অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : রাষ্ট্রীয় অংশীদারত্বের বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান যমুনা অয়েল কোম্পানি ‘তেল চুরির অপবাদ’ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম থেকে পাইপলাইনে ২ কোটি ৫৩ লাখ ৮ হাজার ৬৩ লিটার ডিজেল কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় নিয়ে যায়। তবে পথেই কমে যায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৩৬৮ লিটার তেল। যার হিসাব এখনো মেলাতে পারেনি যমুনা।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানটিতে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে পাইপলাইনে জ্বালানি সরবরাহ করেও পৌনে চার লাখ লিটার তেল কমে যাওয়ায় সমালোচনা তৈরি হয়। এর মধ্যে ২ লাখ ৬২ হাজার ৮০৪ লিটার ডিজেল প্যাকিং হিসেবে পাইপলাইনে রয়ে গেছে বলে দায় স্বীকার করেছে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ। অবশিষ্ট ১ লাখ ১২ হাজার ৫৬৪ লিটার ডিজেলের হিসাব এখনো মেলাতে পারেনি যমুনা অয়েল।
বিষয়টি নিয়ে যমুনা অয়েল, বিপিসি এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ আলাদা আলাদা কমিটিও গঠন করে। তাতে যমুনা অয়েল গঠিত নিজস্ব কমিটি এক মাস পর প্রতিবেদন জমা দিলেও বিপিসি ও জ্বালানি বিভাগ গঠিত কমিটি এখনো প্রতিবেদন তৈরি করতে পারেনি। এর মধ্যে বিপিসির ১০ দিনের এবং জ্বালানি বিভাগের ১৫ দিনের কমিটির মেয়াদ এক মাস পেরিয়েছে।
বিপিসি চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে পাইপলাইনে কুমিল্লা ও ফতুল্লায় তেল নেওয়া হচ্ছে। যমুনা অয়েলের তেল চুরির যে তথ্য গণমাধ্যমে এসেছে, তা সঠিকভাবে উপস্থাপন হয়নি। তেল কোথাও যায়নি। সবই ট্যাংকে আছে।
প্রশ্ন উঠেছে, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর পাইপলাইনে তেল পরিবহন করার পরেও কেন কম পড়লো। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যমুনা অয়েলের নিজস্ব কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তারা ছয় হাজার লিটারের মতো তেল কম পাওয়ার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। তবে মন্ত্রণালয় ও বিপিসির কমিটি এখনো কাজ করছে। মোদ্দা কথা হলো, একটি অভিযোগ বিষয়ে বেশি কমিটি হওয়ায় বিপত্তি তৈরি হয়েছে। দুই কমিটির তদন্তের ফলাফল ভিন্ন হলে পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।’
তিনি বলেন, ‘তেল কোথাও যায়নি, চুরিও হয়নি। পাইপলাইনে যাওয়া তেল রিসিভিং টার্মিনালের ট্যাংকে আছে। ট্যাংকটি সিলগালা করা রয়েছে। ক্যালিব্রেশন রিপোর্টে ভুল তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। মূলত ক্যালিব্রেশন রিপোর্টের মাধ্যমে পরবর্তীসময়ে তেল গায়েব করার একটি দূরভিসন্ধিও হতে পারে।’
এ বিষয়ে চট্টগ্রামের প্রধান কার্যালয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ এখন পুরোপুরি শেষ হয়নি। পরীক্ষামূলকভাবে পাইপলাইনে কুমিল্লা ও ফতুল্লায় তেল নেওয়া হচ্ছে। যমুনা অয়েলের তেল চুরির যে তথ্য গণমাধ্যমে এসেছে, তা সঠিকভাবে উপস্থাপন হয়নি। তেল কোথাও যায়নি। সবই ট্যাংকে আছে।’
পিটিসিপিএলসির ম্যানেজার (অপারেশন্স) ইঞ্জিনিয়ার রনি আহমেদ বলেন, আমাদের কমিটিতে ছয়জন ছিলেন। আমরা শুধু রি-ক্যালিব্রেশন করেছি। আমি যেহেতু ইঞ্জিনিয়ার তাই টেকনিক্যাল বিষয়গুলো পর্যালোচনা করেছি মাত্র। তবে প্রথম ক্যালিব্রেশনের কিছু বিচ্যুতি আমরা পেয়েছি।
তিনি বলেন, ‘যেহেতু অভিযোগ উঠেছে, সেজন্য একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকেও তদন্ত কমিটি হয়েছে। বিপিসি ও মন্ত্রণালয়ের কমিটি এখনো প্রতিবেদন দেয়নি। হয়তো তারা (তদন্ত কমিটি) কিছু সময় বেশি নিচ্ছে। তবে প্রতিবেদন পাওয়া না গেলেও পুরো বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত হয়েছি।’
