অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : তোষাখানা-কাণ্ডে পাকিস্তানের রাজনীতিতে এখন কার্যত টালমাটাল অবস্থা। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে এই সংক্রান্ত মামলা নিয়ে বেশ জোরেশোরেই এগিয়ে নিচ্ছে শেহবাজ সরকার। আর এই মধ্যে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তোষাখানা উপহারের রেকর্ড প্রকাশ করেছে দেশটির ফেডারেল সরকার।
রোববার (১২ মার্চ) প্রকাশ করা এই রেকর্ডে ২০০২ সাল থেকে দেশটির সকল সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের পাওয়া উপহারের তথ্য রয়েছে। সোমবার (১৩ মার্চ) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০২ সাল থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত সরকার প্রধানদের পাওয়া উপহারের বিষয়ে ৪৪৬-পৃষ্ঠার রেকর্ড প্রকাশ করা হয়েছে। এই রেকর্ডে নওয়াজ শরিফ, ইমরান খান, আসিফ আলি জারদারি, শহীদ খাকান আব্বাসি এবং জেনারেল (অব.) পারভেজ মোশাররফসহ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীদের প্রাপ্ত উপহারের বিবরণ রয়েছে।
রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান হিসেবে পাওয়া এসব উপহার ন্যূনতম বা কোনো মূল্য পরিশোধ না করেই তাদের অনেকেই নিয়ে গেছেন বলে রেকর্ডে বলা হয়েছে।
দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল বলছে, রোববার প্রকাশিত ওই রেকর্ডে দেখা গেছে ২০০২ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফই একমাত্র শাসক যিনি তোষাখানা থেকে কোনো দামী বস্তু বা গহনা-শ্রেণীর উপহার রাখেননি এবং সেগুলো ফিরিয়ে দিয়েছেন।
তোষাখানা-কাণ্ডের তালিকায় নাম রয়েছে সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শওকত আজিজ, ইউসুফ রাজা গিলানি, নওয়াজ শরিফসহ ইমরান খানের। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ এবং প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি কী কী উপহার পেয়েছেন সেটিও এই তালিকায় উল্লেখ রয়েছে।
মজার বিষয় হলো- নওয়াজ শরিফ, শহীদ খাকান আব্বাসি, আসিফ আলি জারদারি এবং শেহবাজ শরিফকে একটি ঘড়ি, এক জোড়া কাফলিঙ্ক, একটি কলম এবং একটি আংটি-সহ অলঙ্কার-জাতীয় সেট উপহার দেওয়া হয়েছিল।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে উপহার দেওয়া বিখ্যাত মক্কা ডিজাইনের ঘড়িতেও একই ধরনের সেট ছিল। প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় নওয়াজ শরিফের তোষাখানা বিভাগকেও একই ধরনের সেট উপহার দেওয়া হয়েছিল।
একইভাবে, নওয়াজ শরিফের স্ত্রীও অলঙ্কার-শ্রেণির একটি উপহার নিয়েছিলেন যার মূল্য ছিল (নওয়াজ শরিফের সরকারের আমলেই) ৫৪ মিলিয়ন রুপিরও বেশি।
তোষাখানা রেকর্ড অনুসারে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে উপহার দেওয়া একটি হাতঘড়ির মূল্য ১৪০ মিলিয়ন রুপি এবং এটি এখন সাধারণ জনগণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে প্রদর্শিত হচ্ছে। এছাড়া এন্টিক ডিজাইনের কাফলিঙ্ক এবং অন্যান্য গহনার পাশাপাশি অন্য সকল দামী উপহারও এখন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে প্রদর্শন করা হয়।
