অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্য সেবায় এক অনন্য মডেল হিসেবে কমিউনিটি ক্লিনিক আজ বিশ্বনন্দিত। ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বাংলাদেশ যখন এক বিপুল জনসংখ্যার চাপে দিশেহারা হয়ে পড়ার কথা, সেই সময়ে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবার এই মডেলকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আসিফ ইকবাল আজ বাসস’কে বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিকল্পিত একটি উদ্যোগ। বাংলাদেশের সব মানুষকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার আওতায় আনার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে এই অনন্য কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু করেন, যা সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের দোরগোড়ায় সরকারের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার সুফল সরবরাহে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এসব কমিউনিটি ক্লিনিকে বিনামূল্যে ৩০ প্রকার ওষুধ রোগিদের দেয়া হয়।
তিনি জানান, স্থানীয় জনগণের জমিতে সরকারের টাকায় কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হয়। স্থানীয় জনগণই এই ক্লিনিক পরিচালনা করেন। এতে করে কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা সম্পর্কে এলাকাবাসীর মধ্যে যেমন সচেতনতা তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে সেবার গুণগত মান বজায় রাখতেও তারা ভূমিকা রাখেন। সরকারের পাশাপাশি সামাজিক সংগঠন, বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় দেশের গ্রামীণ জনগণের দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা পৌঁেছ দেয়ার লক্ষে সরকার ২০১৮ সালে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন প্রণয়ন করেছে।
ডা. আসিফ বলেন, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার এই মডেলটিই আজ বিশ্বব্যাপি সুনাম অর্জন করেছে। তিনি বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি ও স্বাস্থ্য শিক্ষা দিয়ে থাকে। আবার এটি নারীর ক্ষমতায়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
এরই প্রেক্ষিতে গত ১৬ মে ২০২৩ মঙ্গলবার জাতিসংঘের ৭৭তম অধিবেশনের ২২তম এজেন্ডায় প্রথমবারের মতো কমিউনিটি ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক একটি রেজুলেশন সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এদিন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে রেজুলেশনটি উপস্থাপন করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আবদুল মুহিত। কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনস্বরূপ জাতিসংঘের ৭০টি সদস্য রাষ্ট্র এই রেজুলেশনটি কো-স্পন্সর করে। জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের পক্ষ থেকে রেজুলেশনটি সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করেন উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি ড. মো. মনোয়ার হোসেন।
‘কমিউনিটি ভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা: সার্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা অর্জনের লক্ষ্যে একটি অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি’ শিরোনামের এই ঐতিহাসিক রেজুলেশনটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে বাংলাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিক ভিত্তিক মডেল প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসামান্য উদ্ভাবনী নেতৃত্বকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে।
এই রেজুলেশনটিতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফল উদ্ভাবনী উদ্যোগের ব্যাপক স্বীকৃতি দিয়ে এই উদ্যোগকে ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে উল্লেখ করে। জনগণের স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সেবায় সাম্য প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের দৃঢ় প্রতিশ্রুতিকে প্রতিফলিত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র বিশেষ দশটি উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম কমিউনিটি ক্লিনিক। এর মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিটি মানুষ বিনামূল্যে মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছে। যার ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সহায়তা প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার কমেছে। স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি শ্রমজীবী নারীদের সন্তানদের জন্য শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র স্থাপন করায় প্রান্তিক নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ সুগম হয়েছে।
এমনকি কভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলায় সারাবিশ্ব যখন দিশেহারা তখনও বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো স্বাস্থ্য সেবায় এক অভাবনীয় ভূমিকা রেখেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কভিড-১৯-এর টিকাদান কর্মসূচিকে সফল করে তুলেছে এই কমিউনিটি ক্লিনিক। ৬ হাজার মানুষের জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে তোলা হয়েছে। এসব ক্লিনিকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি বিনামূল্যে ২৭ রকম ওষুধ দেয়া হয়।
ডা. আসিফ জানান, সারাদেশে এ পর্যন্ত ১৪ হাজার ২৫৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে তোলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ হাজার ২০০টি সেবা দিচ্ছে। অবশিষ্ট ৫৩টি ক্লিনিকে সেবাদানের জন্য সার্বিক প্রস্তুতি চলছে।
তিনি আরো জানান, সরকার ২০১৮ সালে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন প্রণয়ন করেছে। যা ‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন-২০১৮’ নামে পরিচিত। সরকারের বাস্তবায়ন পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট’ কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালনার জন্য পুরোপুরি প্রস্তত হবে। পরবর্তীতে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো এই ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত হবে।
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সমন্বিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান কার্যক্রমে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা,গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে সমন্বিত প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, সমন্বিত প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের লক্ষে প্রয়োজনীয় সামাজিক সহযোগিতা গ্রহণ, ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সম্পদ অথবা অনুদান সংগ্রহ এবং এর সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের সাথে ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের একটি কার্যকর রেফারেল পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা এই ট্রাস্টের লক্ষ্য।
Leave a Reply