সীমান্তবাণী রিপোর্ট : ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনার অপহরণ ও হত্যা মামলার নাটের গুরু ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে জিঞ্জাসাবাদের জন্য ৮ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ। ঐ হত্যাকান্ডে লেনদেনকৃত দুই কোটি টাকার মধ্যে মহেশপুর থেকে টাকা প্রদানকারী মিন্টুর দুই শিষ্য মহা টেনশনে পড়েছে। রিমান্ডে গুরু যদি শিষ্যদের নাম বলে দেয়। কারণ এক শিষ্যতো গুরুর নাম বলে দেওয়ায় হত্যাকান্ডের মোটিভ রাতারাতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অপহরণের পর খুন হন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। এমপি আনারকে অপহরণ ও হত্যার পুরো বিষয়টি মনিটরিং করছিলেন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি হওয়ার খায়েশ জন্মানো সাইদুল করিম মিন্টু। এ ঘটনায় গ্রেফতারদের জবানবন্দি ও তাদের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন খতিয়ে দেখে হত্যাকাণ্ডে মিন্টুর সংশ্লিষ্টতার তথ্য মিলেছে।
বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) রিমান্ড শুনানিতে এসব কথা বলেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। রিমান্ড শুনানি চলাকালে বিচারক মিন্টুকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কিছু বলবেন?’ মিন্টু তখন বলেন, ‘আমি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। এমপি নির্বাচনে মনোনয়ন চাওয়াটাই আমার অপরাধ।’
এর আগে এদিন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মিন্টুকে হাজির করে পুলিশ। এরপর মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন ডিবি পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান। তবে তার আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে মিন্টুর ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রিমান্ড আবেদনে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, গ্রেফতার সাইদুল করিম মিন্টু (৬০) কে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। এছাড়া এমপি আনার অপহরণ মামলার অন্যতম আসামি শিমুল ভুইঁয়া ওরফে শিহাব ওরফে ফজল মোহাম্মদ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তার জবানবন্দিতে আসামি সাইদুল করিম মিন্টুর সংশ্লিষ্টতা বর্ণিত আছে। জবানবন্দিতে ভিকটিমকে প্রলুব্ধ করে অপহরণ তথা হত্যার সঙ্গে আর্থিক লেনদেন বিষয়ে সাইদুল করিম মিন্টুর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। এছাড়া এমপি আনার অপহরণে সাইদুল করিম মিন্টুর সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন পুলিশ রিমান্ডে থাকা আসামি কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু।
অপহরণ ও হত্যার প্রমাণ হিসেবে মিন্টুকে এমপি আনারের ছবি পাঠানো হয়। হত্যার জন্য শিমুল ভুইঁয়ার দাবি করা টাকার আংশিক গত ২৩ মে দেওয়ার কথা ছিল মিন্টুর।
মিন্টুর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলেন শাহীন : রিমান্ড আবেদনে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, আসামি শিমুল ভুইঁয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানিয়েছেন- চলতি বছরের ৫ বা ৬ মে এমপি আনারকে প্রলুব্ধ করে অপহরণ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীন হোয়াটসআ্যাপে কথা বলেন সাইদুল করিম মিন্টুর সঙ্গে। তারা এমপি আনার হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে কথা বলেন।
হত্যার প্রমাণ দেখাতে পাঠানো হয় ছবি : পুলিশ রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার বাবু জানান, এমপি আনারকে হত্যার পর শিমুল ভুইঁয়া টাকা লেনদের বিষয়ে সাইদুল করিম মিন্টুর সঙ্গে ডিজিটালি ও সরাসরি আলোচনা করেন। অপহরণ ও হত্যার প্রমাণ হিসেবে মিন্টুকে এমপি আনারের ছবি পাঠানো হয়। হত্যার জন্য শিমুল ভুইঁয়ার দাবি করা টাকার আংশিক গত ২৩ মে দেওয়ার কথা ছিল মিন্টুর।
বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন মিন্টু : প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার মিন্টুর কাছে জানতে চাওয়া হয়, এমপি আনার অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডে আরও কেউ জড়িত আছে কি না? তবে এ ব্যাপারে মিন্টু সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেন। মামলার ঘটনার সঙ্গে মিন্টুর সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি একেক সময় একেক তথ্য দেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর তিনি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
গত মঙ্গলবার বিকেলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে মিন্টুকে আটক করে ডিবি পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে এমপি আনার হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততা পাওয়ায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়।
এর আগে গত ২৩ মে সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, ফয়সাল আলী সাজী ওরফে তানভীর ভূঁইয়া ও সিলিস্তি রহমানকে এমপি আনার অপহরণ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। পরে দুই দফায় তাদের ১৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। ৩ জনই ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছেন।
গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থেকে ভারতে যান এমপি আনার। ওঠেন পশ্চিমবঙ্গে বরাহনগর থানার মণ্ডলপাড়া লেনে গোপাল বিশ্বাস নামে এক বন্ধুর বাড়িতে। পরদিন চিকিৎসক দেখানোর কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন তিনি। এরপর থেকেই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন আনোয়ারুল আজীম আনার।
বাড়ি থেকে বেরোনোর ৫ দিন পর ১৮ মে বরাহনগর থানায় আনোয়ারুল আজীম নিখোঁজের বিষয়ে জিডি করেন বন্ধু গোপাল বিশ্বাস। এরপরও খোঁজ মেলে না ৩ বারের এই এমপির। ২২ মে হঠাৎ খবর ছড়ায়, কলকাতার পার্শ্ববর্তী নিউটাউন এলাকায় সঞ্জীবা গার্ডেনস নামে এক আবাসিক ভবনের বিইউ ৫৬ নম্বর রুমে আনোয়ারুল আজীম আনার খুন হয়েছেন। ঘরের ভেতর পাওয়া গেছে রক্তের ছাপ। তবে ঘরে মেলেনি মরদেহ।
মামলার ঘটনার সঙ্গে মিন্টুর সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি একেক সময় একেক তথ্য দেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর তিনি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
এ ঘটনায় ২২ মে ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। মামলাটি অপহরণ মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়।
মামলার এজাহারে এমপির মেয়ে উল্লেখ করেন, ৯ মে রাত ৮টার দিকে আমার বাবা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের সংসদ সদস্য ভবনের বাসা থেকে গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন। ১১ মে ৪টা ৪৫ মিনিটে বাবার সঙ্গে মোবাইলে ভিডিও কলে কথা বললে বাবার কথাবার্তায় কিছুটা অসংলগ্ন মনে হয়। এরপর বাবার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও বন্ধ পাই। ১৩ মে আমার বাবার ভারতীয় নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে একটি মেসেজ আসে। মেসেজে লেখা ছিল ‘আমি হঠাৎ করে দিল্লি যাচ্ছি, আমার সঙ্গে ভিআইপি আছে। আমাকে ফোন দেওয়ার দরকার নেই। পরে ফোন দেবো’।
এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, আমরা বিভিন্ন জায়গায় বাবার খোঁজখবর করতে থাকি। কোনো সন্ধান না পেয়ে বাবার বন্ধু গোপাল বিশ্বাস কলকাতার বরাহনগর পুলিশ স্টেশনে সাধারণ ডায়েরি করেন। বাবাকে খোঁজাখুঁজি অব্যাহত রাখি। পরে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানতে পারি অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে বাবাকে অপহরণ করে। বাবাকে সম্ভাব্য সব স্থানে খোঁজাখুঁজি করেও পাইনি।
এছাড়াও আরও কয়েকটি মেসেজ আসে। মেসেজগুলো বাবার মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অপহরণকারীরা করে থাকতে পারে, এজাহারে উল্লেখ করেন ডরিন।
যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষন করে যা পাওয়া যাচ্ছে তাতে এমপি আনার হত্যাকান্ডটি সংঘটিত হয়েছে শতকরা ৮০ ভাগ রাজনৈতিক কারণে ও শতকরা ২০ ভাগ ব্যবসাকে কেন্দ্র করে। সাম্প্রতিক নজরে আসা কিছু ভিডিও বিশ্লেষন করলে এটাই বোঝা যাচ্ছে। কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন ও দলীয় মনোনয়ন নিয়ে এমপি হওয়ার খায়েশ থেকেই এমপি আনারের উপর ক্ষিপ্ত ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু। এমপি আনারকে উদ্দেশ্য করে জনসভায় মিন্টু যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তা যদি কোন শিশুও শোনে তবে সে বলবে আনারের উপর মিন্টু শতভাগ ক্ষিপ্ত ছিলেন।
অন্যদিকে কালীগঞ্জের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সাইদুল করি মিন্টুর অযাচিত হস্তক্ষেপে এমপি আনারের সাথে তার যে মনোমালিন্য চলছিল তা দলের ৭৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষীকিতে এমপি আনারের বক্তব্যে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। (ভিডিও লিঙ্ক নিচে দেওয়া হলো।)
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু তার পথের কাটা সরাতেই টাকার বিনিময়ে আনারের এক সময়ের ব্যবসায়ীক পার্টনার ও বন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহীনকে কাজে লাগিয়ে এমপি আনারকে খুন করিয়ে লাশ গুম করেছে।
এদিকে বিশেষ গোপন সূত্র থেকে জানা গেছে, এমপি আনার হত্যাকান্ডের আগে কিলারদের সাথে যে দুই কোটি টাকার চুক্তি হয়েছিল সেই টাকার মধ্যে আটক নাটের গুরু মিন্টুর আশির্বাদপুষ্ট বেশ কয়েকজন শিষ্যর কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মহেশপুরের দুই আশির্বাদপুষ্ট শিষ্য উল্লেখযোগ্য একটি মোট অংকের টাকা সরবরাহ করেছে বলে জানাগেছে। মামলাটির তদন্তে কারা কারা টাকা সরবরাহ করেছে মিন্টুর কাছে জিঞ্জাসা করলে জানা যেতে পারে।
এরমধ্যে মহেশপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যে নেতার কোন নাম-গন্ধ ছিল না এবং সে সাইদুল করিম মিন্টুর আশির্বাদ নিয়ে এক লাফে গাছে উঠে মহেশপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের ভাইটাল পদ দখল করে মহেশপুর পৌরসভার চেয়ার দখল করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে । সে টাকা প্রদানের পাশাপাশি কিছুদিন আগে চিকিৎসার নামে বৈধ ও অবৈধ পথে ঘন ঘন কলকাতায় যাওয়ার বিষয়টিরও তদন্ত হওয়া দরকার। কারণ সে এমপি আনার হত্যার সাথে প্রতক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত কিনা সেটা খতিয়ে দেখা দরকার।
অন্যদিকে মহেশপুর উপজেলায় জন্মগ্রহণকারী ও দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানকারী এক নেতা যিনি সাইদুল করিম মিন্টুর কাধে ভর করে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের পদ দখল করেছেন এবং আগামীতে উপজেলা চেয়ারম্যানের চেয়ারে বসতে চাচ্ছেন তার টাকা সরবরাহ করার বিষয়টিও মিন্টুর জিঞ্জাসাবাদের সময় খতিয়ে দেখার দরকার।
মহেশপুরের ঐ দুই ব্যাক্তি যারা সাইদুল করিম মিন্টুর ঘাড়ে ভর করে সিনিয়রদের টপকে নেতা হয়েছে তারা মিন্টুর সব কাজে জি হুজুর বলে আগে থেকেই হাজির থাকে। এ থেকেই স্থানীয় জনগণের মনে সন্দেহ জাগছে।
Leave a Reply