এম এ কবীর : আইন না মানার প্রবণতা আছে। অন্যায় আছে,অনিয়ম আছে, স্বজনপ্রীতি আছে,দুর্নীতিও আছে। আবার সবকিছুর প্রতিকার চাওয়ারও সুযোগ আছে। হয়তো সব ক্ষেত্রে প্রতিকার পাওয়া যায় না। কিন্তু কাগজে-কলমে আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার সবার জন্য উন্মুক্ত। অবশ্য ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী কেউ ‘বাড়াবাড়ি’ করলে তেমন প্রতিক্রিয়া না-ও হতে পারে। দুর্বল পক্ষ যদি দুর্বল পক্ষের ওপর অন্যায় বা জুলুমবাজি করে,তাহলে আইন এবং আইন প্রয়োগকারীদের তৎপরতা দৃশ্যমান হতে দেখা যায়।
রংপুরের পীরগাছা উপজেলায় জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে এক ভ্যানচালকের স্ত্রী ও কন্যাকে প্রকাশ্যে গাছে বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে। প্রকাশিত খবরে জানা যায়,পীরগাছার আনন্দি ধনিরাম গ্রামের শাহজাহান মিয়ার সঙ্গে প্রতিবেশী জিয়ারুল মিয়ার জমিজমা নিয়ে বিরোধের কারণে জিয়ারল ও তাঁর লোকজন শাহজাহান মিয়ার লাগানো গাছ ও চলাচলের রাস্তা কেটে দিতে যান। দিনেদুপুরে এ ঘটনা হওয়ায় শাহজাহান মিয়া এবং তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা বাধা দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন জিয়ারুল ও তাঁর লোকজন। একপর্যায়ে শাহজাহান মিয়ার স্ত্রী গোলাপী বেগম এবং কন্যা রাবেয়া কে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন চালানো হয়। পরে ৯৯৯ নম্বরে ফোন পেয়ে পীরগাছা থানা-পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আহত মা-মেয়েকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসাদেন। এ ঘটনার দুদিন পর শাহজাহান মিয়া ১৭ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন। পুলিশ পাঁচ নারীসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলা হয়েছে,গাছে বেঁধে নির্যাতন করা ভুল হয়েছে। তাঁরা বসে এটা মীমাংসা করে নেবেন।
মা অসুস্থ। ঈশ^রচন্দ্রকে বাড়ি যেতে হবে। অফিসের বড় কর্তার কাছে ছুটি চেয়ে বিফল হলেন। তাই চাকরি ছেড়ে দিতে হলো ঈশ^রচন্দ্রকে। তখন সন্ধ্যা। শুরু হয় ভীষণ ঝড়-বাদল। দামোদরের তীরে পৌঁছে দেখলেন নদী পার হওয়ার মতো একটি খেয়া নৌকাও ঘাটে নেই। কিন্তু তাকে যে মায়ের কাছে যেতেই হবে। ঝড়ের রাতে ঈশ^রচন্দ্র খরস্রোতা দামোদার নদী সাঁতরে পাড়ি দিলেন। শরীর খুব ক্লান্ত। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছুলেন মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে মা ভগবতী দেবীর কাছে। ছেলে আসবে,মা জানতেন।
১৫ জানুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠন প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। এ সমাবেশে উপস্থিত হন এমন অনেক হতভাগ্য মা,স্ত্রী,পুত্র-কন্যারা। তারা দীর্ঘ দিন ধরে প্রতীক্ষায় আছেন হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের জন্য। কষ্টের কথা বলা ছাড়া তাদের কাছে নেই কোনো সুখবর। স্বজনদের ডাকছেন,কিন্তু মিলছে না কোনো সাড়া।
তিন বছর ধরে স্বামীর খোঁজ করছেন নাসিমা আক্তার। দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। বললেন,আমার ঘরে কোনো উৎসব হয় না। সন্তানেরা কখনো হাসে না। তিনি জানান,তার স্বামী কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেনকে ২০১৯ সালের ১৯ জুন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে কিছু অজ্ঞাত ব্যক্তি তুলে নিয়ে যায়।
১৯টি অসহায় পরিবারের সদস্যরা মায়ের ডাকের সমাবেশে যোগ দেয়। বেশ কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এর করুণ বিবরণ। লক্ষ্মীপুর থেকে গুম হওয়া আলমগীর মোল্লার মা-বাবা বলেন,১০ জানুয়ারি থেকে তাদের কয়েকবার থানায় যেতে হয়েছে। আলমগীরকে খুঁজে বের করা তো দূরের কথা,ছেলের সাথে পরিবারের কখন কী ঘটেছিল সেই বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছে পুলিশ। লক্ষ্মীপুরের গুম হওয়া ফরিদ আহমেদের বোন শিল্পী বলেন,তাদের বাসায় পুলিশ কয়েকবার গেছে। কাগজপত্রে তার,স্বামীর ও মায়ের সই নিয়েছে।
গুম হওয়া ছাত্রদল নেতা মাহবুব হাসান সুজনের ভাই শাকিল খান বলেন, তাদের বাসায় পুলিশ আসে বেশ রাতে। তারা আগে থেকে লেখা একটি কাগজে তার সত্তরোর্ধ্ব বাবাকে সই দিতে জোরাজুরি করেন। না হলে তাকে থানায় নিয়ে যাবেন বলেও হুমকি দেন। এ অবস্থায় তার অসুস্থ মা কাঁদতে শুরু করেন। স্বজনের শিশুসন্তানেরা ভয়ে কুঁকড়ে যায়। কয়েক বছর আগে গুম হওয়া বংশাল থানা ছাত্রদলের সভাপতি পারভেজ হোসেনের স্ত্রী ফারজানা আক্তার বলেন, তিনি এখন সন্তানদের নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকেন। কয়েক দিন আগে পুলিশ স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে নিয়ে বংশালে তার শ^শুরবাড়িতে যায়। শাশুড়ির ফোন থেকে ফোন করে তাকে দেখা করতে বলে। পুলিশকে তিনি ঢাকায় এসে যোগাযোগ করবেন বললে ওই পুলিশ সদস্য তাকে একটি রেস্তোরাঁয় দেখা করতে বলে। ফারজানা আরো বলেন,তার শশুরবাড়ির বাসায় গিয়ে ওই সদস্যরা বলেছে,ফারজানা জানেন তার স্বামী কোথায়। তিনিই স্বামীকে লুকিয়ে রেখেছেন।
মায়ের ডাকের সমাবেশে সংগঠনের সমন্বয়ক আফরোজা ইসলাম বলেন, আপনারা জাতিসঙ্ঘে কাগজপত্র পাঠাতে বলেছেন। আমরা আমাদের স্বার্থেই সহযোগিতা করব। কিন্তু আপনারা কেন প্রায় বিধবা এমন নারীদের কখনো দিনে কখনো রাতে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন? ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখছেন।
