অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : গাইবান্ধা-৫ আসনের ভোটে অনিয়মে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারের (এসপি) সম্পৃক্ততা পেয়েছে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। ভোটে ডিসি-এসপির কী ধরনের ভূমিকা ছিল তার বিশদ বর্ণনা তদন্ত প্রতিবেদনে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া জেলার এডিসি জেনারেল, সাঘাটা উপজেলার ইউএনওর ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা মিলেছে। এডিসি (সার্বিক) নিজে সাঘাটা উপজেলা ইউএনও অফিসে উপস্থিত থেকে প্রিজাইডিং অফিসারদের ‘ভোট সুষ্ঠু হয়েছে’ মর্মে সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করেন। ইসির নির্দেশে কমিটির অধিকতর তদন্তে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা ইত্তেফাককে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
গাইবান্ধার অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে জানিয়ে নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বলেছেন, তদন্ত প্রতিবেদন পেয়েছি। তবে এটা নিয়ে আমরা কোনো আলোচনা করিনি। দু-এক দিনের মধ্যে এটা নিয়ে বসব। আশা করছি সামনের সপ্তাহে বিস্তারিত জানাতে পারব। আর ঘটনার সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে, অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ সময় তিনি বলেন, কিন্তু কী ব্যবস্থা হবে, কীভাবে নেওয়া হবে—এ বিষয়ে এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়। আলোচনা না করে এ বিষয়ে মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। গাইবান্ধায় যে ঘটনা ঘটেছে, সেটাকে বিচ্ছিন্ন উল্লেখ করে এই কমিশনার বলেন, ‘যেটা ঘটে গেছে, গেছে। তবে আমরা গাইবান্ধার মতো কোনো নির্বাচন আর চাই না।’ গত ১২ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ আসনে উপনির্বাচনে সবগুলো কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা দিয়ে ঢাকার নির্বাচন ভবন থেকে মনিটরিং করেন কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। ভোটে অনিয়ম ধরা পড়লে ভোটগ্রহণের চার ঘণ্টার মাথায় ১৪৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৫১টি ভোটকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরে ভোট শেষের দেড় ঘণ্টা আগেই এ ভোট বন্ধ ঘোষণা করে। বন্ধঘোষিত গাইবান্ধা-৫ আসনের ভোটে অনিয়ম তদন্তে গত ১৩ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন, ইসির যুগ্মসচিব কামাল উদ্দিন বিশ্বাস ও শাহেদুন্নবী চৌধুরী। নির্ধারিত সাত কার্যদিবসে নিজেদের তদন্ত কাজ শেষ করতে না পারায় অতিরিক্ত তিন দিনের সময় চেয়ে কমিশনের কাছে আবেদন করলে তা মঞ্জুর হয়। গত ২৭ অক্টোবর ইসির গঠিত তিন সদস্যের কমিটি গাইবান্ধার বন্ধঘোষিত ৫১টি কেন্দ্রের অনিয়ম তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেন। কিন্তু সেই প্রতিবেদনে সন্তুষ্ট হতে পারেনি ইসি। ফলে প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে গত ৫ নভেম্বর পুরো নির্বাচনে অনিয়ম তদন্তের নির্দেশ দেন সিইসি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল জানিয়েছিলেন, জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে আরও ৭-১০ দিন সময় লাগবে। খণ্ডিত প্রতিবেদন পেয়েছি, পুরোটার (সবগুলো ভোটকেন্দ্রের) তদন্ত প্রতিবেদন দরকার। আমরা ৫১ কেন্দ্রের বিষয়ে প্রতিবেদন পেয়েছি। বাকি ৯৪টি কেন্দ্রের বিষয়টি তো জানি না। তাই আরেকটি কমিটি গঠন করে দিয়েছি। তারা ঐ ৯৪টি কেন্দ্রের প্রতিবেদন সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে দেবে। তারপর আমরা সমন্বিত সিদ্ধান্ত নেব।
