অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : বাংলাদেশে প্রথম বারের মতো ডেঙ্গু টিকার প্রথম ও দ্বিতীয় ট্রায়াল সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এন্টিবডি তৈরি হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। তবে যে এন্টিবডি তৈরি হয়েছে, সেটা রোগ প্রতিরোধে কতভাগ কার্যকর— সেটি দেখতে অচিরেই তৃতীয় ট্রায়াল হবে। ৬০ ভাগ কার্যকর হলেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন দিয়ে থাকে। ডেঙ্গু টিকার তৃতীয় ট্রায়ালে সফল হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী বিজ্ঞানীরা।
গবেষকদের মতে, বিশ্বে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু টিকার তৃতীয় ট্রায়াল দিয়েছে একটিমাত্র দেশ ব্রাজিল। কিন্তু এখনো ফলাফল বের হয়নি। ভারত সামনে তৃতীয় ট্রায়াল দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। বাংলাদেশে ডেঙ্গু টিকার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, দেশে ডেঙ্গুর ভয়াল থাবা বিরাজ করছে। এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে দেশের জনস্বাস্থ্য যখন বিপর্যয়ের মুখে এমন পরিস্থিতিতে টিকা আবিষ্কার ও মানবদেহে সেটির সফল প্রয়োগ মানুষকে আশার আলো দেখাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্মন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউভিএম) লার্নার কলেজ অব মেডিসিনের সঙ্গে আইসিডিডিআরবির পরিচালিত এই যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরনের বিরুদ্ধেই উপযোগী এই টিকা। টিকার নাম দেওয়া হয়েছে ‘টিভি-০০৫’।
বাংলাদেশে প্রথম বারের মতো ডেঙ্গু টিকার গবেষণা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবি করেছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)। সম্প্রতি দ্য ল্যানসেট ইনফেকশাস ডিজিজেস জার্নালে এই গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় ব্যবহৃত এক ডোজের ডেঙ্গু টিকা টিভি-০০৫ মূল্যায়ন করে দেখা গেছে, এটি শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রয়োগের জন্য নিরাপদ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে সক্ষম।
ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত ভাইরাস যা বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিক সময়ে এর তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত বেশ গুরুতর এবং ঢাকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর এটি ভয়ানক প্রভাব ফেলেছে।
গবেষকরা জানান, ২০১৫ সালে ডেঙ্গু ইন ঢাকা ইনিশিয়েটিভ (ডিডি) নামক গবেষণাটি শুরু করেন আইসিডিডিআরবি এবং ইউভিএমের ভ্যাকসিন টেস্টিং সেন্টারের গবেষকরা। এই সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার লক্ষ্য ছিল ডেঙ্গু টিকার উন্নয়নে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করা।
২০১৫ থেকে ক্লিনিকাল ট্রায়াল, ল্যাবরেটরি পরীক্ষণ অবকাঠামো এবং প্রারম্ভিকভাবে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অধ্যয়ন-সংশ্লিষ্ট গবেষণার জন্য আইসিডিডিআরবিতে প্রয়োজনীয় সক্ষমতা তৈরি করা হয়। ২০১৬ সাল থেকে বিভিন্ন বয়সের (বয়স ১-৪৯ বছর) ১৯২ জন স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণকারীকে চারটি ভাগে ভাগ করে ৩:১ টিভি-০০৫ টিকা বা প্লাসিবো প্রদান করা হয়। এরপর তারা পরবর্তী তিন বছর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেছেন। টিকা দেওয়ার পর বেশির ভাগ স্বেচ্ছাসেবীর মধ্যে চারটি ডেঙ্গুর সেরোটাইপের এন্টিবডি পাওয়া গেছে। যারা আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন তাদের এন্টিবডির পরিমাণ বেশি পাওয়া গেছে। যদিও গবেষণাটির কার্যকারিতা মূল্যায়ন করার জন্য ডিজাইন করা হয়নি। তবে এখন পর্যন্ত টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণের কোনো ঘটনা শনাক্ত করা যায়নি। গবেষণালব্ধ এই ফলগুলো ডেঙ্গুপ্রবণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপকহারে টিভি-০০৫ ডেঙ্গু টিকা ব্যবহারের জন্য উপযোগী করে তোলার পাশাপাশি, তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল পরিচালনার জন্য সমর্থন জোগাড় করতে সহায়তা করবে। জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের (এনআইএইচ) তৈরি ডেঙ্গু টিকার মূল্যায়ন করে আসছে ইউভিএমের ভ্যাকসিন টেস্টিং সেন্টার।
আইসিডিডিআরবির গবেষকদের মধ্যে প্রধান গবেষক হিসাবে রয়েছেন সিনিয়র বিজ্ঞানী রাশিদুল হক। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন মো. শফিউল আলম, সাজিয়া আফরিন ও মো. মাসুদ আলম। বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের মানুষের অংশগ্রহণে টিভি-০০৫ টিকার গবেষণা করতে পেরে আমরা গর্বিত। আশা করি আমাদের কাজ ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে একটি কার্যকর টিকা প্রাপ্তির বিষয়কে ত্বরান্বিত করবে।
এদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, বিশ্বের কোনো দেশেই ডেঙ্গুর কার্যকরী টিকা নেই। তবে বাংলাদেশে আইসিডিডিআরবির তৈরি টিকা ডেঙ্গুর চারটি ভাইরাসেই কার্যকর বলে শোনা যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষা শেষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছ থেকে এ টিকার অনুমোদন নেওয়া হবে। শনিবার দুপুরে মানিকগঞ্জে নিজ বাসভবনে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। মন্ত্রী আরও বলেন, ডেঙ্গু টিকা নিয়ে বিশ্ব জুড়েই গবেষণা চলছে। ইতিমধ্যে দুটি টিকা আবিষ্কারও হয়েছে। কিন্তু সেই টিকা সব ভাইরাসে কার্যকর নয়। তাতে অনেক সমস্যা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের তৈরি টিকার সফল পরীক্ষা সত্যিই আশা জাগায়।
Leave a Reply