গত বছরের জুনে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার পরিষদ গুম হওয়া ৩৪ জনের ব্যাপারে জানতে চেয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। এর ছয় মাসের মাথায় গত ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র সরকার গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে র্যাব এবং এই বাহিনীর বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তখন এ বিষয়ে মার্কিন কর্তৃপক্ষের জারি করা প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল,বাংলাদেশের বেসরকারি সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে,র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ২০০৯ সাল থেকে ৬‘শ বিচারবহির্ভূত হত্যা,ছয় শতাধিক ব্যক্তির গুম হওয়া এবং নির্যাতনের জন্য দায়ী। মার্কিন এই নিষেধাজ্ঞার পর গুম হওয়া ব্যক্তিদের তথ্যের জন্য স্বজনদের কাছে যাচ্ছে পুলিশ। সমাবেশে অংশ নেয়া ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড.আসিফ নজরুল বলেছেন,প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করতে হলে এর সাথে যেসব কর্মকর্তা জড়িত তাদের বিচার করুন। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, দেশে এখন ভয়ের শাসনই শুধু চলছে না,ভয়ের চাষ চলছে। ঘটনা চাপা দিতে পুলিশ কাগজ নিয়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের কাছে যাচ্ছে।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সাংবদিকদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড.এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন,এ নিষেধাজ্ঞা যাতে তুলে নেয়া হয় সে জন্য তারা মার্কিন সরকারকে চিঠি দিয়েছেন,যোগাযোগ রাখছেন এবং নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সুরাহার জন্য লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে।
গত ১৪ জানুয়ারি প্রকাশিত এক বিবৃতিতে নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠনগুলোর জোট হিউম্যান রাইটস ফোরাম (এইচআরএফবি) বলেছে,পুলিশ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার পরিবর্তে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর দুর্দশা আরো বাড়াচ্ছে। পুলিশের এমন আচরণ বন্ধের দাবি জানানো হয় বিবৃতিতে। এইচআরবির বিশেষজ্ঞ হামিদা হোসেন,সুলতানা কামাল, রাজা দেবাশীষ রায়, ইফতেখারুজ্জামানসহ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এতে স্বাক্ষর করেন।
মার্কিন কংগ্রেসের টম ল্যান্টোস মানবাধিকার কমিশন সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল আলোচনায় উল্লেখ করেছে,বাংলাদেশে বিরোধীদলের নেতাকর্মী, ভিন্নমতাবলম্বী ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের উদ্দেশ্যে একধরনের ভয়ের সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছে। অবাধ বিচারহীনতার সংস্কৃতি-গুমকে উৎসাহিত করছে। এর আগে গত আগস্ট মাসে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়,২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত ১১৫ জনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তারা একটি রিপোর্ট তৈরি করেছে। এতে এ সময়ে বাংলাদেশে বলপূর্বক গুমের শিকার ৮৬ জনের কথা উল্লেখ করা হয়।
গত ৩১ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। এতে উল্লেখ করা হয়,বিচারহীনতা,বিচারবহির্ভূত হত্যা,গুম,খুন,ধর্ষণসহ সমাজে এমন একটি অবস্থা তৈরি হয়েছে,যা ভীতিকর। সারা দেশই বলা যায়,ভয়ের চাদরে আবৃত। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নতুন করে ভয়ের সৃষ্টি করেছে। আসক-এর রিপোর্টে ২০২১ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার ৮০ জন এবং গুম হওয়া সাতজন বলে উল্লেখ করা হয়। এই যে ভয়ের সমাজ,এই যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও অমানবিকতা,সেখানে মায়ের ডাক উপেক্ষিত।
একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি হয়েছিল জাঁ পল সার্ত্রের জীবন ও কাজ নিয়ে। প্রামাণ্যচিত্রটি জুড়ে ছিল ফরাসি এই নাট্যকার,ঔপন্যাসিক ও দার্শনিকের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। সেই সাক্ষাৎকারে বুদ্ধিজীবীদের বিষয়ে বেশ কিছু কথা বলেছিলেন সার্ত্র। বুদ্ধিজীবীরা মূলত উঠে আসেন মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে, কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বুদ্ধিজীবীর দিকে এমন করে তাকায়,যেন কোনো অদ্ভুত একটি প্রাণীর জন্ম তারা দিয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধ আসে মূলত মধ্যবিত্তের ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধ থেকে। তাই তাঁরা মধ্যবিত্তের সংস্কৃতির রক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করে যান। হয়ে ওঠেন পেশাজীবী এবং সেই পেশাসংশ্লিষ্ট স্বার্থই দেখেন। আর কেউ বনে যান অভিজাত। যতই তাঁরা বিপ্লবী চেতনার কথা বলে থাকুন না কেন,মধ্যবিত্ত চিন্তা ও চেতনায় তাঁদের মধ্যে এত বিশাল প্রভাব ফেলে যে তাঁরা নিজেদের অজ্ঞাতেই বদলে যেতে শুরু করেন। তারপর নোবেল বা বড় কোনো পুরস্কার খেতাব বা সম্মান নিয়ে তাঁরা কৌশলে ফিরে আসেন নিজের বলয়ে। সকৌতুকে সার্ত্র লক্ষ্য করেছেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে উদ্ভূত হয়ে মধ্যবিত্তের বিরুদ্ধে যাঁরা সংগ্রাম করতে চান,যাঁরা বিত্তহীনের পক্ষ অবলম্বন করেন,তাঁদের উচ্চারণ ও সব কার্যক্রম পরিচালিত হয় মধ্যবিত্তের ভাষায় এবং মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের ওপর দাঁড়িয়ে। সার্ত্র নিজেও কি এই মধ্যবিত্ত মানসিকতা থেকে নিজেকে দূরের মানুষ বলে মনে করেন? না। সার্ত্র অকপটে স্বীকার করেন যে তিনি নিজে এর ব্যতিক্রম নন এবং বুঝিয়ে দেন যে এই পরস্পরবিরোধিতায় তিনি স্বয়ং বন্দী। এই বন্দিত্ব ঘোচানোর নানা চেষ্টা তিনি করেছেন। নানা ধরনের পুরস্কার,খেতাব,উচ্চপদ-জাতীয় প্রলোভন তিনি এড়িয়ে গেছেন। তারপরও তিনি মনে করেন,তাঁর সব কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে মধ্যবিত্তের জন্য। তবে মধ্যবিত্তদের শাসন ও স্বার্থ গুঁড়িয়ে দেয়ার সংগ্রাম করছে যাঁরা,সেই শ্রমজীবীদের সঙ্গে বোধ করেছেন একাত্মতা।