রিসিভিং টার্মিনালের ট্যাংকে ক্যালিব্রেশন ডিজিটাল নাকি সনাতন পদ্ধতিতে হয়েছিল এমন প্রশ্নের জবাবে পুরোপুরি তথ্য দিতে পারেননি তিনি। বলেন, ‘ক্যালিব্রেশন করার জন্য বিএসটিআইয়ের প্রতিনিধি রাখা হয়েছিল। তাদের কাছেও হয়তো সব ধরনের প্রযুক্তি নেই। তাই তারা (বিএসটিআই) তৃতীয় পক্ষের সার্ভেয়ারের সহায়তা নিয়েছে।’
তৃতীয় পক্ষের সার্ভেয়ারের কোনো দূরভিসন্ধি ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা পুরোপুরি বলা যাবে না।’
চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় যমুনা অয়েলের প্রধান ডিপো থেকে পাইপলাইনে কুমিল্লা ও ফতুল্লায় জ্বালানি পরিবহনকালে ডিজেল কমে যাওয়া নিয়ে যমুনা অয়েল, পিটিসিপিএলসি, সিডিপিএলের একাধিক পত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছরের জুলাইয়ে যমুনা অয়েলের প্রধান ডিপো থেকে কুমিল্লা ও ফতুল্লা ডিপোতে ১ কোটি ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৭০৫ লিটার তেল সরবরাহ করা হয়। কিন্তু দুই ডিপোর রিসিভিং ট্যাংক ক্যালিব্রেশন করে ডিজেল পাওয়া যায় ১ কোটি ২ লাখ ১৭ হাজার ১৩ লিটার। ওই চালানে ২ লাখ ৬৮ হাজার ৬৯২ লিটার ডিজেল ঘাটতি পাওয়া যায়। তবে পরের ৪০ লাখ ৮৬২ লিটারের একটি চালানে ফতুল্লা ডিপোর ট্যাংকে ৪০ লাখ ৬ হাজার ৭৫০ লিটার ডিজেল পাওয়া যায়। এতে ওই চালানে অতিরিক্ত ৫ হাজার ৮৮৮ লিটার বেশি পাওয়া যায়। এতে প্রথম দুই চালানে ঘাটতি হয় ২ লাখ ৬২ হাজার ৮০৪ লিটার ডিজেল।
যমুনা অয়েলের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে দেওয়া চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পাইপলাইনে জ্বালানি তেল পরিবহন প্রকল্পের গত ২৭ জুলাই তারিখের একটি চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, কারিগরিভাবে সিস্টেম লস হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ফতুল্লা ও কুমিল্লা ডিপোতে অবস্থিত যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ট্যাংকগুলোতে ২ লাখ ৬৮ হাজার ৬৯২ লিটার তেল কম পাওয়া ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনে প্যাকিং অবস্থায় আছে বলে প্রতীয়মান হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় পার্সেলে ফতুল্লা ডিপোতে ৫ হাজার ৮৮৮ লিটার তেল বেশি হওয়ায় দুই চালানে ২ লাখ ৬২ হাজার ৮০৪ লিটার তেল প্যাকিং হিসেবে গণ্য করে প্রকল্প থেকে তেলের মূল্য যমুনা অয়েল কোম্পানিকে পরিশোধ করা যেতে পারে।’
সবশেষ চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ১ কোটি ৮ লাখ ১৫ হাজার ৬০৮ লিটার তেল পতেঙ্গার প্রধান ডিপো থেকে পাইপলাইনে ফতুল্লায় পাঠানো হয়। ওই চালানে ফতুল্লা ডিপোতে সিডিপিএলের রিসিভিং ট্যাংক ক্যালিব্রেশন করে ১ লাখ ১২ হাজার ৫৬৪ লিটার ডিজেল কম পাওয়া যায়। আগের চালানে বেশি পাওয়ার পর সবশেষ চালানে তেল কমে যাওয়ায় বিপিসিতে তোলপাড় শুরু হয়। এ নিয়ে গঠন করা হয় একাধিক কমিটি।
আমাদের কমিটিতে বুয়েটের একজন অধ্যাপক আছেন। তিনি এক্সপার্ট। পুরো বিষয়টি ও জ্বালানি তেল পরিমাণের খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করেছেন। আমরা পুরো বিষয়টি বিশদ আলোচনা করেছি। দু-একদিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে পারবো।- অতিরিক্ত সচিব মো. আবদুল মান্নান
প্রথমে ফতুল্লা ডিপোর ২২ ও ২৩ নম্বর ট্যাংকের রি-ক্যালিব্রেশন করার জন্য ২৮ সেপ্টেম্বর যমুনা অয়েলের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন্স) সৈয়দ শাহীদুল হক স্বাক্ষরিত এক পত্রে প্রতিষ্ঠানটির ডিজিএম (ইঅ্যান্ডডি) মো. আলমগীর আলমকে প্রধান করে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ইতোমধ্যে কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
