অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : বাংলাদেশের অক্সিজেন ভান্ডার বলা হয় সুন্দরবনকে। কিন্তু দখল, নদীভাঙন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসহ নানা কারণে বনের আয়তন কমতে কমতে এখন এক তৃতীয়াংশে দাঁড়িয়েছে। এজন্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বনের ওপর আর নির্যাতন নয়, সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে এই বন একসময় হারিয়ে যাবে, সেইসঙ্গে হুমকিতে পড়বে বাংলাদেশের অস্তিত্ব।
ভূ-তত্ত্ববিদরা বলছেন, সুন্দরবনের আয়তন দিন দিন কমে যাচ্ছে। আয়তন কমে আসায় সুন্দরবনের প্রতিবেশ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কমে আসছে গাছগালা, লতাগুল্ম ও প্রাণী। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে সুন্দরবন দুর্বলও হয়ে পড়ছে।
২০২০ সালে বিশ্বব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে সুন্দরবনের আয়তন কমে আসার কিছু তথ্য প্রকাশ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুন্দরবন ও বনসংলগ্ন এলাকার মানুষের টিকে থাকার বিষয়ে প্রতিবেদনটি করা হয়েছিল।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ১৯০৪-২৪ সালে সুন্দরবনের আয়তন ছিল ১১ হাজার ৯০৪ বর্গকিলোমিটার। ১৯৬৭ সালে তা কমে হয় ১১ হাজার ৬৬৩ বর্গকিলোমিটার। ২০২১ সালে আয়তন কমে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৫০৬ বর্গকিলোমিটারে। ২০১৫-১৬ সালে আয়তন ছিল ১১ হাজার ৫০৬ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ গত ১০০ বছরে সুন্দরবনের আয়তন ৪৫১ বর্গকিলোমিটার কমে গেছে।
দিন দিন সুন্দরবন ছোট হচ্ছে বলে জানালেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) মোংলা অঞ্চলের আহ্বায়ক মো. নুর আলম শেখ। কেন ছোট হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সুন্দরবনের ভেতরে মানুষ প্রতিনিয়ত দখল নিয়ে ঘরবাড়ি, হাট-বাজার তৈরি করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীভাঙনের মধ্যে সুন্দরবন ছোট হয়ে আসছে। এজন্য সুন্দরবন রক্ষায় সরকারকে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। একইসঙ্গে সুন্দরবনে মানুষের প্রবেশ ঠেকিয়ে বন রক্ষাকারী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও কঠোর হতে হবে।’
বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবন প্রতিনিয়ত আমাদের রক্ষা করছে বলে জানিয়েছেন সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ও প্রাকৃতিক সব দুর্যোগে নিজেকে বিলিয়ে আমাদের জন্য রক্ষাকবচ হয়ে ওঠে সুন্দরবন। এই সুন্দরবনের মাধ্যমে বায়ু দূষণ যেমন পরিশোধিত হচ্ছে, তেমনি বিশুদ্ধ বায়ু শোধনের সুযোগও তৈরি হচ্ছে। এই বন উপকূলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার অনিবার্য অংশও বটে। বন থেকে মধু, গোলপাতা, মাছ, কাঁকড়াসহ নানা কিছু আহরণ করেন পেশাজীবীরা। তাই সুন্দরবন সুরক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।’
সুন্দরবনের মধ্যে ছোট-বড় অসংখ্য নদী ও খাল রয়েছে। পানির মতো বিছানো এসব খাল-নদীর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার। এসব নদী-খাল দিনে দুবার জোয়ারের পানিতে ভরে যায়, আবার দুবার ভাটায় পানি নেমে যায়। জোয়ার-ভাটার কারণে নদীর পাড় ভাঙে আবার গড়ে। তবে ১০০ বছরে দেখা গেছে, ভাঙনই বেশি। যা আজও ঠেকানো যায়নি।
এজন্য সুন্দরবন না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না বলে জানালেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘সুন্দরবন না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না এই সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই। ম্যানগ্রোভ বেঁচে থাকলে, তা শক্তিশালী দেয়াল হয়ে দাঁড়াতে পারবে ঘূর্ণিঝড়ের সামনে। এছাড়া পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখতে এই বনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’
সুন্দরবন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সুন্দরবন কারও ব্যক্তি সম্পদ নয়, কোন দফতর কিংবা মন্ত্রণালয়েরও নয়। এই বন সবার মায়ের মতো। তাই সবাইকে আপন ভেবে ভালোবেসে এই বনকে রক্ষা করতে হবে।
পূর্ব সুন্দরবনের করমজল পর্যটন কেন্দ্র ও বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, ‘সুন্দরবনের জন্য বড় হুমকি জলবায়ু পরিবর্তন এবং কিছু মানুষের বনের ওপর নির্যাতন। একসময় বনের গাছপালা কাটা হতো, এখন সেসব নাই। তবে বিষ দিয়ে মাছ ধরার কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি হচ্ছে। এই নির্যাতন অব্যাহত থাকলে একসময় সুন্দরবন থাকবে না। তাই এই বন বাঁচিয়ে রাখতে শুধু ১৪ ফেব্রুয়ারি বন দিবস পালন করলে হবে না, সবাইকে বন সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। মিলেমিশে আপন ভেবে ভালোবেসে সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হবে।’
Leave a Reply