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ডিসেম্বর মাসে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর একটি ভার্চুয়াল সম্মেলন ডেকেছেন। এতে চীন ও রাশিয়া যে নিমন্ত্রণ পাবে না,এটা তো জানাই ছিল। কারণ,তাদের বাদ দিয়ে, বস্তুত চীনকে কোণঠাসা করার জন্যই হয়তো এই ‘গণতান্ত্রিক’ সম্মেলন ডাকা। কিন্তু আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকতে আগ্রহী বাংলাদেশও যে আমন্ত্রিতদের তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেছে,সেটাই বিস্ময়ের ব্যাপার। দুশ্চিন্তারও বটে। ১১০টি দেশ নিমন্ত্রণ পেল,এমনকি প্রতিবেশী ভারত,নেপাল, পাকিস্তান ও মালদ্বীপও বাদ পড়ল না,বাদ পড়ল শুধু বাংলাদেশ? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রথমে কোনো প্রতিক্রিয়াই জানায়নি,যেন এটি বিবেচনাযোগ্য কোনো ঘটনাই নয়। তবে গত ২৩ নভেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত দুর্বল গণতন্ত্রের রাষ্ট্রগুলোকেই আমন্ত্রণ করেছে এবং ব্যাখ্যা করে জানান, ‘কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে স্থিতিশীল গণতন্ত্র বিরাজ করছে। অত্যন্ত স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ সুষ্ঠু ও মুক্তভাবে ভোট দিতে পারছে।’
স্টকহোমভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স নামে প্রতিষ্ঠানটি গত ২২ নভেম্বর ‘গণতন্ত্রের বৈশি^ক পরিস্থিতি ২০২১’ নামে যে রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে,তাতে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক নয়, কর্তৃত্ববাদী শাসনের তালিকাতেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘কিছু কিছু কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে নিয়মিত নির্বাচন হচ্ছে, যা মোটেই স্বাধীন ও অংশগ্রহণমূলক নয়। এ ধরনের নির্বাচন আবার অনিয়মমুক্তও নয়। এসব দেশে উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।’ (প্রথম আলো,২৯ নভেম্বর- ২০২১) অন্য এক বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন,‘যুক্তরাষ্ট্র সুশাসনের কথা বলে বিভিন্ন দেশকে চাপে রাখতে চায়।’ (সমকাল, ২৭ নভেম্বর-২০২১)।
নিখোঁজ হওয়ার দুদিন পর শুক্রবার সকালে গাজীপুর মহানগরীর দক্ষিণ পানিশাইল এলাকা থেকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সাইদা খালেকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ধরা পড়ে সন্দেহভাজন এক যুবক। তাঁর স্বীকারোক্তি থেকেই খুঁজে পায় পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক এই অধ্যাপকের লাশটি।
আলাদা করে একটি হত্যাকান্ড নিয়ে লেখার কোনো মানে হয় না। কিন্তু তখনই লিখতে হয়,যখন বোঝা যায় এই একক ঘটনাও সমগ্রতার আভাস দেয়। জানিয়ে দেয়,একটা নির্বিকার প্রবণতা ধীরে ধীরে গ্রাস করছে মনুষ্যত্ববোধকে। যে কেউ চাইলেই যে কাউকে খুন করার মতো ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারছেন।
আমরা নানা সূচকে উন্নয়নকে বাহ্বা দেয়ার পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারছি, কিন্তু মনের চাষবাসে অনীহ হয়ে উঠছি। আমাদের জীবন থেকে নেয়া শিক্ষায় কোথায় যেন একটা গোলমাল দেখা যাচ্ছে। এবং সেটাই ধীরে ধীরে গ্রাস করছে আমাদের মানবিকতাকে। মানুষ কি ধীরে ধীরে সুস্থ মাথায় ভাবতে ভুলে যাচ্ছে? কোন কাজ করলে কী পরিণতি হবে, সে কথাও ভাবছে না?
স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি খুবই জরুরি একটি ব্যাপার। কোটি কোটি মানুষের এই দেশে শৃঙ্খলা বজায় রেখে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন মানবিক হওয়ার শিক্ষা। কিন্তু নানা কারণে মানুষের মনে নীতিহীনতার চাষবাস বেড়ে গেছে। সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ-ঘৃণার বিপরীতে যদি ভালোবাসা-শ্রদ্ধা-স্নেহের জয় না হয়, তাহলে বুঝতে হবে, আমরা একটা ভয়াল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিকে শপথগ্রহণ করিয়েছেন। এবার স্বাধীনতা দিবসেরও ছিল সুবর্ণজয়ন্তী। দেশের সব কটি জেলায় তরুণদের প্রাধান্যসহ সমাবেশের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে এই শপথগ্রহণ করানো হয়। মূল অঙ্গীকার ছিল মুক্তিযুদ্ধে এবং বাংলাদেশের রূপায়ণে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য ভূমিকা উপলব্ধি এবং তার স্বপ্ন অনুযায়ী অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ। এ ধরনের শপথের গুরুত্ব কম নয়,কেননা ভোগবাদী যুগে নতুন প্রজন্ম রাজনীতি,ইতিহাস এবং ঐতিহ্যবিমুখ হয়ে পড়েছে। তাদের যদি ইতিহাসের আলোকে নাগরিকের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করা না যায় তা হলে আগামী দিনে জাতি সংকটে পড়বে।
বেশ কয়েক দশকে পারিবারিক ভাঙন, মূল্যবোধের অবক্ষয় ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। দেখতে না চাইলেও তা আর লুকানো যাচ্ছে না। চোখ বুজে থাকলেও এর পঁচা গন্ধ এড়ানো যাচ্ছে না কিছুতেই। কোনো পুকুরের একটি মাছ মরে ভেসে উঠলে আমরা সে মাছটিকে আলাদা করে নিই এবং ধরে নিই ওই মাছটির মধ্যেই কোনো সমস্যা ছিল। কিন্তু যখন একই পুকুরে ‘শখানেক মাছ মরে ভেসে ওঠে তখন বুঝতে হয়,পুকুরে নিশ্চয়ই এমন কিছু ঘটেছে, যাতে মাছগুলো আক্রান্ত হচ্ছে।
আমাদের নতুন প্রজন্ম ব্যাপকহারে হতাশ হচ্ছে, এমনকি আত্মহননের পথও বেছে নিচ্ছে, সম্প্রতি বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার ‘স্পেশাল ইনিশিয়েটিভ ফর মেন্টাল হেলথ’বিষয়ক অনুষ্ঠানে জানায়, দেশে প্রতিবছর অন্তত দশ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেন। তবে গত বছর থেকে শুরু হওয়া করোনা মহামারীর প্রথম দশ মাসে দেশে আত্মহনন করেছেন অন্তত ১৪ হাজার মানুষ। দেশের ১৮ শতাংশ মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত। শিশুদের মধ্যে এই হার ১২ শতাংশ। ১৪ বছর বয়সের আগেই ৫০ শতাংশ এবং ২৫ বছর বয়সের আগেই ৭৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি করোনাকালে মানুষ নানা সংকটে দিন পার করছে। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে বিস্তর ফারাক। ফলে হতাশাগ্রস্ত মানুষ নিজেকেই হত্যার প্রবণতায় ঝুঁকছেন।
বিভিন্ন কারণে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের চরমে পৌঁছে গেছে। সন্তান বাবা-মাকে অবলীলায় খুন করছে, নেশায় আচ্ছন্ন হচ্ছে, এটি আর কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি আমাদের লালন-পালনেরই কোনো একটি বড় সমস্যা। দেশে প্যারেন্টিং নিয়ে কেউ কথা বলে না। কেন বলে না? এটাও ওই প্যারেন্টিংয়েরই একটা অন্ধ সংস্করণ।
ন্যায়-অন্যায়ের সংজ্ঞা বয়সের ওপর নয়, বিবেচনাবোধ ও শিক্ষার সমন্বয়ে তৈরি হয়। জীবনযাপনের অভিজ্ঞতাই সেখানে মাপকাঠি হতে পারে না। যদি বয়সের ভিত্তিতেই তা হতো, তা হলে পৃথিবীতে বর্তমানে সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তিই সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। আমাদের সন্তানকে বিনয়ের সঙ্গে ন্যায়-অন্যায় বোধ শেখালে, পরিবারের মধ্যে ছোট-বড় যেই অন্যায় করুক, প্রতিবাদ-প্রতিহত করা শেখালে এমন প্রতিবাদহীন প্রজন্ম তৈরিই হতো না। পরিবারই তাকে সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে প্রতিবাদ না করার সংস্কৃতির শিক্ষা দেয় বলে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর অন্যায়কেও অন্যায় বলার মতো সাহস এবং ইচ্ছে কোনোটাই আর কাজ করে না। ফলে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি এখানে চালু করা যায়নি। বরং উচ্চপদস্থ কেউ যা করবে তাই মুখ বুজে মেনে নেয়ার, এটিই হওয়ার ছিল, ভেবে রায় দেয় মজ্জাগত স্বভাব থেকেই। ‘যত মত, তত পথ’ জীবনের এ সহজ সত্যটিকে তারা গ্রহণ করতে পারেননি। আমরা সন্তানকে কথা বলা শেখার পর পরই ছড়া শেখাই – ‘পড়াশোনা করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে।’ সন্তানকে ছোট থেকেই প্রলুব্ধ করা হয়, তুমি পড়াশোনা করবে শিক্ষা অর্জনের জন্য নয় বরং গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ার জন্য। তুমি পড়াশোনা করবে ভালো চাকরি করার জন্য, অন্যকে অধীনস্থ করার জন্য।
সাহিত্যপাঠের গল্প-উপন্যাসগুলো মানবিকবোধের উন্মেষের জন্য নয়, লাইন টু লাইন মুখস্থ করানো হয় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য। শিক্ষা শিক্ষিত হওয়ার জন্য নয়, জ্ঞানের আলোয় নিজেকে আলোকিত করার জন্য নয়, শিক্ষা এখানে অর্থ উপার্জনের নিয়ামক মাত্র, মনের আঁধার দূর করার উপাদান নয়। জন্ম থেকে যারা পড়াশোনা করেছেন গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ার জন্য, ভালো চাকরির জন্য, সার্টিফিকেট পাওয়ার পরই তারা একটা চাকরি আশা করবেন এবং চাকরি না পেলে হতাশ হবেন, ডিপ্রেশনে ভুগবেন, আত্মহননের পথ বেছে নেবেন, এটাই সহজ-স্বাভাবিক গাণিতিক হিসাব। এই হতাশ প্রজন্মই যাদের জীবনের মানেই শেখানো হয়েছে ক্যারিয়ারের সফলতার মাপকাঠিতে, টাকা উপার্জনের মেশিন হিসেবে, বাস্তবে যখন তা সে পাচ্ছে না, তখন সে হতাশায় নিমগ্ন হবে এবং ব্যাপকভাবে অন্যায়ের পথে পা বাড়াবে। অর্থ উপার্জনই যদি হয় সফলতার মাপকাঠি, তবে তা যে উপায়েই হোক সৎ অথবা অসৎ তাতে তার বিবেকে এতটুকু নাড়া দেয়ার কথা নয়। ফলে দেশে শুধু সার্টিফিকেটধারী চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যার সংখ্যা ক্রমবর্ধমান, কিন্তু শিক্ষিত মানুষ তৈরি হচ্ছে না। আমরা যদি সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত না বানিয়ে ছোট বেলা থেকেই সন্তানদের শেখাতাম শিক্ষা অর্জন করো, জ্ঞানের ক্ষুধা থেকে, জীবনকে জানার জন্য। ভালো মানুষ হলে, প্রায়োগিক জ্ঞান থাকলে যে কোনো কিছু করেই সৎ পথে উপার্জন সম্ভব, তা হলে এই বেকার সার্টিফিকেটধারী প্রজন্ম তৈরি হতো না। আমাদের সন্তানরা এখন আর আদর্শবান হয় না,দুর্নীতিতে প্রথম হয়। সন্তানকে আমরা এখন কোনো আদর্শবান মানুষের গল্প শোনাই না, সমাজসেবীদের গল্প শোনাই না, শোনাই টাকাওয়ালা সফলদের গল্প। আমাদের মনে রাখা উচিত, সন্তানরা উপদেশ নয়, অনুকরণে শেখে। শিক্ষা বিষয়টির মূল শর্তই হলো তা স্বতঃস্ফূর্ত হওয়া জরুরি। নতুন প্রজন্মের মধ্যে যেন আবেগের বিকাশ ঘটে, তারা যেন মানবিক হয়ে ওঠে, অন্যের মতকে গুরুত্ব দিতে শেখে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতার চর্চা করতে পারে তা আমাদেরকেই নিশ্চিত করতে হবে।
