22 Nov 2024, 08:22 am

কুমিল্লায় বিএডিসি খাল খনন ; অনাবাদি ও জলাবদ্ধ জমিতে বছরে ফলছে তিন ফসল

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের এক সময় জলাবদ্ধতা ছিল ‘অভিশাপের’ মতো। কচুরীপানা আর কোমর পানি ঠেলে ফসল ফলাতে হতো। কৃষক আতিকুল ইসলাম জানান, দুই বছর আগেও এখানে ছিল কোমর পানি। প্রায় সারা বছরই থাকত কচুরিপানা। চাষ করা যেত না। এ জলায় আউশ ধান হতো না। আমনও নষ্ট হয়ে যেত। কচুরিপানা সাফ করে শুধু বোরো চাষ করা যেত। সে জন্য বিঘাপ্রতি ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা দিতে হতো শ্রমিকদের।

তিনি বলেন, আমরা সেই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছি। বিএডিসি খাল খনন করায় জলাবদ্ধতা দূর হয়েছে। এখন বিস্তীর্ণ জমিজুড়ে আমন ধানের চাষ হচ্ছে।

কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলা সদর, বাকশীমুল, ষোলনল ও রাজাপুর ইউনিয়নের বিশাল অংশের কৃষকের কাছে এক সময় ‘দুঃখের’ নাম ছিল পয়াতের জলা। বুড়িচংয়ের বিস্তীর্ণ কৃষি মাঠ পয়াতের জলায় তিন একর জমি ছিল ওই এলাকার আব্দুল হকের। এ জমিতে পাঁচ বছর আগে আউশ ধান চাষ করেছিলেন তিনি। সে ধান পানিতে তলিয়ে যেত। বর্ষায় খাল উপচে জমি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এক ছটাক ধানও ঘরে তুলতে পারেননি এ কৃষক।

শুধু আব্দুল হকই নন, ওই এলাকার ৫ হাজার কৃষকের ১২ হাজার হেক্টর জমি ২০ বছর ধরে ডুবে ছিল। অবৈধ দখল ও অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণের ফলে অস্তিত্ব সংকটে ছিল এই খালটি। নিষ্কাশনের অভাবে পানি বের হতো না। ফলে কখনো জলাবদ্ধতা, কখনো সেচের অভাবে অনাবাদি থাকে জমি। ছিল কচুরিপানাসহ নানান আগাছা, ছিল জোঁকের উপদ্রবও। কৃষকের জন্য বিষফোঁড়া হিসেবে পরিচিত সেই পয়াতের খালে এখন প্রাণ ফিরেছে।

সরকার ২০১৯ সালে ৩৬৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ৫ বছর মেয়াদে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) কুমিল্লা-চাঁদপুর-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সেচ উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়। সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৩৪টি উপজেলাজুড়ে এ প্রকল্প চলবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। প্রকল্পের অধীনে খালটি দখলমুক্ত করে ২০২১ সালের শুরুতে ২৫ কিলোমিটার পুনঃখননের উদ্যোগ নেয় বিএডিসি। যে কারণ বুড়িচংয়ের পয়াতের জলায় এখন চারদিকে আউশের সোনালি আভা। বাতাসে ধানগাছের পাতা দোল খাচ্ছে আর ছড়াচ্ছে হালকা মিষ্টি সুবাস। ক্ষেতের একদিকে কৃষক ধান কাটছেন, আরেক দিকে চলছে ধান মাড়াই। খনন করা খালে মাছ ধরছেন কেউ কেউ। এসব অনাবাদী জমিতে ফলছে অন্তত ৩০ হাজার টন ফসল।

শুধু পয়াতেরজলাই নয়, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুরের ২৬ হাজার ৯৩৯ হেক্টর জমি সেচ সুবিধার আওতায় এসেছে। কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ৬১৭ কিলোমিটার মরা খাল খনন করা হয়েছে। ৪০ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও ১৯ কিলোমিটার ভ‚গর্ভস্থ ডেনেজ পাইপ নির্মাণ হয়েছে। ৪১২ কিলোমিটার ভ‚-গর্ভস্থ সেচনালা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া ৩০টি সৌরচালিত পাতকুয়া, ১১৪টি বিদ্যুৎচালিত এলএলপি, ৫০টি সাবমারসিবল পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এতে প্রকল্প এলাকায় প্রতিবছর ১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৯৫ টন অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে, যার সুফল ভোগ করছেন ১ লাখ ২০ হাজার ৭৯০ জন কৃষক।

কুমিল্লার চান্দিনার কাজীপাড়া খাল ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কানাইল খাল খনন করায় ২ উপজেলার প্রায় ৩ হাজার কৃষক উপকৃত হয়েছেন। অন্যদিকে দাউদকান্দির পাদুয়া ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কারণে আবাদে ফিরেছেন কয়েক হাজার কৃষক। বাঁধটি ঘিরে বর্ষায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া তিনটি গ্রামের যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হয়েছে।