আগে ৬০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা পড়লেও এবার সেটির আকার দ্বিগুণ হয়েছে। কমিটির দীর্ঘ ঐ প্রতিবেদনে ভোট অনিয়মে কার কী ভূমিকা তার বিস্তারিত উল্লেখ আছে। ভোটে অনিয়ম ঠেকাতে ডিসি-এসপি কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখেননি। তাদেরকে ইসি থেকে বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও দায়সারা ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া ডিসির নির্দেশে এডিসি জেনারেল সুশান্ত কুমার মাহাতো নিজেই সাঘাটা ইউএনও অফিসে উপস্থিত থেকে ভোট নিয়ন্ত্রণ করেন।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, বন্ধঘোষিত ভোটকেন্দ্রের সংঘটিত অনিয়মসমূহ চিহ্নিত করতে সরেজমিনে গাইবান্ধার সাঘাটা ও ফুলছড়িতে গিয়েছিলেন কমিটির তিন সদস্য। দুই উপজেলার ১৪৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে সাঘাটায় ৮৮টি এবং ফুলছড়িতে ৫৭টি কেন্দ্র ছিল। কমিটির পক্ষ থেকে তদন্তের সময় সাত শতাধিক ব্যক্তিকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৬২২ জন কমিটির কাছে সাক্ষ্য দেন। কমিটি পোলিং এজেন্ট বা ভোটার ব্যতীত অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের গোপনকক্ষে প্রবেশ, গোপনকক্ষে ভোটদান, প্রত্যক্ষকরণ, ভোটারদের কোনো প্রার্থীকে ভোটদানে বাধ্যকরণ বা প্রভাবিতকরণ, মোবাইল ক্যামেরা দিয়ে গোপনকক্ষের ছবি ধারণ ইত্যাদি বিষয়ে প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করে দোষী/দায়ী ব্যক্তি চিহ্নিত করেছে। একই সঙ্গে দলীয় প্রতীক বা একই রঙের পোশাক পরিধান করে কোনো কোনো পোলিং এজেন্টদের দায়িত্ব পালন, একইরূপ পোশাক পরিহিত ব্যক্তিবর্গ বিক্ষিপ্তভাবে ভোটকক্ষে বিচরণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে গোপনকক্ষে প্রবেশ, উল্লিখিত পোশাক উপঢৌকন বা অর্থের বিনিময়ে নেওয়া কিনা ইত্যাদি ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করে কমিশনকে জানিয়েছে। এছাড়া পোলিং এজেন্ট বা অবৈধ কোনো ব্যক্তি গোপনকক্ষে প্রবেশ করে নিজেই ভোটপ্রদান, ভোটার কোন প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছেন তা গোপন কক্ষে উঁকি দিয়ে বা ঢুকে অবলোকন করা, ভোটপ্রদানে বাধা প্রধান, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ভোটকক্ষে ঢুকে নিজেই ভোট দেওয়া বা ভোটারকে প্রভাবিত করা অথবা পোলিং এজেন্ট নয় এ ধরনের ব্যক্তি ভোটদানে ভোটারকে প্রভাবিত করার বিষয়ে দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করা হয়েছে মূল তদন্ত প্রতিবেদনে। প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশকে ভোট অনিয়মে সম্পৃক্ত হতে জেলা প্রশাসন বাধ্য করেছে। কমিটির কাছে লিখিত চিঠিতে প্রিজাইডিং অফিসাররা জানিয়েছেন, গাইবান্ধা জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তার নির্দেশে এডিসি জেনারেল সুশান্ত কুমার মাহাতো, সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলার ইউএনওরা মিলে প্রিজাইডিং অফিসারদের ‘ভোট সুষ্ঠু হয়েছে’ মর্মে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেন। বিশেষ করে সাঘাটা ইউএনও সরদার মোস্তফা শাহীন প্রিজাইডিং অফিসারদের সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন বলে জানিয়েছেন প্রিজাইডিং অফিসাররা।
এ বিষয়ে সাঘাটা ইউএনও সরদার মোস্তফা শাহীন ইত্তেফাককে বলেন, আমি কাউকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করিনি। পরবর্তীকালে চিঠিতে প্রিজাইডিং অফিসাররা ইসির কমিটির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আবার অনেক প্রিজাইডিং অফিসার ঘটনার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন চিঠিতে। কমিটির প্রতিবেদনে প্রিজাইডিং অফিসারদের চিঠিগুলো সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রিজাইডিং অফিসাররা প্রত্যেকটা চিঠিতে সহকারী রিটার্নিং অফিসার মো. কামরুল ইসলামের নির্দেশনায় ভোট বন্ধের কথা উল্লেখ করেছিলেন। যদিও কামরুল ইসলাম শুধু সাঘাটার দায়িত্বে থাকলেও ফুলছড়ির বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসাররাও তার নাম সাদা কাগজের চিঠিতে উল্লেখ করেন। প্রত্যেকটি প্রিজাইডিং অফিসারের চিঠির ভাষা ছিল এক এবং অভিন্ন।
এ বিষয়ে নওগাঁও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, কমিশনের নির্দেশে আমি সাঘাটার ৮৮টি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ রাখার জন্য প্রিজাইডিং অফিসারদের নির্দেশনা দিয়েছিলাম। পরবর্তীকালে দেখা গেছে সাঘাটা ও ফুলছড়ির ৯৬ জন প্রিজাইডিং অফিসার সাদা কাগজে স্বাক্ষর করে ভোট সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি করেছেন। সাঘাটার স্থগিত ভোটকেন্দ্রের ২৬ জন প্রিজাইডিং অফিসার আমার কাছে ভোটের পরিবেশ না থাকায় ভোটবন্ধের কথা উল্লেখ করে চিঠি দেন।
Leave a Reply