জন্মের পরই মানুষ তার অস্তিত্ব নিয়ে সচেতন হয়ে যায়। তার ক্ষুধা, তৃষ্ণা,কামনা,বাসনা ইত্যাদি নিয়ে সে অবস্থান করে এক স্বার্থপর সত্তা হিসেবে। ‘স্বাধীনতা’, ‘সার্বভৌমত্ব’, ‘মানবিকতা’ এবং এসবের মতো অন্যান্য মানবিক সত্যকে একজন মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে গ্রহণ করে সত্য কিন্তু তারপরেও তার মনে কী যেন নেই,আরো বেশি হলে ভালো হতো, পৃথিবী এক শূন্যতা ছাড়া কিছু নয়’, ‘জীবনের অর্থ নেই’, এমন সব চিন্তা-ভাবনা আসে। এমন চিন্তা-ভাবনাকে ‘মনস্তাকি ফেনমেনা বা চেতনচিত্র’ বলা যায়।
জার্পল সার্ত্রে এবং আলবার্ট ক্যামুকে অস্তিত্ববাদী সাহিত্যতত্ত্বের মূল প্রবক্তা বলা হয় এবং তারা মনে করতেন, মানুষ এই অপরিচিত পৃথিবীতে অবস্থান করছে এক নির্বাসিত বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসেবে আর এই পৃথিবীতে প্রকৃত সত্য,মূল্যবোধ কিংবা জীবনের অর্থ বলে কিছু নেই। মানুষ শুধু এক ধরনের শূন্যতা থেকে জীবন শুরু করে। ক্রমাগতভাবে শূন্যতা পার করে মৃত্যুকে তুলে নেয়। আমরা যাকে ‘অস্তিত্ব’ বলি তা আসলে এক ধরনের যন্ত্রণা,অথবা বলা যায় এই ‘অস্তিত্ব’ এক ধরনের অবাস্তব কল্পনা মাত্র।
সার্ত্রে তার অস্তিত্ববাদী চিন্তার এক পর্যায়ে এসে এমনও উচ্চারণ করেন,জীবনের কোনো অর্থ নেই, উদ্দেশ্য নেই,শূন্যতা নিয়ে বেঁচে থাকাই জীবন। দার্শনিক কিয়ের্কেগার্ড সার্ত্রে বা ক্যামুর মতো ‘নাস্তিক’ ছিলেন না,তার অস্তিত্ববাদে অর্থহীন শূন্যতার জীবনকে ঈশ^রের কাছে সমর্পণ করার কথা আছে। আমরা আমাদের জীবন ও সাহিত্যে অস্তিত্ববাদী এই শূন্যতা আর অর্থহীনতাকে খুঁজে পাব। চেতনচিত্রবাদের প্রবক্তা ছিলেন দার্শনিক এডমুন্ড হুসার্ল। তার মতে, যেসব বিষয় বা ঘটনা অবশ্যম্ভাবী নয় সেগুলোকে আমাদের চৈতন্য থেকে বাদ দিতে হবে এবং যা বাস্তব,যা আবশ্যিকভাবে ঘটছে, তা চেতনচিত্র হিসেবেই উপস্থিত। ‘সুর্য পূর্ব দিকে ওঠে পশ্চিমে ডোবে’, এই সত্য যেমন একটা ফেনমেনা,ঠিক তেমনিভাবেই মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া সত্যগুলো অবশ্যম্ভাবী সত্য হয়েই উপস্থিত।
মানুষের ‘মন’ নামক ধরাছোঁয়ার বাইরে এক অস্তিত্ব আছে, আর মনের চেতন ও অচেতন ঘরে বন্দি হয়ে আছে মানুষের সত্তা, অস্তিত্ব,সজ্ঞা,সংবেদ ইত্যাদি ভাষার এক গোলকধাঁধাসহ। ফ্রয়েড, পাভলভ, ইয়ুং, লাকাঁ প্রমুখ মনস্তাত্ত্বিক/ভাষাবিজ্ঞানী মনের কপাট খুলে আমাদের দেখিয়েছেন, ভাষা দিয়ে সৃষ্ট মানুষের মন তার যে কোনো কার্য এবং কার্যের কারণকে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে ‘অহং এবং ‘অতি-অহং’কে অস্বীকার করে মানুষের অনেক সামাজিক আদিম প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারে। এই আদিম প্রবৃত্তি যখন কোনো আর্থসামাজিক কারণে ‘অবদমিত’ হতে বাধ্য হয়, তখন তা ভাষারূপেই অবস্থান নেয় মনের ‘অচেতন’ কোটরে।
প্রত্যেক মানুষের একটি নিজস্ব মনের জানালা আছে। এই জানালা দিয়ে সে নিজেকে দেখে, প্রকৃতি দেখে,পরিবেশ দেখে,আকাশ, পাতাল, পৃথিবী আর বিশ^ব্রহ্মা- দেখে। এই জানালা, যাকে আমরা চেতনা-কাঠামো বা প্যারাডাইম বলতে পারি, তার বিস্তার আর অবস্থান সম্পর্কে খুব সহজেই আমরা কোনো নির্দিষ্ট সত্যকে তুলে ধরতে পারি না। জাগতিক বাচাল ভাষায় যুক্তি দিয়ে যখনই আমরা একজন মানুষের জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে বিশ্লেষণ করতে যাই, ঠিক তখনই আমাদের ব্যক্তিগত অহং নিজস্ব সত্তার আবরণ মাখিয়ে দেয় যে কোনো প্যারাডাইমিক বিশ্লেষণে, আর তার ফলে সমগ্রের মাঝেই বারবার ঘুরে ফিরে আসে অহংয়ের উপস্থিতি।
একজন নিঃসঙ্গ মানুষ তাই শুধুমাত্র তার নিজস্ব জানালা নিয়েই বিবর্তিত হতে থাকে দেশ-কাল-মাত্রার এই পৃথিবীতে। একজন ব্যক্তিমানুষের ব্যক্তিগত জানালার ছবি সমগ্রের সম্পদ নয়, এই সত্য-মূল্যই আমাদের প্যারাডাইমে অবস্থান করে। তবুও এ কথাই সত্য যে, আমরা আমাদের নিজস্ব ভাষা ও চিন্তায় জানালা খুলে বারবার দেখতে চেয়েছি ব্যক্তি ও সমগ্রের বিশ^কে। দেকার্তের কাজিটো বা ‘আমি’, আমার নিজস্ব জানালা নিয়েই হয়ে উঠছে অস্তিত্বশীল। ‘আমি’র জানালা খুলে বিচিত্র চিত্র দেখার জন্যেই সৃষ্টি হয়েছে ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতির, আর লাকাঁ উন্মোচন করতে চেয়েছেন মানবিক চৈতন্যের অস্তিত্ববাদী সমস্যা ও চরিত্রকে।
মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যখন অনেকের মনেই আর আলাদা কোনো আবেগ কাজ করে না, তখন গোপাল চন্দ্র শীল নামের একজন মানুষ কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান জানান,সে খবর ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে গোপাল চন্দ্র শীলের সেলুনের সাইনবোর্ডেই বড় বড় অক্ষরে লেখা : এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ফ্রি চুল কাটা হয়।
গোপালের এই সেলুনে চুল কাটাতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সিরিয়াল লাগে না। অসুস্থ কিংবা বয়সের ভারে ন্যুব্জ যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রয়োজনে তাঁদের বাড়িতে গিয়েও চুল-দাড়ি কেটে দেয়া হয়। তবে সব বীর মুক্তিযোদ্ধা যে বিনা মূল্যে চুল কাটাতে আসেন,তা নয়, খুশি হয়ে গোপালকে আশীর্বাদ জানাতেও আসেন অনেকে। গত ২০ বছরে গোপাল এক হাজার মুক্তিযোদ্ধার চুল-দাড়ি বিনা পয়সায় কেটেছেন। তাঁদের নাম,ঠিকানা,স্বাক্ষর ও মুক্তিযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার কথাও টুকে রেখেছেন একটি স্মারক বইয়ে। রণাঙ্গনের বীর যোদ্ধাদের খন্ড খন্ড অভিজ্ঞতার এক অসামান্য দলিল হয়ে উঠেছে স্মারক বইটি। এখন তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ছবিও সংগ্রহ করছেন। অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাই গোপালের প্রশংসা করে বইটিতে নানা কিছু লিখেছেন।
