স্টাফ রিপোর্টার : ঝিনাইদহের মহেশপুর পৌরসভা এলাকায় সৌরবাতি স্থাপনে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির ফলে মুখ থুবড়ে পড়েছে সরকারের প্রায় দু’কোটির টাকার প্রকল্প। দু’দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হলে এক মাসের ব্যবধানে এখনো বাঁকি রয়েছে ৪০ ভাগ কাজ।
এদিকে সরবরাহকৃত মালামাল ইস্টিমেট অনুযায়ী গ্রহণ না করে কোটি টাকার বিল উত্তোলন, সরবরাহকৃত মালামালের উপরে নকল লেবেল লাগানো ও সরঞ্জামাদি খুলে সার্কিটে লেখার সাথে অমিল, সরবরাহকৃত মালামাল অতি নিম্নমানের হওয়ার অল্প সময়ে নষ্ট হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
এসব কারণ দেখিয়ে গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান অংগীরা ইলেক্ট্রনিক্সকে কারণ দর্শানোর নোটিশ করেন তৎকালীন পৌর প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ.বি.এম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী।
জলবায়ু প্রকল্পে প্রতিটি সৌরবাতির দাম ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৫০০ টাকা। তবে বাজার বিশ্লেষণে জানা যায়, মাত্র ৪০-৪৫ হাজার টাকায় স্থাপন করা হয়েছে এসব নিম্নমানের সৌরবাতি।
মহেশপুর পৌরসভায় ১৫০ সৌরবাতি স্থাপনের বরাদ্দ দেন বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। পৌর মেয়র আব্দুর রশিদ খান ও নির্বাহী প্রকৌশলী সোহেল রানা সেলামী গ্রহণের মাধ্যমে ইস্টিমেটের বাইরে অতিনিম্ন মানের সৌরবাতি স্থাপনের সুযোগ করে দিয়েছেন ওই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে। নিম্নমানের মালামাল সরবরাহ করার পরও প্রায় কোটি টাকার বিল উত্তোলন করা হয়েছে।
সাবেক মেয়র ও প্রকৌশলীর সেলামী গ্রহণের এমন অপকৌশলে মুখ থুবড়ে পড়েছে সরকারের প্রায় দু’কোটি টাকার প্রকল্প। যে কারণে স্থাপনের অল্প কয়েকদিনের মধ্য বেশকিছু সৌরবাতি নষ্ট হয়েছে। যদিও দীর্ঘ সময় কাজ বন্ধ থাকার পর আবারও শুরু হলে নষ্ট হওয়া সৌরবাতি গুলো মেরামত করে স্বচল করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।
পৌরসভার তথ্যনুযায়ী, গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে জলবায়ু পরিবর্তন প্রকল্পের আওতায় ১৫০ সৌরবাতি স্থাপনের লক্ষ্যে ১ কোটি ৯৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।
দেশের বহুল প্রচারিত পত্রিকায় বিজ্ঞপি না দিয়ে ঢাকার আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে যোগসাজসে সৌরবাতি স্থাপনের কাজ পান অংগীরা ইলেক্ট্রনিক নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রথম দফায় ৮০ সৌরবাতি স্থাপন করা হলে সাবেক মেয়র ও প্রকৌশলী ৮৩ লাখ ৭৭৫০ টাকা বিল পরিশোধ করেন ওই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে। পরবর্তীতে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে।
জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর মেয়রের পরিবর্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ.বি.এম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী পৌর প্রশাসকের দায়িত্বভার গ্রহণ করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে শুরু করে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অনুসন্ধান করে দেখতে পান, সরবরাহকৃত মালামালের উপরে নকল লেবেল লাগানো হয়েছে।
সরেজমিনে তদন্তকালে দেখতে পান, সরঞ্জামাদি খুলে সার্কিটে লেখার সাথে অমিল, সরবরাহকৃত সোলার অতি নিম্নমানের ও মালামাল ইস্টিমেট অনুযায়ী না হওয়া সত্বেও কোটি টাকার বিল উত্তোলন করা হয়েছে। পরবর্তীতে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান অংগীরা ইলেকট্রনিক্সকে কারণ দর্শানোর নোটিশ করেন ওই কর্মকর্তা। এরপর থেকে সৌরবাতি স্থাপন বন্ধ রয়েছে।
পৌর কর্মচারী আ. হান্নান বলেন, এডিএম স্যারের নির্দেশে রাস্তা থেকে জলবায়ু প্রকল্পের সৌরবাতি নামিয়ে আনা হয়। সেখানে দেখা যায় ইস্টিমেটে সাথে সরবরাহকৃত কোন মালামালের মিল নেই। ইস্টিমেটে যা আছে তার থেকে অনেক কম দেয়া আছে। পরবর্তীতে এব্যাপারে এডিএম স্যার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে একটি চিঠি করেন।
পৌরসভার ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ করা আরেক কর্মচারী বলেন, রাস্তা থেকে সৌরবাতি খুলে আনার পর মালামালের ছবি তোলান এডিএম স্যার। দেখা যায়, যে মালামাল সরবরাহ করা হয়েছে তা খুবই নিম্ন মানের। বাজারে যাচাই করলে সর্বোচ্চ মূল্য ৩০-৩৫ হাজার টাকা হরে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী বলেন, ২-১টি বাদে আমাদের স্থাপন করা প্রায় সব সৌরবাতি জ্বলছে। ইস্টিমেট অনুযায়ী মালামাল সরবরাহ করা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পৌর প্রশাসকের দায়িত্ব থাকাকালিন আমাদের কারণ দর্শানোর চিঠি করলে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছি।
পৌরসভার প্রকৌশলী সোহেল রানা বলেন, এ প্রকল্পের সভাপতি মেয়র নিজেই। তিনিই সবকিছু করেছেন। ইস্টিমেট অনুযায়ী মালামাল দেয়া আছে। ছায়া কিংবা উপরের ময়লা জমলে আলো বন্ধ হতে পারে। ‘
প্রশাসকের দায়িত্বে থাকাকালীন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট চিঠিতে জানিয়ে ছিলেন মালামাল ইস্টিমেট অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়নি’ এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকৌশলী বলেন, পৌরসভায় অনেক প্রকল্পের সৌরবাতি লাগানো আছে। ম্যাজিস্ট্রেট স্যার অন্য প্রকল্পের সৌরবাতি পরীক্ষা করেছিলেন বলে আমাকে ঠিকাদাররা জানিয়েছেন। পৌরসভার সাবেক মেয়র আব্দুর রশিদ খানের ব্যবহারিত নম্বরে একাধিকবার কল দিলে তা বন্ধ পাওয়া গেছে।
পৌর প্রশাসক খাদিজা আক্তার বলেন, এ বিষয়টি জানতে প্রকৌশলীকে চিঠি করা হয়েছে। উনি লিখিত ভাবে জানানোর পর বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবো।