ঈদুল ফিতর বিশ্ব মুসলিমের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আনন্দোৎসব। ইসলামী সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। রমযানের শেষদিন সন্ধ্যায় পশ্চিমাকাশে শাওয়াল মাসের বাঁকা চাঁদ উদিত হওয়ার মধ্যদিয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে ঈদুল ফিতরের আহ্বান: ‘ও মন রমযানের ঐ রোযার শেষে এল খুশির ঈদ’। পবিত্র আনন্দধারায় উদ্ভাসিত হয় সকল সিয়াম সাধকের চিত্ত।
ঈদুল ফিতরের উৎসব একদিকে যেমনি আমাদের নির্মল-নিষ্কলুষ আনন্দে উজ্জীবিত করে অন্যদিকে মানবতা ও ভ্রাতৃত্বের চেতনায় করে অনুপ্রাণিত। ঈদ অর্থ খুশি। তবে এ খুশি একা ভোগ করার জন্য নয়, সকলকে নিয়ে ঈদের আনন্দ উপভোগ করার মধ্যেই নিহিত এর সার্থকতা। ধনী-নির্ধন সকলে যাতে এ উৎসব প্রাণভরে উপভোগ করতে পারে, সেজন্য বিত্তশালীদের উচিত গরিব-দুস্থদের দিকে সাহায্য ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। পবিত্র রমযানে ইবাদত বন্দেগির কারণে যেভাবে পাপ থেকে মুক্তির ঘোষণা দেয়া হয়েছে তার ফলে প্রত্যেক রোযাদার যে পরিশুদ্ধতা অর্জন করে সে কারণে ঈদ তাদের জন্য এক স্বর্গীয় আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার মাধ্যমে একজন মুসলমান যে কঠোর সংযমের প্রশিক্ষণ লাভ করে তারই মূল্যায়নের দিন ঈদুল ফিতর।
রোযাদার একমাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নফসকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে, পাপ-পঙ্কিলতা থেকে নিজেকে রক্ষা করে অন্তরকে খাঁটি কলুষমুক্ত করে। তার মন-মানসিকতায় ধ্বনিত হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তার নৈকট্য লাভের তীব্র আকাংখা। এমন সুফলদায়ক প্রশিক্ষণ যাতে বাকি এগার মাস কার্যকর থাকে, চিন্তা-চেতনায় শানিত থাকে তার শপথ নেয়ার দিন ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতর মূলত দুটো শব্দ ‘ঈদ’ ও ‘ফিতর’-এর সমন্বয়ে গঠিত। ঈদ একটি আরবি পরিভাষা। এর আভিধানিক অর্থ খুশি, আনন্দ, উৎসব, ঋতু ইত্যাদি। ঈদ শব্দটি ‘আউদুন’ শব্দমূল থেকে উদ্ভূত হলে এর অর্থ হবে প্রত্যাবর্তন করা, প্রত্যাগমন করা, বারবার ফিরে আসা, ঘুরে ফিরে আসা ইত্যাদি। প্রতি বছর এ দিনটি ঘুরে ঘুরে আসে বলে একে ঈদ বলা হয়। ঈদ কে এজন্য ঈদ বলা হয় যে, ‘ঈদ প্রতি বছর নিত্য নতুন আনন্দ খুশি নিয়ে ফিরে আসে’ । ইবনে মনযুর আল-ইফরীকী (রহ.) ও আল-ফিরুযাবাদী (রহ.) বলেন, ‘ঈদ বলা হয়, আরবদের কাছে এমন সময়কে যাতে আনন্দ ও দুঃখ বারবার ফিরে আসে’। অনুরূপভাবে লোক সমাগমের দিন বা স্মৃতিবিজড়িত কোন দিন, যা বারবার ফিরে আসে এমন দিনকেও ঈদ বলা হয়। যেমনÑ আল-কুরআনের বলা হয়েছে, ‘ঈসা ইবনে মারইয়াম বললেন, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের প্রতি আকাশ থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা অবতরণ করুন এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদের, আমাদের পূর্ববর্তী ও আমাদের পরবর্তী সকলের জন্য হবে আনন্দোৎসব স্বরূপ ও আপনার নিকট থেকে একটি নিদর্শন হবে’। ‘ উপস্থিত লোকদের আনন্দ হবে তাদের আবেদন গৃহিত হওয়া এবং খাদ্য গ্রহণ করার কারণে আর পরবর্তী লোকদের আনন্দ হবে পূর্ববর্তীদের প্রতি নিয়ামত অবতীর্ণ হওয়ার কারণে’। এ থেকে বুঝা যায় যে, আসমানী খাদ্য নাযিল হওয়ার দিনটি পরবর্তীদের জন্য স্মৃতিচারণের দিন হওয়ায় সেটিকে ঈদ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ঈদ প্রতি বছর সাজগোজ, আনন্দ-খুশি ও নিত্য নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে ফিরে আসে। এসব কারণে ঈদের দিনকে আনন্দ, খুশি, সাজগোজ, এবং নতুন পোশাকে সুসজ্জিত হওয়ার দিন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ মূসা বললো, তোমাদের প্রতিশ্রুতির দিন সাজ-সজ্জার দিন এবং পূর্বাহ্নে লোকজন সমবেত হবে’। (সূরা: ৩০ তোয়াহা: ৫৯) ফিতর শব্দটি একটি আরবি পরিভাষা। এটি ইফতার থেকে এসেছে। এর অর্থ হলো রোযা ভঙ্গকরণ, ইফতার ইত্যাদি। যেহেতু সারাদিন রোযা পালন শেষে সন্ধ্যায় কিছু খেয়ে ইফতার করা হয় তাই একে ফিতর নামে নামকরণ করা হয়েছে। শারীয়াতের পরিভাষায় ঈদুল ফিতর তথা শাওয়াল মাসের প্রথম দিন এবং কুরবানীর দিনকে নির্দিষ্ট করে ঈদের দিন বলা হয়। হযরত আবু হুরায়রা ও আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ঈদুল ফিতর হলো যে দিন লোকেরা রোযা ভঙ্গ করে’। অতএব ঈদুল ফিতর অর্থ হলো, রোযা ভঙ্গের দিন, রোযা ভঙ্গের কারণে খুশি, উৎসব বা রমযানের পরবর্তী উৎসব। ‘ঈদুল ফিতর’ সেই উৎসব বা আনন্দকে বলা হয় যা মাহে রমযানের পরে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে বড়ত্ব ও মহত্ত্ব ঘোষানার্থে এবং বান্দার প্রতি তাঁর বিশেষ ক্ষমা ও অনুগ্রহের বার্তা নিয়ে প্রতি বছর আমাদের মাঝে ফিরে আসে।
প্রথম ঈদ পালিত হয় দ্বিতীয় হিজরীর ১ শাওয়াল ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মার্চ মদিনায়। আর মক্কায় প্রথম ঈদ পালিত হয় অষ্টম হিজরী ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা বিজয়ের প্রায় ১১ দিন পর। নবী করিম (সা.) মদিনায় গমন করে দেখতে পেলেন, পারসিক প্রভাবে মদিনায় বসবাসকারী লোকেরা শরতের পূর্ণিমায় ‘নওরোজ’ এবং বসন্তের পূর্ণিমায় ‘মিহিরজান’ নামাক দুটি উৎসব অত্যন্ত আনন্দ ও উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে পালন করছে। এ উৎসবে তারা নানা আয়োজন, আচার-অনুষ্ঠান ও আনন্দ উদযাপন করত। প্রাক ইসলামী যুগে আরব দেশে অন্যদের অনুকরণে নববর্ষ ও অন্যান্য উৎসব পালনের রেওয়াজ ছিল। হযরত আনাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আগমন করলেন, তখন তাদের দুটি দিন ছিল যাতে তারা উৎসব পালন করতো।’ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ দু’দিন কিসের উৎসব পালন করো?’ তারা বললো ’আমরা জাহেলী যুগে এ দু’দিন উৎসব পালন করতাম। এ ভাবধারাই চলে আসছে।’ তাদের একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের এই দু’দিনের বদলে দুটি মহান উৎসবের দিন প্রদান করেছেন। একটি ঈদুল ফিতর, অপরটি ঈদুল আযহা’। এতে তোমরা পবিত্রতার সাথে উৎসব পালন করো।
বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হয় ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ। বাংলাদেশে প্রথম কোথায় ঈদ পালিত হয়েছিল, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে ধারণা করা যায়, চট্টগ্রামের সন্দীপ অঞ্চলে প্রথম ঈদের জামায়াত হয়েছিল। ঢাকায় সম্ভবত প্রথম ঈদ উদযাপিত হয় সুলতানি আমলে (১৩০০-১৫৩৮ খ্রি.) মোটামুটি দুইশত বছরের বেশি সময়ে নগরকেন্দ্রিক ঈদ উৎসবের কিছুটা প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এখন যেভাবে ঈদ উৎসব পালিত হচ্ছে, এক‘শ বছর আগেও কি এভাবে হতো? সাধারণ মানুষ কি আজকের মতো অধীর আগ্রহ, উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে থাকতেন ঈদের চাঁদের দিকে? ঈদের ধুমধামের দিকে? ইতিহাস বলে ‘না’।
ইসলাম প্রচারের শুরুতে অর্থাৎ আদি বাঙালি মুসলমানরা কীভাবে ঈদ উৎসব পালন করতো, তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। তবে বলা যেতে পারে আদিতে প্রচার করা আরবের উদযাপিত ঈদের আদি রূপই হয়তো তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু কালের গর্ভে সময়ের বিবর্তনে সে রূপ চিরতরে হারিয়ে গেছে। কখনো ধর্মীয় নেতারা মূল অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করেছেন তাদের নিজের গড়া নতুন অনুষ্ঠান। কখনো শাসকশ্রেণির নির্দেশে যুক্ত হয়েছে বিশেষ বিশেষ ক্রিয়াকর্ম। কখনো-বা লৌকিক ধর্মের প্রভাব এসেছে লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে। বাংলাদেশে যেভাবে ঈদ উৎসব পালিত হচ্ছে, তাতে প্রভাব ফেলেছে কৃষিজীবী মানুষের লোকায়ত বিশ^াস। উৎসব হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ শতবর্ষ আগে ঈদের দিনটি কীভাবে পালন করতেন, সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। আর্থসামাজিক পটভূমিতে মানুষের মনেরও পরিবর্তন ঘটেছে। ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক বিবর্তন সংঘটিত হয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবের ফলে। শতবর্ষ আগে সাহিত্য, সংবাদ সাময়িকী পত্রে ঈদের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য বিবরণ পাওয়া যায় না। এদেশের হিন্দু, মুসলমান যিনিই আত্মজীবনী লিখেছেন, তাদের রচনায় দুর্গাপূজা, জন্মাষ্টমী, মহররম, এমনকি রথযাত্রা, দোল পূর্ণিমা, দিপালী উৎসব এরূপ বিভিন্ন পূজা-পার্বণ সম্পর্কে বিস্তর উল্লেখ পাওয়া যায়। শুধু পাওয়া যায় না ঈদুল ফিতর সম্পর্কে। তবে একালে যারা জন্মেছেন, তাদের বিবরণীতে ঈদুল ফিতর সম্পর্কে খানিকটা তথ্য পাওয়া যায়। এতে প্রমাণিত হয় ঈদুল ফিতরের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ উৎসব শতবর্ষ আগেও বাঙালির ঘরে ঘরে আজকের মতো অনাবিল হাসি, আনন্দের বার্তা বয়ে আনতে পারেনি। এ থেকে বলা যায় ঈদুল ফিতর সেকালে বাংলাদেশে তেমন কোনো বড় উৎসব হিসেবে পালন হয়নি। আজ আমরা যে ঈদের জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি, বাঙালির ঈদকে দেখি একটা সামাজিক ধর্মীয় বড় উৎসব হিসেবে তা কিন্তু সত্তর-আশি বছরের ঐতিহ্য মাত্র। বর্তমানে গ্রাম বাংলায় রোজা ও ঈদ যেভাবে পালিত হচ্ছে, তা কিন্তু নব্বই বছর আগেও এভাবে পালিত হতো না। ব্রিটিশ আমলে যে উৎসব সবচেয়ে ধুমধামের সঙ্গে এ বাংলায় প্রচলিত ছিল এবং ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে সবচেয়ে বেশি ছুটি বরাদ্দ ছিল, তা হলো খ্রিষ্ট সম্প্রদায়ের “ক্রিসমাস ডে”। ব্রিটিশ আমলে বিদ্যার দিক থেকে মুসলমানরা তুলনামূলকভাবে হিন্দুদের থেকে ছিল অনেক পিছিয়ে। ফলে “ক্রিসমাসের” পরেই সরকারিভাবে, সস্প্রদায়গত আধিপত্য এবং ঐতিহ্যের কারণে এই অঞ্চলে হিন্দুদের “দুর্গাপূজা” হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়, জাঁকালো এবং গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। অফিস-আদালতে ইংরেজ আমলে সরকারি ছুটির পরিমাণ ঈদের থেকেও পূজার জন্য ছিল অনেক বেশি। সে আমলে সরকারি নথিপত্রেও পূজা সম্পর্কে আছে পর্যাপ্ত তথ্যাদি।
শাসক ইংরেজরা স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানদের ঈদকে গুরুত্ব দেয়নি। এজন্য সরকারি ছুটিও বরাদ্দ ছিল কম। তাছাড়া মুসলমানদের পক্ষে ঈদকে সে আমলে উৎসবে পরিণত করা সম্ভব ছিল না। কারণ গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ মুসলমান ছিল বিত্তহীন ও নিরক্ষর। বরং মুসলমানের মহররমের, বিশেষ করে তাজিয়ার বর্ণনা পাওয়া যায় বিস্তর জায়গায় ও সংবাদপত্রে। এটি সে সময় ঢাকায় বেশ জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে পালিত হতো। ঢাকার হোসেনি দালান ছিল শিয়া সম্প্রদায়ের মহররমের পুণ্যভূমি। মুসলমানদের উৎসবের শ্রেষ্ঠ প্রাণ কেন্দ্র নবাবী আমল থেকেই পৃষ্ঠপোষকতা ছিল এর পেছনে। ঈদ মুসলমানদের প্রধান উৎসব হিসেবে পালিত না হওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ ছিল বিশুদ্ধ ইসলাম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা। দীর্ঘদিন ইংরেজ শাসনের প্রভাবে মুসলমানরা ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ফলে ফরায়েজী আন্দোলনের আগে (১৮১৮ খ্রি.) গ্রামাঞ্চলে মুসলমানদের কোনো ধারণা ছিল না বিশুদ্ধ ইসলাম সম্পর্কে। ইসলাম ধর্মে লোকজ উপাদানের আধিপত্য ছিল প্রায় ক্ষেত্রেই হিন্দু রীতিনীতির ওপর। ১৮৮৫ সালে জেমস ওয়াইজ তার “ Notes on the Races castos and trades Eastern Bengal London” বইতে লিখেছেন, “বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সরল অজ্ঞ কৃষক। ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ঈদের দিনে গ্রামবাসীরা জমায়েত হয়েছেন ঈদের নামাজ পড়বেন বলে, কিন্তু সে সময়ে দুর্ভাগ্য এই যে, জামাতের একজনও জানতেন না কীভাবে ঈদের নামাজ পড়তে হয়। পরবর্তীতে ঢাকায় নৌকাযোগে এক যুবক যাচ্ছিলেন তাকেই ধরে নিয়ে এসে পড়ানো হয়েছিল ঈদের নামাজ”। ঐতিহাসিক মুনতাসীর মামুন উল্লেখ করেছেন তাঁর পিতার সহকর্মী যিনি ছিলেন সে আমলে একজন নামজাদা পীর, তাঁকে বলেছিলেন “মুসলমান ছিলাম বটে (তার জন্ম ১৮৯৮ সালে) কিন্তু ছেলেবেলায় রোজা বা ঈদ সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা ছিল না। মসজিদ ছিল হয়তো কয়েক গ্রাম মিলে একটি। সে সময় বাংলা “মাসিক সঞ্জীবনী” পত্রিকার সম্পাদক (কৃষ্ণ কুমার মিত্র) লিখেছেন (উনিশ শতকের মাঝামাঝি ময়মনসিংহের গ্রামাঞ্চলের মুসলমানদের সম্পর্কে) “সে সময় মুসলমানরা নামাজ পড়িত না। গ্রামে কোন মসজিদ ছিল না। স্থানে স্থানে দরগা ছিল। মুসলমানরা তহবন্দ বা লুঙ্গি পরিত না। কাছা কোঁচা দিয়া ধুতি পরিধান করিত। তাহাদের অনেকের নাম ছিল যেমন, গোপাল, ঈশান, ধীরেন ইত্যাদি। মুসলমানরা সেই সময় দুর্গা, কালী, মনসা প্রভৃতি পূজার ভোগের জন্য কুমড়া, কলা, মানকচু ও বলির জন্য পাঠা দিতো। তাহাদের দর্গায় গরু প্রভৃতি জন্তুর মূর্তি রাখা হইতো। মাদার বাঁশের খেলা হইতো (অধুনালুপ্ত পাক-ভারতের বিখ্যাত ইসলাম প্রচারক সুফি সাধক হজরত বদীউদ্দীন শাহ-ই-মাদার)। বাঁশের ওপর লম্বা চুল বাধিয়া হিন্দু-মুসলমান সবাই দল বাঁধিয়া বাড়িতে বাড়িতে চাল সংগ্রহ করিত। দর্গাতে শিরনী দিতো। মানত করিতো। মুসলমানরাই বলির জন্য হাঁস দিতো। মুসলমানরা সেকালে কালীপূজার জন্য পাঁঠা বলি দিতো। দুর্গাপূজার জন্য ডিম দিতো। আবুল মনসুর আহমদ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “উনিশ শতকের শেষার্ধেও সে সময় নামাজ রোজা চালু ছিল না। তাদের গ্রামাঞ্চলে ছিল না কোনো মসজিদ। তরুণদের তো কথাই নেই। বয়স্করাও সকলে রোজা রাখতেন না। দিনের বেলা তারা তামাক ও পানি খেতো। শুধু ভাত খাওয়া থেকে বিরত থাকতো। পানি ও তামাক খাওয়াতে রোজা নষ্ট হতো না। এই বিশ^াস ছিল তখন তাদের মনে। রোজার মাসে মাঠে যাওয়ার সময় একটা বাঁশের চোঙ্গা রোজাদাররা সঙ্গে রাখতেন। পানি বা তামাক খাওয়ার শখ হলে এই চোঙ্গার খোলা মুখে মুখ লাগিয়ে খুব জোরে দম ছাড়া হতো। মুখ তোলার সঙ্গে সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি গামছা, নেকড়া বা পাটের টিপলা দিয়ে চোঙ্গার মুখ কষে বন্ধ করা হতো, যাতে বাতাস বের হয়ে আসতে না পারে। তারপর আবশ্যক মতো পানি ও তামাক পান করে চোঙ্গাটা আবার মুখের কাছে ধরা হতো। খুব ক্ষিপ্র হাতে চোঙ্গার টিপলাটা খুলে মুখ লাগিয়ে চুষে চোঙ্গায় বন্ধ রোজা মুখে আনা হতো এবং ঢোকা গিলে একেবারে পেটের মধ্যে ফেলে দেয়া হতো। খুব ধার্মিক ভালো মানুষ দু-একজন এমন করাটা পছন্দ করতেন না বটে, কিন্তু সাধারণভাবে সে সময় এটাই চালু ছিল।”
“তাবাকাৎ-ই-নাসিরি”র লেখক ঐতিহাসিক মিনহাজ উস-সিরাজ সেকালের ঈদ উৎসব সম্পর্কে জানিয়েছেন, “বাদশাহ ধর্মীয় আলোচনায় ব্যস্ত থাকতেন, ঈদের নামাজ পড়ানোর জন্য নিয়োগ করতেন ধর্মীয় ইমাম। শহরের বাইরে উন্মুক্ত জায়গায় অথবা গ্রামে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হতো এবং এসব স্থানকেই ঈদগাহ নামে অভিহিত করা হতো।”
ঈদ সম্পর্কে আমরা সেকালে যে বিবরণ পাই, তা থেকে ধরে নেয়া যায় রমজান মাস থেকেই শুরু হতো ঈদের প্রস্তুতি। এ উৎসব শুরু হতো রমজানের চাঁদ দেখা থেকে। গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের সঙ্গে এর তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না।
আবুল মনসুর আহমদ সেকালে ঈদের কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে আরও বলেছেন, “এই অঞ্চলে কোনো মসজিদ বা জুমার ঘর ছিল না। বছরে দুইবার ঈদের জামায়াত হইতো বটে, কিন্তু তাতে বড়রাই শামিল হইতো। তাই জামায়াতে খুব অল্প লোকই দেখা যাইতো। সাধ্যমতো নতুন কাপড় চোপড় পরিয়া লোকেরা বেদম গান বাজনা করিতো। সারারাত ঢোলের আওয়াজ পাওয়া যাইতো। প্রায়ই বাড়ি বাড়ি ঢোল ডাগর দেখা যাইতো। ঈদের জামায়াতেও লোকেরা কাছা, ধুতি পরিয়াই যাইতো। নামাজের সময় কাছা খুলিতেই হইতো। সে কাজটাও তাহারা নামাজে দাঁড়াইবার আগেতক করিত না। প্রথম প্রথম নামাজের কাতারে বসিবার পর অন্যের অগোচরে চুপি চুপি কাছা খুলিয়া নামাজ শেষ করিয়া কাতার হইতে উঠিবার আগেই আবার কাছা দিয়া ফেলিত”।
