24 Nov 2024, 05:45 pm

সৌদি আরবের মধ্যস্থতায় সুদানে দুপক্ষের বৈঠক

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : আফ্রিকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় দেশ সুদানে লড়াইরত দুই পক্ষকে মীমাংসা বৈঠকে বসাতে সক্ষম হয়েছে সৌদি সরকার। সুদানে কীভাবে বেসামরিক শাসন ফিরিয়ে আনা হবে, মূলত তা নিয়েই সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং আধা-সামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) প্রধান মোহাম্মদ হামদান হেমেডটি দাগালোর দ্বন্দ্ব থেকে এই লড়াইয়ের সূত্রপাত। তবে সম্প্রতি তারা দুজনের তাদের প্রতিনিধিদের রিয়াদে পাঠিয়েছেন বলে জানা গেছে।

শনিবার থেকে তারা সেখানে সৌদি সরকারের মধ্যস্থতায় মুখোমুখি বসে কথা বলতে শুরু করেছেন। এর মধ্যে গত তিন সপ্তাহে সুদানে প্রায় ৬০০ মানুষ নিহত হয়েছে। এছাড়া আরও কয়েক লাখ মানুষ আশপাশের দেশগুলোতে পালিয়ে গেছে।

কয়েক হাজার বিদেশী নাগরিককে যুদ্ধজাহাজ এবং যুদ্ধ বিমান পাঠিয়ে উদ্ধার করে আনা হয়েছে। আফ্রিকার সাহেল এবং হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলটি এমনিতেই বহুদিন ধরেই যুদ্ধ-বিগ্রহে বিপর্যস্ত। সুদানের সংঘাত দীর্ঘায়িত হলে পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা আরো ভঙ্গুর হয়ে পড়বে বলে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

সুদানের এই লড়াইকে এরই মধ্যে অনেকেই পুরাদস্তুর গৃহযুদ্ধ বলে বর্ণনা করতে শুরু করেছেন। আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং সেই সঙ্গে পূর্ব এবং হর্ন অব আফ্রিকার আঞ্চলিক জোট ইগাড শুরু থেকেই মীমাংসার চেষ্টা করছে। কিন্তু আফ্রিকার নতুন এই যুদ্ধ বন্ধে সবচেয়ে তৎপর হয়েছে সৌদি আরব।

অন্য সব পক্ষের তুলনায় সৌদির মধ্যস্থতার উদ্যোগ এক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। একদম শুরুতে ইগাড জোট মীমাংসার উদ্যোগ নেয়। তারা দুপক্ষকে সাউথ সুদানের রাজধানীতে বসার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি।

কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে সুদানের বিবাদমান দুই পক্ষই সৌদি আরবের মধ্যস্থতা নিয়ে আগ্রহী। কারণ সুদান ও সৌদি আরবের সম্পর্কের ঐতিহাসিক একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে। এক অর্থে সুদান অনেকটাই ব্যতিক্রমী একটি দেশ। এটি আফ্রিকার দেশ কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো এদেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি, বিশেষ করে সৌদি আরব।

সুদান একই সঙ্গে সাহেল, হর্ন অব আফ্রিকা এবং লোহিত সাগর অঞ্চলের অংশ। কিন্তু তারপরও সুদানের সমাজ ও রাষ্ট্রের একটি বড় অংশের বিশেষ করে আরবি ভাষাভাষী সুদানি শাসক এবং অভিজাত শ্রেণীর সঙ্গে উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর ঐতিহাসিকভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বের প্রধান শরিক ছিল সুদান। বহু সুদানি সৈন্য এবং আরএনএফ মিলিশিয়া ইয়েমেনে যুদ্ধ করেছে। যে চারটি দেশের মধ্যস্থতায় গত বছর সুদানে সামরিক শাসন থেকে বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে চুক্তি হয়েছে তাতে আফ্রিকার কোনো দেশ না থাকলেও রয়েছে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত।

সৌদি আরব এবং সেই সঙ্গে আরব আমিরাত মনে করে সুদানের নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক সংস্কারের প্রকল্পটি তাদের। সুতরাং এই প্রকল্প ভেস্তে যাক সেটা তারা কোনোভাবে চায়না।

ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছাড়াও সুদানের সংঘাত নিয়ে সৌদি আরবের বিশেষ তৎপরতার পেছনে প্রধানত রয়েছে তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ। একই কথা আরব আমিরাতের বেলাতেও প্রযোজ্য।

কেন সৌদি সুদান নিয়ে এত উদ্বিগ্ন? সোজাসাপ্টা উত্তর হলো, এর পেছনে রয়েছে তাদের রাজনৈতিক, নিরাপত্তাজনিত স্বার্থ। সৌদি আরব বা আরব আমিরাত কোনোভাবেই চায়না সুদানে যাতে ইসলামপন্থী কোনো সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আরব বসন্ত অর্থাৎ গণবিক্ষোভের জেরে সরকার পতনের পর যেসব আরব দেশে নির্বাচন হয়েছে – যেমন মিশর, তিউনিসিয়া সব জায়গায় ইসলামপন্থীরা ক্ষমতা নিয়েছিল।

এতে ঘাবড়ে গিয়েছিল সৌদি আরব এবং আরব আমিরাত এবং অভিযোগ রয়েছে সেসব সরকারের পতনের পেছন থেকে কাজ করেছে এই দুই দেশ। এ কারণে গণবিক্ষোভের ভেতর দিয়ে ওমর আল বশিরের পতনের পর সুদানে কোনো নির্বাচন হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়ে সৌদি আরব এবং আমিরাত নির্বাচনের বদলে একটি অন্তর্বর্তীকালীন অনির্বাচিত সরকার বসাতে সক্ষম হয়।

হেমেডটির সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েনের মাঝে জেনারেল বুরহান কিছুদিন আগে হুমকি দিয়েছিলেন তিনি নির্বাচন দিয়ে দেবেন যেটা সৌদি এবং আমিরাতকে হয়তো উদ্বিগ্ন করে তুলছে। স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, এই লড়াইয়ে জেনারেল বুরহানের অনুগত বাহিনী হেমেডটির বাহিনীকে বেশ চাপে ফেলেছে।

ফলে সৌদি এবং আমিরাত হয়তো ভয় পাচ্ছে এই লড়াইয়ে যদি হেমেডটি হেরে যায় তাহলে জে বুরহান হয়তো নির্বাচন দিয়ে দেবেন এবং সেই নির্বাচনে ইসলামপন্থীরা জিতবে। সামি হামদি মনে করেন, প্রধানত সে কারণে সৌদিরা মধ্যস্থতা করতে উঠেপড়ে লেগেছে যেন হেমেডটির আরএসএফ টিকে থাকতে পারে।

সুদান থেকে পাওয়া বিভিন্ন খবরেও বলা হচ্ছে আরএসএফ মিলিশিয়ারা লড়াইতে বেশ চাপে পড়েছে। রিয়াদে এই মীমাংসা বৈঠক আয়োজনের জন্য সৌদি আরব এবং আমেরিকাকে বিশেষ অভিনন্দন জানিয়েছেন হেমেডটি।

তবে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, শুধু রাজনৈতিক বা কৌশলগত স্বার্থই নয়, সুদানের এই সংঘাতকে সৌদি আরব তাদের নিজেদের উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক পরিকল্পনার জন্য হুমকি হিসেবে মনে করছে। কারণ, তেল সম্পদ ছাড়াই অর্থনৈতিক উন্নয়নের যেসব প্রকল্প ক্রাউন প্রিন্স মোহামেদ বিন সালমান নিয়েছেন তার অনেকগুলোই লোহিত সাগর উপকূল ঘেঁষে।

৫০০ বিলিয়ন ডলারের অত্যাধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক শহর নিওম সিটিও সেখানে। এই এলাকা সুদানের লোহিত সাগর উপকূল থেকে বেশি দূরে নয়। এই মুহূর্তে সৌদি যেটা একেবারেই চায়না তা হলো লোহিত সাগরের উপকুলে আরেকটি সিরিয়া। সৌদির পররাষ্ট্রনীতির গবেষক আজিজ আলঘাসিয়ানকে উদ্ধৃত করে এমনটাই জানিয়েছে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষণাধর্মী সাময়িকী মিডল ইস্ট আই।

সৌদি ভয় পাচ্ছে সুদানের সংঘাত আশপাশের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়লে লোহিত সাগর উপকূলে তাদের প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ আকর্ষণ কঠিন হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া ২০১৯ সালে বশিরের উৎখাতের পর প্রাকৃতিক সম্পদ এবং কৃষিতে সমৃদ্ধ সুদানে পা রাখার সুযোগ হয় সৌদি আরবের।

গত বছর তারা সুদানের কৃষি এবং খনিজ সম্পদ উন্নয়নে ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতও তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ নিয়ে উদ্বিগ্ন। ইয়েমেনের সোকোটরা বন্দর থেকে হর্ন অব আফ্রিকার সোমালি-ল্যান্ড পর্যন্ত সাগরপথে বাণিজ্যিক নৌ পরিবহনের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে চাইছে তারা।

ডিসেম্বরে আবুধাবি বন্দর কর্তৃপক্ষ পোর্ট অব সুদানের ২০০ মাইল উত্তরে একটি নতুন বন্দর নির্মাণে ৬০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের একটি চুক্তি করেছে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 13880
  • Total Visits: 1293750
  • Total Visitors: 4
  • Total Countries: 1668

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ রবিবার, ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
  • ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)
  • ২১শে জমাদিউল-আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরী
  • এখন সময়, বিকাল ৫:৪৫

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
    123
252627282930 
       
15161718192021
293031    
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018