অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, বিশ্ববাজারে জ্বালানির ঊর্ধ্বমূল্য, ডলার সংকটে কয়লা আমদানি বন্ধসহ নানামুখী কারণে সম্প্রতি কঠিন সময় পার করছে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। এমনকি কয়লা সংকটে বন্ধ হতে যাচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রার দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদনও।
এ সংকটের সময় সুখবর পাওয়া গেল নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে। প্রথমবারের মতো দেশের জাতীয় গ্রিডে যোগ হলো ভাসমান সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ। পরিমাণে খুবই কম হলেও তা সফলভাবে পরীক্ষামূলক সময় পার করলে দেশের বিদ্যুৎ খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
উত্তরের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের বুলনপুরে দেশের প্রথম ভাসমান সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২ দশমিক ৩ মেগাওয়াট। প্রকল্পটির ফলে একই জলাশয় থেকে মিলবে মাছ ও বিদ্যুৎ। এ সব তথ্য জানিয়েছেন খোদ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, আগামী কয়েক মাস আমরা এই জলাশয়ে মাছের বৃদ্ধি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করব। পরিবেশগত ভারসাম্য অটুট থাকলে পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন জলাধারে আমরা আরও বড় পরিসরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেব। দেশের লোডশেডিং ও জ্বালানি সংকটের এই সময়ে এমন পরিবেশবান্ধব উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাও। তবে জীববৈচিত্র্যে নেতিবাচক কোনো প্রভাব যাতে না পড়ে, এ বিষয়টিকেও নজরে নেওয়ার দাবি তাদের।
দেশের একমাত্র ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বুলনপুরের দুটি পুকুরে। এই কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ যুক্ত হচ্ছে জাতীয় গ্রিডেও। বিদ্যুৎসংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়া বিদ্যুৎ চাঁপাইনবাবগঞ্জে লোডশেডিং কমাতে ভূমিকা রাখবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের আতাহার এলাকার বুলনপুরে অবস্থিত নবাব অটো রাইস মিল। এই মিলের ভেতরে রয়েছে ছোট-বড় সব মিলিয়ে ৫২টি পুকুর। এর মধ্যে দুটি পুকুরে পরীক্ষামূলকভাবে সম্প্রতি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। নেট মিটারিং পদ্ধতিতে এই প্রকল্পের অংশীদার নবাব অটো রাইস মিল, জুলস পাওয়ার লিমিটেড ও জাতীয় পাওয়ার গ্রিড।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঘণ্টায় গড়ে ২ দশমিক ৩ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রটির দশমিক ৮ মেগাওয়াট (৮০০ কিলোওয়াট) সৌর প্যানেল ভাসমান অবস্থায় স্থাপন করা হয়েছে অটো রাইস মিল মালিকের পুকুরের পানির ওপর। বাকি সৌর প্যানেল বসানো হয়েছে ওই রাইস মিলের ছাদে। সব মিলিয়ে মোট ১৫০০টিরও বেশি সোলার প্যানেলের ব্যবহার করা হয়েছে। সোমবার এই কেন্দ্র থেকেই উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়া শুরু হয়েছে।
জুলস পাওয়ার লিমিটেডের হেড অব বিজনেস ডেভেলপমেন্ট মোহাম্মদ নাহিদুজ্জামান বলেন, ওপেক্স মডেলের আওতায় অনগ্রিড এই সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠান নিজস্ব অর্থায়নে কেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনও শুরু হয়েছে। বর্তমানে এখান থেকে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৮ টাকা ১০ পয়সা দরে কিনছেন অটো রাইস মিল কর্তৃপক্ষ। কয়েক দিন আগেও এই মিল মালিক বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি নেসকোর কাছ থেকে ১০ টাকা ৬০ পয়সা দরে বিদ্যুৎ কিনছিলেন। অর্থাৎ প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য তার আড়াই টাকা সাশ্রয় হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, প্রতি মাসে উৎপাদিত বিদ্যুতের ইউনিট হিসেবে বিল পরিশোধ করবেন মিল মালিক। এভাবে ১২ বছর ধরে বিল পরিশোধের পর পুরো কেন্দ্রটি বিনামূল্যে ওই ক্রেতার কাছে হস্তান্তর করা হবে। এরপর তিনি এই কেন্দ্র থেকে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে সামান্য কিছু রক্ষণাবেক্ষণের খরচ লাগতে পারে।
পানিতে সৌর প্যানেল ভাসানোর জন্য ফুড গ্রেডের প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়েছে। এতে করে পানি কিংবা মাছের কোনো ক্ষতি হবে না। আগামী ২০ বছর এর গুণগত মান অক্ষুণœ থাকবে। পানিতে সৌর প্যানেলগুলো এমনভাবে বসানো হয়েছে যেন মাছের স্বাভাবিক জীবনচক্রে ব্যাঘাত না ঘটে, সেদিকেও খেয়াল রাখার কথা জানালেন নাহিদুজ্জামান।
আগামী দুই বছরের মধ্যে সোলার থেকে অন্তত ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে বছরের শুরুতেই স্বাক্ষরিত হয় সিরাজগঞ্জ ৬৮ মেগাওয়াট সোলার পার্কের। পাশাপাশি আরও অন্তত ৫টি প্রকল্পের কাজ শুরু করার কথা জানায় বিদ্যুৎ বিভাগ। এর মধ্যে রয়েছে বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পও। এ সব প্রকল্প থেকে বছরে অন্তত ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে। ন্যূনতম মূল্যে এ সব বিদ্যুৎ পাবেন গ্রাহকরা। ফলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির যে বৈশ্বিক সংকট তা অনেকটাই কাটবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ১১৬৯ দশমিক ৭৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। যার মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ থেকে অফ গ্রিডে ৩৫৭ দশমিক শূন্য ৯ মেগাওয়াট এবং অন-গ্রিডে ৫৭৮ দশমিক ৬৬ মেগাওয়াটসহ মোট ৯৩৫ দশমিক ৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সঙ্গে ৬৮ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সিরাজগঞ্জ সোলার পার্ক প্রকল্পের পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট (পিপিএ) এবং ইমপ্লিমেন্টেশন এগ্রিমেন্ট (আইএ) সই হয় চলতি বছরের জানুয়ারিতে। এ সময় জানানো হয়, এই প্রকল্প থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাণিজ্যিকভাবে জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে। এর কিছুদিন পর সৌর বিদ্যুতের সম্প্রসারণে ইন্টারন্যাশনাল সোলার এলায়েন্সের (আইএসএ) সঙ্গে কান্ট্রি পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট সই করে বাংলাদেশ। এ চুক্তির আওতায় সৌর বিদ্যুতের সহযোগিতার ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে। এর মাধ্যমে একটি সোলার রোডম্যাপ (২০২০-২০৪১) তৈরি হবে। বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনিস্টিউটকে (ইজজও) ২ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১২টি ট্রলি মাউন্টেড সোলার ইরিগেশন সিস্টেম, ২ কিলোওয়াট ক্ষমতার ১২টি পোর্টেবল সোলার ধান মাড়াই যন্ত্র এবং ১.৫ কিলোওয়াট ক্ষমতার সোলার ড্রিংকিং ওয়াটার প্ল্যান্ট সরবরাহ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ ছাড়াও পরিকল্পনায় রয়েছে, ২২ কিলোওয়াট ক্ষমতার দুইটি রুফটপ সোলার স্থাপন এবং যে কোনো একটি রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে রুফটপ সোলার প্রকল্প স্থাপন।
Leave a Reply