অজ্ঞতা ও কুসংস্কার তখন বাঙালি মুসলমান সমাজকে নিদারুণভাবে গ্রাস করে। তারা সহজ-সরল ইসলাম ভুলে গিয়ে রমজানে ও ঈদ উৎসবের মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বহু কুপ্রথা, অন্ধবিশ^াস, ইসলামবিরোধী আচার অনুষ্ঠানে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সে সময় সত্যিকারের ইসলাম হারিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে কুসংস্কার ও অনৈসলামিক কার্যকলাপে লিপ্ত থেকে অন্ধকারের অতল তলে হারিয়ে যায়। মুসলমানদের সমাজে এই অধঃপতন দেখে সে সময়ে ফরায়েজী আন্দোলনের প্রবক্তা হাজী শরীয়তুল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০ খ্রি.) স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। জেমস ওয়াইজ আরও লিখেছেন, ‘দীর্ঘকাল হিন্দুদের সংস্পর্শে থাকার ফলে ঈদ উৎসবের ধর্মীয় ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে হিন্দুদের মতো যেসব কুসংস্কার ও অন্ধবিশ^াস প্রবেশ করে তার বিরুদ্ধে হাজী শরীয়তুল্লাহ সর্বপ্রথম আন্দোলন আরম্ভ করেন। তিনি ইসলাম ধর্মের বহু দেব-দেবী, ভ্রান্ত অলীক বিশ^াসও পাপপূর্ণ নতুন প্রথাগুলোর উচ্ছেদের জন্য আন্দোলন করেন। এভাবে হাজী শরীয়তুল্লাহ দীর্ঘকাল যাবৎ পূর্ববঙ্গের মুসলমান সমাজ থেকে বহু অন্ধ বিশ^াস ও কুসংস্কার দূর করেন।’
মোগল আমলে ঈদের দিন যে হইচই ও বর্ণাঢ্য আনন্দ উৎসব পালিত হতো তা’ বহিরাগত উচ্চপদধারী বা ধনাঢ্য মুসলমানদের মধ্যেই ছিল সীমাবদ্ধ। এ সবের সঙ্গে সাধারণ গ্রামবাংলার মানুষের ছিল যোজনব্যাপী ব্যবধান। আর সে আমলে ধনাঢ্য মুসলমান ব্যক্তিরা পথে প্রচুর পরিমাণ টাকা কড়ি ছড়িয়ে দিতেন, গরিবদের কাছে কিছু দান-খয়রাতও করতেন, এমন তথ্য সে আমলে বিদ্যমান রয়েছে। মোগলরা যে ঈদকে গুরুত্ব দিতেন,তা বোঝা যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় শাহী ঈদগাহের ধ্বংসাবশেষ দেখে। এ রকম একটি ঈদগাহ এখনো বিদ্যমান রয়েছে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায়। শাহ সুজা যখন বাংলার সুবাদার তখন তাঁর প্রধান আমাত্য মীর আবুল কাসেম ১৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করেছিলেন এই ঈদগাহটি। সুবাদার, নাজিম ও অন্যান্য মোগল কর্মকর্তারা নামাজ পড়তেন এখানে। তবে মোগল আমলে ঈদের দিন ঈদগাহে যেতেন শুধু মোগলরাই। সাধারণ মানুষের স্থান সেখানে কখনোই ছিল না। মুষ্টিমেয় মোগল আমাত্য ও কয়েকজন ধনী মানুষ পড়তো সেখানে ঈদের নামাজ।