বছর বিশেক আগে একজন বয়স্ক মানুষ গোপালের সেলুনে এসে জানতে চেয়েছিলেন, চুল-দাড়ি কাটাতে কত লাগবে? ১৫ টাকা লাগবে শুনেই মানুষটি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, কেন যে দেশটা স্বাধীন করলাম! লোকটির মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় জেনে গোপালের মনে বিষয়টি গভীর দাগ কাটে। তিনি তখনই আজীবন বিনে পয়সায় মুক্তিযোদ্ধাদের চুল-দাড়ি কাটার সিদ্ধান্ত নেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃখ-দুর্দশার খবর এখনো সংবাদপত্রে বের হয়। সবার সব কষ্ট মোচনের দায়িত্ব সরকারের ওপর দিয়ে আমরা সবাই নির্ভার থাকতে চাই। অথচ দেশ স্বাধীন না হলে আজ যাঁরা বিশাল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন, তাঁদের অনেকেই হয়তো নিঃস্বই থাকতেন। গোপাল যেমন তাঁর অবস্থান থেকে একটি ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, অন্যরাও যদি নিজ নিজ অবস্থা ও অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীদের প্রতি ভালোবাসা দেখাতেন,তাহলে কতই না ভালো হতো।
বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকালে আমরা পাওয়া না-পাওয়ার হিসাবের খাতা খুলে বসেছি। একাত্তরে সাতপাঁচ না ভেবেই বীর যোদ্ধারা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বলেই তো আজ এই বিজয়।
লেখক : এম এ কবীর, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক,কলামিস্ট ও সভাপতি,ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি,ঝিনাইদহ)
বুদ্ধিমান ব্যক্তি এক পায়ে চলেন আর এক পা স্থির রাখেন। ছয়মাস চিকিৎসার পর এক ধনী মহিলা ডাক্তারকে বললেন, আপনার চিকিৎসার উপর আমার বিন্দুমাত্র বিশ^াস নেই। তাহলে প্রতি সপ্তাহে আপনি আমার কাছে আসেন কেন? আমার ফিসইবা দেন কেন? আমি আমার বিষয়ে অনেক কথা লোককে বলতে চাই। একমাত্র আপনিই আমার কথা ধৈর্য্য সহকারে শোনেন।
রাজধানীর কদমতলীর একটি বাসা থেকে এক দম্পতি ও তাদের মেয়ের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ঘুমের ওষুধ খাইয়ে, হাত-পা বেঁধে শ^াসরোধ করে তাদের হত্যা করা হয়। এমন পারিবারিক ও সামাজিক হত্যাকান্ড প্রায়ই গণমাধ্যমে খবর হয়ে আসে। একটি ঘটনার নৃশংসতা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আরেকটিকে। এসব কেবল আইনশৃঙ্খলার অবনতির দৃষ্টান্তই নয়,সামাজিক অসুস্থতারও লক্ষণ। এসব ঘটনা বলে দেয় মানুষের নৈতিক স্খলন, লোভ ও হিংস্রতার ভয়াল রূপের কাছে টিকতে পারছে না সামাজিক কিংবা পারিবারিক বন্ধন। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, সামাজিক বন্ধনে চিড় ধরা, অস্থিরতা ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব-টানাপড়েনে আপনজনকে খুনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর পেছনে উল্লেখযোগ্য কারণ, হতাশা, পরকীয়া, আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমে যাওয়া, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবে পারিবারিক বন্ধন ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই অপরাধ এখন পরিবারে ঢুকে পড়েছে। সমাজে ভোগবাদী প্রবণতা বাড়াও এর একটি কারণ। সমাজের একাংশ এতটাই ভোগবিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত যে, এই সমাজে পারিবারিক কাঠামো থাকলেও তা নামমাত্র। কোনো ধরনের স্বাভাবিক বোঝাপড়া তাদের মধ্যে নেই। চাহিদা এবং প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান বাড়ছে তো বাড়ছেই।
গণতান্ত্রিক সমাজে আইনের শাসন, মানবাধিকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইনের উদ্দেশ্য জনগণের কল্যাণ। তবে সব সময় সর্বক্ষেত্রে আইন ন্যায়বিচার ও নীতির উপর অটল থাকে না। মানুষ নিজকে সভ্য করার চেষ্টা করেছে আদিকাল থেকে যা এখনও নিরন্তর। সময়ের ভাষাজ্ঞান,পরিসংখ্যান ও তথ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে তাদের দুরদর্শিতা ছিল না। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সব সময় ক্ষতিগ্রস্ত হতো। সে যুগের মানুষকে বর্বর,অসভ্য ভাবা হতো। তবে তারা অমানবিক ছিল না। সামাজিক নীতিশাস্ত্র একটি ধারণা, যা ব্যক্তির নৈতিক আচরণ, বাস্তবতা এবং ব্যক্তিত্বের সংমিশ্রণের সাথে সম্পর্কিত।
মূল্যবোধের দীনতা এবং নৈতিকতার বিচ্যুতি সমাজে ঘটে যাওয়া ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় পরিবার ও সমাজের দায়। আমাদের বিপরীতমুখী যাত্রার প্রবণতা ও বাসনা।
সমাজের সকলেই উচ্চাভিলাষী-চাকচিক্যময় জীবন উপভোগ করতে চায়। মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি হলো পারস্পরিক সুখ-দুখের সঙ্গী হয়ে সহযোগিতা সহানুভূতি ভালোবাসা প্রীতি আবেগকে পুঁজি করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখা।
যে সমাজে সুদ ঘুষকে ঘৃণার চোখে দেখা হতো,যে সব লোক এসবের সাথে সম্পৃক্ত ছিল সমাজের অন্যরা তাদের সাথে মেলামেশায় দূরত্ব বজায় রাখত, তারা গ্রামে অনেকটা এক ঘরে বসবাস করত। সময়ের পরিক্রমায় এসবের উৎস না খুঁজে অবলীলায় তাদের সাথে অভিযোজন ঘটিয়ে অজান্তেই সুদ ঘুষকে বৈধতা দিয়ে এসবের চর্চায় মগ্ন মানুষ। ইগো, দ্বন্দ্ব নানাভাবে জেঁকে বসেছে। সিদ্ধান্ত গ্রহনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার মতামতকে পায়ে পিষে নিজের দৈন্যতা এবং দাম্ভিকতার প্রভাবে কর্তাব্যক্তিদের মিথ্যার আশ্রয় নিতে হচ্ছে।
মানুষ জীবনব্যাপী শিক্ষা লাভ করে। এমন কি মৃত্যু অবধি ভুলকরে, শেখে। পারিবারিক আবহে শিশুরা যে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সবক পায় তা পরবর্তী জীবনে চলার বাতিঘর হিসেবে কাজ করে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বপ্ন বাসনা এবং ব্যস্ততার সুযোগে আমরা পারস্পরিক ভালোবাসা,আন্তরিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছি।
মূল্যবোধ ও নৈতিকতার গুণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এ তকমা এবং লকবটুকু আজ প্রশ্নবিদ্ধ। হেন অনিয়ম, স্বার্থপরতা এবং পাপাচার নেই যার সাথে মানবকূলের সম্পর্ক নেই। নৈতিকতার বিচ্যুতি, সামাজিক বন্ধনের শিথিলতা, রীতি নীতি নিয়ম প্রথার যথার্থ অনুশীলনের ঘাটতির সুবাদেই এসব হচ্ছে।
পারিবারিক বন্ধন, ভালোবাসা, শাসন, পরিচর্যা, মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার মাঝেই এ দৈন্যতার অবসানের স্বপ্ন দেখা যেতে পারে। মুনাফেকি আচরণ, চাটুকারিতা, কারসাজি এবং দালালি প্রবণতা যেন আমাদের অস্থি- মজ্জায় বাসা বেঁধেছে, যার প্রভাবে সাদাকে সাদা বলার পরিবর্তে নানা রঙ্গে ভূষিত করছি। অবলীলায় দেখেও না দেখার ভানকরে নিজেদের বিপদ ডেকে আনছি। শিক্ষক, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক স্ব স্ব অবস্থানে থেকে সত্য বলতে পারছে না। বলতে চায় না। বলার সাহস পায় না। অনেকে ঝামেলা ভেবে এড়িয়ে যায়। ভয়ঙ্কর বিষয় হলো আইনের প্রতি বিশ^াস হারানো। এটি ঘটলে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে থাকে। সমাজে নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়ে।
মানুষের কাছে এখন চাহিদা পূরণই আসল বিষয়। কিভাবে পূরণ করা হলো সেটা মুখ্য বিষয় নয়। নৈতিকতা আর মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে মানুষ তার আকাঙ্খা পূরণে সামনে কোনো বাধা এলেই হত্যাকে বেছে নিচ্ছে সহজ পথ হিসেবে। ভোগবাদিতা,অধিক পাওয়ার আকাঙ্খা, সবকিছুতে তীব্র প্রতিযোগিতা, অনিয়ম, অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা, নৈতিকতা চর্চার অভাব,সমাজে ছড়িয়ে পড়া অন্যায়-অনাচারের কম বেশি শিকার সবশেণির মানুষ।
আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান তার গাড়ির চালক দুই সঙ্গীসহ হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেলেন। নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে পরিবারের সদ্যরা প্রশাসনের দরজায় ধর্ণা দিয়ে সহযোগিতা পায়নি। একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কয়েক বছরে গুম, নিখোঁজ হওয়া কেউ কেউ জীবন নিয়ে ফিরে আসে পরিবারের কাছে, কেউ লাশ হয়ে। কারও আবার সন্ধান মেলেনি।
২০১০ সালের ২৫ জুন রাতে ঢাকা সিটি করপোরেশনের রমনা-শাহবাগ এলাকার সাবেক কমিশনার চৌধুরী আলম নিখোঁজ হন। ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল মধ্যরাতে ঢাকা থেকে গাড়ির চালক আনসারসহ নিখোঁজ হন সিলেট-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এম. ইলিয়াস আলী। ২০১৩ সালে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাজা পাওয়া দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার অন্যতম সাক্ষী সুখরঞ্জন বালি। পরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার দমদম কারাগারে বন্দি অবস্থায় সন্ধান মেলে। ২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাতে ঢাকা থেকে নিখোঁজ হন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমদ। নিখোঁজের দুই মাস পর ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং এ সন্ধান মেলে তার।
ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার জেরে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ কে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে হত্যা করা হয়।
২০২০ সালের ১০ মার্চ হাতিরপুলের নিজ পত্রিকা কার্যালয়ের সামনে থেকে নিখোঁজ হন ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল। ৫৩ দিন পর বেনাপোল সীমান্তের কাছে থেকে তাকে আটক করে বিজিবি। তবে শফিকুল ইসলাম কাজল সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘বেনাপোলে ছেড়ে দেয়ার আগ পর্যন্ত ৫৩ দিন আমার চোখ বাধা ছিল, মুখ আটকানো ছিল আর হাতে ছিল হ্যান্ডকাফ।’ ২০১৭ সালের ৩ জুলাই ঢাকার শ্যামলীর আদাবরের নিজ বাড়ি থেকে ভোর পাঁচটার দিকে কলামিস্ট, লেখক ফরহাদ মজহারকে অপহরণ করা হয়। এর ১৮ ঘন্টা পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে যশোরের অভয়নগরে একটি বাস থেকে উদ্ধার করে।
আবু ত্ব-হা আদনানের পরিবার থেকে বরাবরই বলে আসা হচ্ছে, তিনি কোনো রাজনৈতিক দল বা ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নন। কেন তারা বারবার এমন কথা বলছেন? একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভিন্নমত থাকাটাই স্বাভাবিক। এর আগে ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া আটক নেতা রাশেদের মা ও স্ত্রীকে এই এমনই কথা বলতে শোনা গেছেÑ রাশেদ বা তার পরিবারের কেউ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। এমন কথা কী প্রমাণ করে, ভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন বা দল করা অপরাধ?
পরীমণি বাংলাদেশের এই সময়কার জনপ্রিয় ও আলোচিত অভিনেত্রী। তার উপর শারীরিক নির্যাতন হয়েছে; তাকে ধর্ষণ, হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। পরীমণির এই ঘটনায় সংবাদকর্মীরাসহ সমাজের তথাকথিত প্রগতিশীল ও নারীবাদীদের একটি বিরাট অংশ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সবাই ন্যাক্কারজনক ঘটনার সুষ্ঠু বিচার প্রত্যাশা করেন। রাজধানীর গুলশানে ভাড়া বাসায় মারা যান কলেজছাত্রী মোসাররাত জাহান মুনিয়া। মুনিয়ার মৃত্যুর কারণ হিসেবে তার বড় বোন নুসরাত জাহান বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে অনেক দেনদরবার করে আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা করেন।
মুনিয়ার ঘটনা চাপা পড়ে যাচ্ছে। আনভীর ইতোমধ্যে দেশের ঐতিহ্যবাহী ও দেশসেরা একটি ক্রীড়া সংগঠনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। পুলিশের চোখে আনভীর পালাতক থাকলেও বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ক্র্যাব) নেতারা ঠিকই তাকে খুঁজে বের করে অভিনন্দন জানিয়েছেন। মুনিয়ার মৃত্যুর পর দেশের সাংবাদিক,সংবাদমাধ্যম, প্রগতিশীল ও নারীবাদীদের ভেতর বিরাট পরিবর্তন দেখা গেল। এ ঘটনার পর তারা সুখনিদ্রায় চলে যান। মুনিয়াও যে পিতা-মাতাহারা একজন মুক্তিযোদ্ধার অসহায় অল্পবয়সী মেয়ে তা তারা কোনোভাবেই লেখায় আনতে পারেননি। আনভীরে বাবার টাকা যেন সবাইকে স্মৃতিশক্তিহীন বানিয়ে ফেলে। আজ দেখাযাচ্ছে অনেক নারীবাদীরা পরীমণির জন্য কত করুণা করে কলম ধরছেন, প্রতিবাদে ফেটে পড়ছেন। পরীমণির সঙ্গে যদি অন্যায় হয়ে থাকে তার প্রতিবাদ অবশ্যই করতে হবে, শতবার করতে হবে, হাজারবার করতে হবে।
টেলিভিশনের টকশোতে জনৈক নারী সাংবাদিককে নিয়ে মন্তব্য করেন দেশের একজন খ্যাতনামা আইনজীবী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারে সাবেক উপদেষ্টা। এরপর দেশের প্রগতিশীল মানুষের মনে ক্ষোভের জন্ম হয়। মন্তব্যকারীকে জেলে যেতে হয়। গত বছর দেশে করোনার ভয়াবহতার সময় সাংবাদিক স্বামী প্লাবন কর্তৃক নির্মম নিগ্রহের শিকার হন দৈনিক সমকালের নারী সাংবাদিক সাজিদা ইসলাম পারুল। পারুলের পক্ষে তার প্রতিষ্ঠান দাঁড়ালেও পারুলকে নিজের বিচার পাওয়ার জন্য নিজেকেই সবকিছু করে অবশেষে থমকে যেতে হয়।
মধুপুরের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এক নারীকে বর্বরভাবে ধর্ষণ করে তিন মদ্যপ। আমরা ক’জন ওই ধর্ষণের শিকার নারীর খবর রেখেছি, প্রতিবাদ করেছি? এতদিন জনসাধারণ জানতেনÑ দেশে ন্যায্য বিচার নেই। এখন যতটুকু ন্যায়বিচার হচ্ছে, সেটির মধ্যেও বৈষম্য ঢুকে গেছে। দেশের হাজারো নির্যাতিতা,ধর্ষিতা আছেন- থানা-আদালত ঘুরতে ঘুরতেই বছরের পর বছর পার হয়ে যায়, কোথায় গেলে সুবিচার পাবেন, এটি জানতে জানতে মামলা খারিজ হয়ে যায়।
২০১৭ সালে গাজীপুরের শ্রীপুরে হজরত আলী নামের এক বাবা তার পালিতা শিশুকন্যা আয়েশাসহ ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। আয়েশা ধর্ষিত হয়, মামলা করতে গেলে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। মুরারিচাঁদ কলেজের ধর্ষণকান্ড, ফেনীর নুসরাত হত্যা, সাব-রেজিস্ট্রারের ছেলে দিহানের লাগামহীন জীবন এবং কদমতলী ট্রাজেডি কিসের ইঙ্গিত বহন করে? নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলায় স্বামীর সামনে স্ত্রীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। ১২ জুন পত্রিকার সংবাদে জানা যায় ঘটনার ৯ দিন পার হয়ে গেলেও কোনো আসামি গ্রেফতার হয়নি।
একজন জনপ্রিয় নায়িকার সুবিচার পেতে বিলম্ব হচ্ছে না, কিন্তু সাধারণের বেলায় এমনটা কেন হয়? কত নির্যাতিত, ধর্ষিত যে পরী না হওয়ার কারণে ন্যায়বিচার পান না- পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই স্পষ্ট।
নড়াইল থেকে পিরোজপুর, এরপর খোদ রাজধানীর রাজরাণী। সামসুন্নাহার স্মৃতির পরীমণি হয়ে ওঠার গল্পের রয়েছে হাজারও প্লট। এক জীবনে এত পাওয়া, আলোচনা সংসদে, টকশো,গানে,গল্পে,কবিতায়,সিনেমা-নাটক তো নিজের বাড়ি-ঘর। কোথায় নেই পরীমণি। তাই তিনি আশির্বাদ হয়ে উঠুন ভাগ্যবঞ্চিত সাধারণমণিদের ভাগ্যফেরাতে।
লখেক : এম এ কবীর,সভাপতি,ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ আব্দুর রাজ্জাক, নির্বাহী সম্পাদক: মোঃ বাবর আলী বাবু, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : মোঃ পলাশ রহমান, যুগ্ম-সম্পাদক : মোঃ সোহেল রানা, বিশ্ব কোরআন-হাদীস প্রচার কেন্দ্র ফোন: ০১৭১৬- ২৯৭৮৮৫ © ২০১৯ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | simantabani.com বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ বিশ্ব কোরআন-হাদীস প্রচার কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় সদর দপ্তর* পোষ্ট অফিস রোড, মহেশপুর, ঝিনাইদহ । মোবাইলঃ- সম্পাদক- ০১৭১৬- ২৯৭৮৮৫, সম্পাদকীয় কার্যালয় : ই-মেইলঃ simantabani@yahoo.com : simantabani@্gmail.com