এখন আর নৌকায় চলাচল করতে হয় না। দাউদকান্দির বড় হরিণা রামায়েতকান্দিতে ভ‚গর্ভস্থ ড্রেনেজ পাইপের কারণে কচুরিপানা ও জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়েছেন বেশ কয়েকটি গ্রামের কৃষক। চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার পালাখাল ইউনিয়নের মেঘদাইর গ্রামের দেড় কিলোমিটার সুন্দরী খাল ৫০ বছর ধরে সংস্কার না করায় পলি ও কাদা জমে ভরাট হয়েছিল। ফলে বর্ষার পানিতে ডুবে থাকত ওই এলাকার প্রায় ৪০০ একর কৃষিজমি। খালটি সংস্কার করায় হাসি ফুটেছে স্থানীয় কৃষককুলের মুখে। সঠিক সময়ে ফসল ফলানোর আশায় বুক বেঁধেছেন তারা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়নের সাতপাড়া এলাকায় ভরাট খাল খননের কারণে ১০০ বিঘা জমিতে পানি নিতে পারবেন কৃষকরা। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগে তিন জেলায় ১ লাখ ৫১ হাজার ৮৮৬ হেক্টর জমি চাষের আওতায় ছিল। খাল খনন ও সেচ সুবিধার কারণে এখন চাষের আওতা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৮২৫ হেক্টর। তিন জেলায় আগে প্রায় ২২ লাখ টন শস্য উৎপাদন হতো, তার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৯৫ টন।

২০ বছরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণের মাধ্যমে হাসি ফুটেছে লাখো কৃষকের জীবনে; দুঃখ-কষ্ট আর অভাব অনটন পার করে একবুক আশা নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তারা। দীর্ঘ অনাবাদি এ জমিতে ফলবে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৯৫ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য।

প্রকল্পটির প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে খাল পুনঃখনন, ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ, জলাবদ্ধতা দূরীকরণের জন্য অবকাঠামোসহ ভ‚-গর্ভস্থ ড্রেনেজ পাইপ লাইন নির্মাণ, বিদ্যুৎ চালিত লো লিফট পাম্প (এলএলপি) স্থাপন, সৌরশক্তি চালিত এলএলপি স্থাপন, ভ‚-গর্ভস্থ সেচনালা নির্মাণ, সেচ অবকাঠামো নির্মাণ, পানি সাশ্রয়ী স্প্রিংকলার ও গভীর সেচ পদ্ধতির প্রদর্শনী প্লট স্থাপন এবং কৃষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া।

প্রকল্প এলাকায় ইতোমধ্যে প্রায় ৬শ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল পুনঃখনন করা হয়েছে। যার মাধ্যমে প্রায় ২১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের পাশাপাশি ২৭ হাজার ৮০০ হেক্টর জমির জলাবদ্ধতা দূরীকরণের মাধ্যমে পরিপূর্ণ চাষের আওতায় নিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। খননকরা খালের পাড় রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, খালে চলছে মাছ চাষ ও হাঁস পালন; পাড়ে চলছে সবজি চাষ।

কুমিল্লা (ক্ষুদ্রসেচ) সার্কেলের তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী ও বিএডিসির কুমিল্লা-চাঁদপুর-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ভ‚উপরিস্থ সেচের পানির প্রাপ্যতা বাড়াতে ভরাট হয়ে যাওয়া খাল সচল করা জরুরি। আমরা ২০২০ সালের ড্রোন উড়িয়ে তিনটি জেলার খাল, জলাভ‚মি, ব্রিজ-কালভার্ট পর্যবেক্ষণ করেছি। কোথায় কোথায় জলাবদ্ধ বা পানি আটকে আছে তা চিহ্নিত করা হয়। সে অনুযায়ী অনবাদি জমিতে তিনটি ফসল ফলাতে যেখানে যা দরকার তা করেছি। এতে জমিগুলোর ফসল তিনগুণ বেড়েছে। সার্বিকভাবে দেশের খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় এসব জমি ভ‚মিকা রাখবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কুমিল্লার প্রকল্পটি সারাদেশের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। কারণ দেশের বিভিন্ন স্থানে নদীর নাব্য কমে যাওয়ায় পানির প্রবাহ কমে গেছে। অনেক খাল পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘কুমিল্লায়, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক সময়ের জলাবদ্ধ জমিতে সোনালি ফসলের ঝিলিক আমি সরেজমিন দেখে এসেছি। খাল খননের ফলে একদিকে জলাবদ্ধতা দূর হবে, অন্যদিকে শুকনো মৌসুমে খালের পানি সেচকাজে ব্যবহার করা যাবে, যা এ অঞ্চলের কৃষকদের ফসল ফলাতে আরও উৎসাহ জাগাবে।’

প্রকল্পের অধীনে সর্বশেষ গত ৫ নভেম্বর চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলায় দৃষ্টিনন্দন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। উপজেলা চত্বরে নির্মিত ‘মতলব ইউনিট অফিস কাম ট্রেনিং সেন্টার’ উদ্বোধন করে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম প্রকল্পের প্রশংসা করেন। এ সময় তিনি বলেন, এ প্রকল্পের কারণে তিন জেলার কৃষি বদলে গেছে। এ অঞ্চলে এক সময়ের অনবাদী জমিগুলো চাষের আওতায় এসেছে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 9184
  • Total Visits: 1266827
  • Total Visitors: 4
  • Total Countries: 1668

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ শুক্রবার, ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
  • ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)
  • ১৯শে জমাদিউল-আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরী
  • এখন সময়, সকাল ৮:২২

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
    123
18192021222324
252627282930 
       
15161718192021
293031    
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018