সর্বশেষ প্রকাশিত এই রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে, আসিফ আলি জারদারি তোষাখানা থেকে ১৮১টি, নওয়াজ শরিফ ৫৫টি, শহীদ খাকান আব্বাসি ২৭টি, ইমরান খান ১১২টি এবং জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ১২৬টি উপহার নিয়েছিলেন।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসিফ আলি জারদারি দায়িত্বপালন করার সময় তিনি যে সব উপহার পেয়েছিলেন তা তিনি নিজের কাছেই রেখেছেন। রেকর্ড অনুযায়ী, নিজের পাঁচ বছরের মেয়াদে ২০০২ থেকে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসাবে জারদারি সবচেয়ে বেশি উপহার পেয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বপালনের সময় ২০০৮ সালে ১৭টি, ২০০৯ সালে ১৫টি, ২০১০ সালে ৯৪টি, ২০১১ সালে ৩৫টি, ২০১২ সালে ১৬টি এবং ২০১৩ সালে চারটি উপহার নিজের কাছে রেখে দেন জারদারি।
রেকর্ড অনুযায়ী, জারদারি বেশিরভাগ উপহারই বিনামূল্যে নিয়েছিলেন এবং যেগুলো বাড়িতে নিয়েছিলেন তার জন্য ১০ শতাংশ বা তারও কম অর্থ প্রদান করেছিলেন।
এই নথিতে কোন বছর মোট কতগুলো উপহার পাকিস্তান পেয়েছে সেটিও তুলে ধরা হয়েছে। নথি অনুসারে, ২০২২ সালে ২২৪টি, ২০২১ সালে ১১৬টি, ২০১৮ সালে ১৭৫টি, ২০১৪ সালে ৯১টি, ২০১৫ সালে ১৭৭টি উপহার পেয়েছেন পাকিস্তানের শীর্ষ নেতৃত্ব।
প্রকাশিত রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন নওয়াজ শরিফ ৫৫টি উপহার নিজের কাছে রেখে দেন। এর মধ্যে ২০১৩ সালে আটটি, ২০১৪ সালে তিনটি, ২০১৫ সালে ২৪টি এবং ২০১৬ সালে এবং ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত হওয়ার আগপর্যন্ত নওয়াজ শরিফ চারটি করে উপহার নিজের কাছে রেখে দেন।
এছাড়া সফরে থাকার সময় নওয়াজ শরিফ তোশাখানা বিভাগ থেকে একটি গহনার বাক্স পেয়েছিলেন যার মূল্য ছিল ৪১ মিলিয়ন রুপি। নওয়াজ শরিফ সেটির ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মূল্য দিয়ে উপহারটি নিয়ে যান।
অন্যদিকে শহীদ খাকান আব্বাসি তার পাওয়া সব উপহার বাড়িতে নিয়ে গেছেন। রেকর্ড অনুযায়ী, আব্বাসির পরিবার এবং তার স্ত্রী ও ছেলেরা গয়না উপহার পেয়েছিলেন। সেই সময় শহীদ খাকান আব্বাসির স্ত্রীকে উপহার দেওয়া একটি গহনা সেটের মূল্য ধরা হয়েছিল ১০০ মিলিয়ন রুপি। আব্বাসির পরিবারের অন্য সদস্যরা ২০ মিলিয়ন রুপিরও বেশি মূল্যের উপহার নিয়ে গিয়েছিলেন।
এছাড়া আব্বাসি এবং তার পরিবার ২০১৭ সালে নয়টি উপহার এবং ২০১৮ সালে ১৮টি উপহার নিয়েছিলেন। অন্যদিকে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ২০০২ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার মেয়াদকালে মোট ১২৬টি উপহার নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন।
এসব উপহার সেই সময়ে মূল্যায়নকৃত মোট মূল্যের ১৫ শতাংশে রেখে দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ২০০২ সালে মোশাররফ ৭০ টি উপহার রেখে দেন। একইভাবে ২০০৩ সালে ৪টি, ২০০৪ সালে ১৮টি, ২০০৫ সালে আটটি, ২০০৬ সালে ১৬টি, ২০০৭ সালে আটটি এবং ২০০৮ সালে দু’টি উপহার নিজের কাছে রেখে দেন তিনি।
রেকর্ড অনুযায়ী, ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্বপালনের সময় ইমরান খান ১১২টি উপহার নিয়েছিলেন। মূলত এসব উপহার ইমরান নিজে এবং তার স্ত্রী পেয়েছেন। নিজের কাছে রাখা উপহারের মধ্যে রয়েছে ইমরান এবং তার স্ত্রী বুশরা বিবিকে দেওয়া তিনটি ঘড়ি ও অন্যান্য উপহার।
Leave a Reply