কমিটির সদস্য পিটিসিপিএলসির ম্যানেজার (অপারেশন্স) ইঞ্জিনিয়ার রনি আহমেদ বলেন, ‘আমাদের কমিটিতে ছয়জন ছিলেন। আমরা শুধু রি-ক্যালিব্রেশন করেছি। আমি যেহেতু ইঞ্জিনিয়ার তাই টেকনিক্যাল বিষয়গুলো পর্যালোচনা করেছি মাত্র। তবে প্রথম ক্যালিব্রেশনের কিছু বিচ্যুতি আমরা পেয়েছি। প্রতিবেদনে বিষয়গুলো উল্লেখ করেছি। এর চেয়ে বেশি বলা যাবে না। আমাদের রি-ক্যালিব্রেশনের অনেক তথ্য আমরা বিপিসির তদন্ত কমিটিকে দিয়েছি।’
তেল গায়েবের বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে ৩০ সেপ্টেম্বর একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করে যমুনা অয়েল। কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার (এইচআর) মো. মাসুদুল হক স্বাক্ষরিত এক পত্রে প্রতিষ্ঠানটির ডিজিএম (ফাইন্যান্স) মোহাম্মদ জোবায়ের চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও প্রায় ২৫ দিন পর ওই কমিটি প্রতিবেদন দেয়। এ বিষয়ে জোবায়ের চৌধুরীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে জেনারেল ম্যানেজার (এইচআর) মো. মাসুদুল হক বুধবার (১২ নভেম্বর) বলেন, ‘আমি একদিন আগে প্রতিবেদনটি পেয়েছি। ৭ হাজার ৭৭১ লিটার ঘাটতি থাকার বিষয়টি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। মূলত প্রথম ক্যালিব্রেশনে ভুল ছিল। ক্যালিব্রেটরদের পানিশমেন্ট হওয়া উচিত।’
২ অক্টোবর বিপিসির ঊর্ধ্বতন মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন) মণি লাল দাশ স্বাক্ষরিত এক আদেশে বিপিসির মহাব্যবস্থাপককে (বণ্টন ও বিপণন) আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। এখনো কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়নি।
এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (বণ্টন ও বিপণন) মোহাম্মদ জাহিদ হোসাইন বলেন, ‘আমরা মঙ্গলবারও একজনের স্টেটমেন্ট নিয়েছি। প্রতিবেদন প্রায় রেডি। দু-একদিনের মধ্যে জমা দিয়ে দেবো।’ তবে তদন্তের ফলাফল সম্পর্কে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
৬ অক্টোবর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আবদুল মান্নানকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করে মন্ত্রণালয়। কমিটিতে বুয়েটের কেমিকৌশল বিভাগের একজন অধ্যাপককেও রাখা হয়। ওই কমিটি এখনো প্রতিবেদন দেয়নি।
মঙ্গলবার বিকেলে অতিরিক্ত সচিব মো. আবদুল মান্নান বলেন, ‘আমাদের কমিটিতে বুয়েটের একজন অধ্যাপক আছেন। তিনি এক্সপার্ট। পুরো বিষয়টি ও জ্বালানি তেল পরিমাণের খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করেছেন। আমরা পুরো বিষয়টি বিশদ আলোচনা করেছি। দু-একদিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে পারবো।’ তবে তদন্তের এ পর্যায়ে তিনিও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বিপিসি সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে জ্বালানি তেলের গড় চাহিদা বছরে ৬৫ লাখ টন। সবশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরবরাহ করা হয়েছে ৬৭ লাখ টন। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশই ডিজেল। ঢাকা বিভাগেই জ্বালানি তেলের ব্যবহার মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ। বর্তমানে ঢাকায় তেল পরিবহনের জন্য প্রথমে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে নদীপথে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ও ফতুল্লা ডিপোতে নেওয়া হয়। এরপর সেখান থেকে সড়কপথে ঢাকায় তেল পরিবহন করা হয়। পরিবহনে ব্যবহৃত হয় প্রতি মাসে প্রায় ১৫০টি ছোট-বড় জাহাজ। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হচ্ছে।
খরচ আর ভোগান্তি কমাতেই তিন হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পাইপলাইনে জ্বালানি তেল পরিবহন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। পাইপলাইনে পুরোদমে জ্বালানি পরিবহন শুরু হলে বছরে প্রায় ২৩৬ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বিপিসির। জাগো নিউজের সৌজন্যে।