইরানকে এ নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে ইরানসহ এ অঞ্চলের অন্য দেশের উদ্বেগ দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।

ইরান সবসময়ই বলে আসছে আরাস নদীর সাথে যুক্ত দেশগুলোকে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে ন্যায়সঙ্গতভাবে পানির ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইরান, ইরাক ও সিরিয়া এমন সময় অভিন্ন নদীগুলোর ওপর তুরস্ক সরকারের বাধ নির্মাণ প্রকল্পের প্রতিবাদ জানিয়েছে যখন আরাস নদীর সাথে যুক্ত আজারবাইজান সরকার এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব রয়েছে। কারণ তুরস্কের সাথে আজারবাইজানের আঞ্চলিক রাজনৈতিক সম্পর্ক ভালো। এ অবস্থায় আজারবাইজান কোনো প্রতিবাদে যেতে চায় না যাতে ভবিষ্যতে দেশটির জনগণের জন্য কোনো সমস্যা তৈরি না হয়। বিশেষজ্ঞরা তুরস্কের ব্যাপারে আজারবাইজান সরকারের এ নীতি অবস্থানকে আরাস নদীর সাথে যুক্ত আজারবাইজানসহ এ অঞ্চলের অন্য দেশের সরকার ও জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করেন। অথচ আরাস নদীতে বেআইনিভাবে তুরস্কের বাধ নির্মাণের ফলে আগামীতে যে দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার মধ্যে অন্যত হচ্ছে আজারবাইজান।

গত বেশ ক’বছর ধরে তুরস্কের বাধ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে এ অঞ্চলের দেশগুলোতো ক্ষতিগ্রস্ত হবেই এমনকি তুরস্কের জনগণও এ ক্ষতির বাইরে নয়। বাধ নির্মাণের ফলে তুরস্কের অভ্যন্তরেও বিরাট অংশে পানি সংকট ও শুষ্ক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। অনেকেই হয়তো এতে অবাক হবে কেননা তুরস্কের বাধের কারণেই গত কয়েক বছরে ইরাক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ পানি সংকট ও মরুকরণ শুরু হয়েছে। এতে সমগ্র ওই অঞ্চলে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

অন্যদিকে ইরানও তুরস্কের বাধ নির্মাণ প্রকল্পের প্রতিবাদ জানিয়েছে। ইরানের সংসদে মাহাবাদ এলাকার প্রতিনিধি জালাল মাহমুদ যাদেহ বলেছেন, তুরস্কের এ পদক্ষেপ মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা এতে করে ইরানের অংশেও মারাত্মক পানি সংকট দেখা দেবে। ইরাকের কর্মকর্তারাও বলেছেন, তুরস্কের বাধ নির্মাণের ফলে দজলা ও ফোরাত নদীর পানি এরই মধ্যে শুকিয়ে গেছে এবং কৃষিকাজ ব্যহত হচ্ছে। এ ছাড়া পানির অভাবে ধুলাবালি উড়ে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরে তুরস্ক সরকার ইরাক ও সিরিয়ার বিরুদ্ধে অসম ও সর্বাত্মক যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে তুরস্ক বাধ নির্মাণ করে পানি অস্ত্র ব্যবহার করছে যাতে ওই দেশগুলোর কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে নেয়া যায়। রজব তাইয়্যেব এরদোগান নিজেকে মুসলিম দরদি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করলেও বাস্তবে পানি বন্ধ করে দিয়ে বিশাল এই মুসলিম ভূখণ্ডকে শুকিয়ে মারার চেষ্টা করছে যা কিনা খুবই অমানবিক ও বর্বরতা।#

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 6398
  • Total Visits: 597282
  • Total Visitors: 2
  • Total Countries: 944

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
  • ১০ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল)
  • ১৩ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরী
  • এখন সময়, বিকাল ৫:২৫

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
22232425262728
2930     
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018