এ শতকের তৃতীয়-চতুর্থ দশকের গ্রামাঞ্চলে ঈদ পালনের বর্ণনা পাওয়া যায় খন্দকার আবু তালিবের নিবন্ধ থেকে “রোজার পনেরো দিন যাওয়ার পর হতেই গৃহবধূরা নানা রকম নকশি পিঠা তৈরি করতে আরম্ভ করতো। এদের মধ্যে ফুল পিঠা, পাঁপড় পিঠা, ঝুরি, হাতে টেপা সেমাই ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। শবেকদরের রাতে মেয়েরা মেহেদী এনে তা বেঁটে হাতে নানা রকম চিত্র আঁকতো। ফুল পিঠা তৈরি করার সময় বউয়েরা ‘প্রিয় স্বামী’, আর অবিবাহিত মেয়েরা ‘বিবাহ’ ও ‘প্রজাপতি’ এঁকে রাখতো। ঈদের দিনে যুবক-যুবতী, বন্ধু-বান্ধবীদের পাতে দেয়ার জন্যই এ ধরনের ফুল পিঠা তৈরি করা হতো”।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে কোনো একটি ঈদের সময় এক মর্মস্পর্শী কবিতা রচনা করেছিলেন। সে কবিতা পড়লে মনে হতে পারে আজও এ দেশে দুর্দিনের অবসান হয়নি, এমনকি ঈদের দিনেও। সেই বিষাদময় কবিতায় নজরুল লিখেছিলেনÑ ‘বেলাল, বেলাল হেলাল উঠেছে/পশ্চিম আসমানে/লুকাইয়া আছো লজ্জায় কোন/মরুর গোরস্থানে…/হের ঈদগাহে চলেছে কৃষক/যেনগো মৃতের প্রায়/বেলাল তোমার কণ্ঠে/বুঝিবা আজান থামিয়া যায়।’ কবি আরো লিখেছেনÑ সেই শিশু অকালে চলে গেছে লোকান্তরে। কবি তাই প্রশ্ন করেছিলেনÑ ‘চাঁদ হয়ে আজ/উঠেছে কি সেই/শিশু-পাঁজরের হাড়?’
ইসলাম সম্পর্কে আগের অজ্ঞতাও তেমন নেই এখনকার মুসলমানদের মধ্যে। ফলে স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমপ্রধান দেশে ঈদ এখন নিজের গৌরবোজ্জ্বল, ঐতিহ্যমন্ডিত স্থান করে নিয়েছে এবং আমাদের বাংলাদেশেও তা বিরাট গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে। মুসলমানদের ধর্মীয় তামুদ্দনিক চেতনা জাগ্রত করেছে এই ঈদুল ফিতর। কবির ভাষায় বলতে গেলে- ‘এসো মুসলিম তসলিম নাও,/নাও এ তোহফা বেহেশতের/তশতরী ভরে শীরনি বিলাও/নির্মল ইনসানিয়াতের।’
কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির মধ্যে এবারও এসেছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। এই মহামারিতে বিশ্বে এ পর্যন্ত ৬৩ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫১ কোটি। আর বাংলাদেশে মারা গেছেন প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। পরিক্ষার মাধ্যমে সংক্রমিত হিসেবে শনাক্ত মানুষের সংখ্যা ২০ লাখ পেরিয়ে গেছে।
পরিশেষে বলা যায়, শুধু ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমেই নয়; আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমেও যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় এর বাস্তব উদাহরণ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। ঈদ মুসলিম উম্মার প্রতি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ দান। এবারের ঈদুল ফিতর আমাদের মাঝে খুশি ও আনন্দ বয়ে আনুক। সুখ ও শান্তির ফল্গুধারা বয়ে যাক সমাজের প্রতিটি স্তরে। ঈদুল ফিতরের এ খুশি আমাদের অন্তর থেকে দূর করুক সকল কুটিলতা। সমাজে ফিরিয়ে আনুক অনাবিল শান্তি। ঈদ মোবারক।
তথ্য সূত্র :- ১। আত্ম কথা : আবুল মনসুর আহমদ, ঢাকা ১৩৭৮ বাংলা, ২। রোজা এবং ঈদের উৎসব : সেকালে ঃ আলমগীর জলীল, দৈনিক পূর্বাঞ্চল, খুলনা, ৭ জানুয়ারি ২০০০ খ্রি., ৩। আত্মচরিত : কৃষ্ণ কুমার মিত্র, কলকাতা ১৯৪৭ খ্রি., ৪। ঈদ : আমাদের কালের কথা : খন্দকার আবু তালেব, সাপ্তাহিক ঢাকা, ঈদ সংখ্যা ১৯৮৮ খ্রি., ৫। ঢাকার ঈদ : আব্দুস সাত্তার, ৬। লৌকিক সংস্কার ও মানবসমাজ : আব্দুল হাফিজ, ঢাকা, ১৯৯৪ খ্রি. ৭। বাংলাদেশে ঈদ : সেকাল-একাল : মুনতাসীর মামুন।
লেখক : এম এ কবীর, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি।