অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হলো। সারা বছর জুড়ে আলোচনায় ছিল দেশের বিভিন্ন স্থানে মব সন্ত্রাস, ভুয়া বা মিথ্যা মামলা এবং চাঁদাবাজির ঘটনা। বিভিন্ন ঘটনায় ১ লাখ ৭৬ হাজার ৭৮৮টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে ব্যক্তিগত আক্রোশ, শত্রুপক্ষকে হয়রানি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন, সম্পত্তি থেকে ওয়ারিশদের বঞ্চিত করাসহ নানা কারণে দায়ের হয়েছে সহস্রাধিক ভুয়া বা মিথ্যা মামলা।
একই সময়ে সারা দেশে মব সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ২৭০টি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এদিকে গত এক বছরে নানান দাবি-দাওয়া নিয়ে ঢাকার রাজপথে তিন শতাধিক আন্দোলন হয়েছে। ন্যায্য-অন্যায্য, যৌক্তিক-অযৌক্তিক দাবি আদায়ে অনেক পেশাজীবী সংগঠন, শিক্ষার্থী, শ্রমিক, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ আন্দোলন করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এসব আন্দোলন সামাল দিতে বেগ পেতে হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা ও মব সন্ত্রাসকে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা বলে মনে করেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তবে মিথ্যা মামলা থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মুক্তি দিতে ফৌজদারি কার্যবিধির সংশোধন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। গত ৩১ জুলাই বিকালে সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। গত এক বছরে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে যেসব কাজ হয়েছে, সংবাদ সম্মেলনে সেসব তুলে ধরে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘মিথ্যা মামলা নিয়ে আমার বিরক্তি ও আপত্তি বহুবার প্রকাশ করেছি। বারবার আপনাদের বলি, আমাদের সরকারের আমলে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক যে দুটি ঘটনা ঘটেছে, একটা হচ্ছে মিথ্যা মামলা, মামলা হতে পারে, কিন্তু মিথ্যাভাবে লোককে ফাঁসানো, মানে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা; আরেকটা হচ্ছে মব জাস্টিস। এই দুইটা আমাদের খুবই পীড়িত করে।’
সহস্রাধিক ভুয়া মামলা : গত এক বছরে দেশে কতগুলো ভুয়া বা মিথ্যা মামলা দায়ের হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। কারণ এই ধরনের তথ্য সাধারণত আলাদাভাবে সংরক্ষণ করা হয় না। তবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সূত্রে ভুয়া মামলা দায়েরের অভিযোগ এবং এ সংক্রান্ত কিছু ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এতে সহস্রাধিক ভুয়া মামলা প্রাথমিকভাবে শনাক্ত হয়েছে। সরকার ও পুলিশের পক্ষ থেকে নিরপরাধ ব্যক্তিদের গ্রেফতার বা হয়রানি না করতে নির্দেশনা দেওয়া হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা ছিল উপেক্ষিত। তদন্তে মামলার অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের বিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে এটি বড় কারণ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর অধিকতর সংশোধন করে প্রণীত অধ্যাদেশ জারি করে গত ১০ জুলাই গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। ফলে তদন্ত চলাকালে অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নিরপরাধ মানুষকে ভুয়া মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুযোগ তৈরি হলো।
থামানো যাচ্ছে না মব সন্ত্রাস : দেশে নতুন এক আপদ ও আতঙ্কের নাম ‘মব সন্ত্রাস’। গণপিটুনি, চাঁদাবাজি, দখল, রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা ও ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে টার্গেট করে পরিকল্পিতভাবে ‘মব সন্ত্রাস’ তৈরি করা হচ্ছে। লুটপাট ও হত্যায় ব্যবহার করা হচ্ছে বিক্ষুব্ধ জনতার ‘মব’ ফাঁদ। মব সন্ত্রাসের ফাঁদে ফেলে এক শ্রেণির সুবিধাভোগীরা আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগরে চুরির অভিযোগে মা, ছেলে ও মেয়েকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। গাজীপুরে হূদয় নামের এক যুবক, ঢাকায় আল আমিন এবং সিরাজগঞ্জে এক মানসিক প্রতিবন্ধীসহ গত ছয় দিনে ছয় জন এই সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন। সারা দেশেই মব ফাঁদে বাড়ছে অস্থিরতা।
সামাজিক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে চলা মব সন্ত্রাসের অধিকাংশই পরিকল্পিত। হত্যাকারীরা জনতাকে উসকে দেয়, যাতে হত্যার দায় স্পষ্টভাবে কারো ওপর না পড়ে। এতে একদিকে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা যায়, অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিভ্রান্ত করে মূল হোতারা দায় এড়িয়ে যায়। শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষই নয়, ব্যক্তিগত বিরোধে আপন ভাইকে মব তৈরি করে ফাঁসানোর ঘটনাও ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের মামলায় শাস্তির নজির নেই বললেই চলে। ফলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগাচ্ছে আরেক অপরাধী চক্র; গণপিটুনির ফাঁদে ফেলে মারধর ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। এ ধরনের অপরাধে জড়িতদের কঠোর আইনগত ব্যবস্থার মুখোমুখি করতে হবে। সেসঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা এসব কাজে জড়িত থাকলে দল থেকে বহিষ্কারসহ নির্মোহ কঠোর পদক্ষেপই গণপিটুনির মতো ঘটনা কমিয়ে আনতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
লাগামহীন চাঁদাবাজি : খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছে না। দুর্বৃত্তরা প্রকাশ্যে রাস্তার ধারে বর্বরতা চালিয়ে জ্যান্ত মানুষকে হত্যা করতে দ্বিধা করছে না। ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ চাঁদাবাজদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। অনেকে ভয়ে মুখ ফুটে পুলিশের কাছেও অভিযোগ করতে পারছে না। কারণ অভিযোগ করলেই প্রাণ হারাতে হতে পারে চাঁদাবাজ চক্রের কাছে। বিভিন্ন স্থানে জিম্মি থাকা মানুষ তাই আতঙ্কের সঙ্গে বসবাস করছে। ‘সমন্বয়ক’ পরিচয় দিয়ে মব সৃষ্টি করেও চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। গত ২৭ জুলাই রাতে রাজধানীর গুলশানে সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদার বাকি অংশ নিতে আসা তরুণরা পুলিশি ফাঁদে ধরা পড়েন। চাঁদাবাজির প্রতিবাদে ভুক্তভোগীরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছে বিভিন্ন স্থানে। গত ৯ জুলাই পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল সংলগ্ন সড়কে প্রকাশ্যে দুর্বৃত্তরা মো. সোহাগ ওরফে লাল চাঁদ নামের এক ব্যবসায়ীকে বর্বরতা চালিয়ে হত্যা করে। ঐ হত্যাকাণ্ডে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি হয়। এর আগে গত ২৮ মে ঢাকার মিরপুরে নাজমুল হাসান পাপ্পু ও দোলনা নামের এক দম্পতিকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়। গত ৮ মে রাজধানীর বাড্ডায় ঠিকাদার আনোয়ার হোসেন, গত ১৫ মে একই থানার গুদারাঘাট এলাকায় বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল আহসান সাধনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট পরিবারের যে ক্ষতি হয়, তা পূরণ হওয়ার নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী আরো তত্পর হলে হত্যার ঘটনা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তা না হলে এভাবে হত্যার ঘটনা বাড়তেই থাকবে।
রাজধানীতে সংঘটিত গত ছয় মাসের ২১৭টি হত্যাকাণ্ড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এর বেশির ভাগ রাজনৈতিক কারণে ঘটেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। পুলিশ এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয়। গত রবিবার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।
এক সপ্তাহ আগে ঢাকার মোহাম্মদপুর-আদাবরে চাঁদাবাজির প্রতিবাদে মানববন্ধন ও মিছিল করে স্থানীয় শিক্ষক সমাজ। কর্মসূচিতে অংশ নেন ৭০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। তারা বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছেও নিয়মিত চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। প্রতিবাদ করলে সন্ত্রাসীরা হুমকি দিচ্ছে। সাভার-বিরুলিয়া আঞ্চলিক সড়কে মানববন্ধন করেন চার শতাধিক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। জাতীয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সংস্থা শপিং কমপ্লেক্সের (অন্ধ মার্কেট) আয়োজনে এই কর্মসূচিতে তারা অভিযোগ করেন, দোকান মালিকদের চাঁদা না দিলে দোকান দখলের ভয় দেখানো হয়। অনেকেই এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। গত ১২ জুলাই ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়কের বাইপাস মোড়ে কয়েক শ সাধারণ মানুষ মানববন্ধনে অংশ নেয়। তারা জানায়, এখন এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে, চাঁদাবাজরা বাড়িতে গিয়ে চাঁদা চায়। না দিলে শুরু হয় হুমকি ও হয়রানি। চট্টগ্রামের বাঁশখালীর মুহুরী প্রজেক্ট এলাকায় দেশের অন্যতম বৃহত্ মত্স্য প্রকল্পটি এখন চাঁদাবাজদের কবলে। গত ২১ জুন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত চাষি ও এলাকাবাসী মানববন্ধন করে বলে, ৫ আগস্টের পর থেকে তারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। নিয়মিত চাঁদা দিতে না পারলে মাছ চাষে বাধা দেওয়া হয়, এমনকি মাছ চুরি বা পুকুরে বিষ প্রয়োগের ঘটনাও ঘটেছে। ময়মনসিংহেও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশে মানববন্ধন করেছে ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। গত ২৩ জুন আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় সাধারণ ব্যবসায়ী ও পরিবহন শ্রমিকরা মানববন্ধন করেন। চিহ্নিত চাঁদাবাজদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানান তারা।
রাজপথে যত আন্দোলন : জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে ঢাকার রাজপথে আন্দোলন এখন নিত্যদিনের চিত্র। কৌশল হিসেবে আন্দোলনকারীরা যে যেভাবে পারছেন, সেখানেই বসে পড়ছেন। কথায় কথায় চলেছে সড়ক অবরোধ। একদিনে সর্বোচ্চ ১৭টি জায়গায় অবরোধের ঘটনাও ঘটেছে। কারো দাবি চাকরি স্থায়ীকরণ, কেউ চান সরকারিকরণ। বদলি নিয়োগ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা ইস্যুতে হয়েছে আন্দোলন। এমএলএসএস থেকে শুরু করে বাদ যাননি ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তারাও। অটোরিকশা থেকে অটোপাশ, আনসার থেকে পুলিশ। বিসিএস থেকে বিডিআর কিংবা শ্রমিক; আন্দোলন যেন থামছেই না। কিছু আন্দোলনের উত্তাপ দেশ জুড়েও ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনকারীদের নিয়ন্ত্রণ ও নির্বিঘ্ন যান চলাচল নিশ্চিতে পুলিশও ছিল অসহায়। সড়ক আটকে বিক্ষোভ-আন্দোলন করায় রাজধানীতে যানজট আরো তীব্র হয়, মানুষের ভোগান্তি-কষ্ট বাড়ে কয়েক গুণ।