অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : চীনের এআই গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিপসিক তাদের নতুন ভি৩ এবং আর১ মডেল উন্মোচন করার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি বাজারে রীতিমতো ধস নেমেছে। গত ২৭ জানুয়ারি বিনিয়োগকারীরা যখন বুঝতে পারলেন, ডিপসিকের নতুন মডেলগুলো গুগল ও ওপেনএআই’র সমপর্যায়ের, তখন মাত্র একদিনেই এক লাখ কোটি ডলারের বাজারমূল্য হারায় মার্কিন টেকজায়ান্টরা। বিশেষ করে, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ চিপ নির্মাতা এনভিডিয়ার বাজারমূল্য কমে যায় ৬০ হাজার কোটি ডলার।
কম খরচে উন্নত এআই মডেল : যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি বিধিনিষেধের কারণে চীন সর্বাধুনিক চিপ ব্যবহারের সুযোগ না পেলেও, ডিপসিক স্বল্প ব্যয়ে শক্তিশালী এআই তৈরি করে দেখিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের ব্যবহৃত চিপগুলোর কার্যকারিতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করার মাধ্যমে কম খরচে উন্নত এআই মডেল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এই উদ্ভাবন দেখিয়ে দিয়েছে, বিপুল অর্থ বিনিয়োগ ছাড়াও কার্যকর এআই টুল তৈরি করা সম্ভব।
ডিপসিকের এই অগ্রগতির ফলে প্রযুক্তি খাতে প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে এবং এআই প্রযুক্তির দাম কমে সাধারণ মানুষের কাছে আরও সহজলভ্য হয়ে উঠবে। প্রতিষ্ঠানটির চ্যাটবট কিছু দিনের মধ্যেই আইফোনের সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড হওয়া অ্যাপে পরিণত হয়েছে, যা এর জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে।
এনভিডিয়ার ধস ও বাজারে প্রতিক্রিয়া : এআই গবেষণায় এতদিন ধারণা করা হতো, উন্নত মডেল তৈরিতে এনভিডিয়ার অত্যাধুনিক চিপ অপরিহার্য। কিন্তু ডিপসিক কম খরচে প্রায় একই মানের এআই তৈরি করায়, এনভিডিয়ার বাজারমূল্য ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
এছাড়া, সিমেন্স এনার্জি, ক্যামিকোসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। কারণ তারা ডেটা সেন্টার নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও জ্বালানি সরবরাহ করতো। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যদি ওপেনএআই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত থাকতো, তাহলে তারাও বিপুল অর্থ হারাতো।
লাভবান কারা? : ডিপসিকের সাফল্যে কিছু প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, অনেকে লাভবানও হবে। অ্যাপল এখন চাপে না পড়ে অপেক্ষা করতে পারবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সেরা মডেলটি বেছে নিতে পারবে। ফ্রান্সের মিসট্রাল এবং আমিরাতের টিআইআই’র মতো ছোট এআই গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন উন্নত মডেল তৈরির প্রতিযোগিতায় নামবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ডিপসিকের সাফল্য এআই খাতে নতুন দ্বার উন্মোচন করবে এবং খরচ কমার কারণে এর ব্যবহার আরও বিস্তৃত হবে। জেভনস প্যারাডক্স অনুযায়ী, প্রযুক্তির উন্নতির ফলে কোনো সম্পদের ব্যবহারের দক্ষতা বাড়লে সেই সম্পদের মোট ব্যবহার কমার পরিবর্তে বেড়ে যায়। অর্থাৎ, এআই প্রযুক্তির খরচ কমলে তার ব্যবহার আরও বাড়বে। ডিপসিকের মডেল মার্কিন এআই স্টার্টআপ অ্যানথ্রোপিকের তুলনায় ১৫ গুণ সস্তা, ফলে এটি আরও বেশি ব্যবহৃত হবে।
এনভিডিয়া কি সত্যিই হারছে? : ডিপসিকের উত্থানে এনভিডিয়া পুরোপুরি হারিয়ে যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে এআই মডেলগুলোর জটিলতা বাড়লে আরও শক্তিশালী চিপের প্রয়োজন হবে। ডিপসিকের আর১ এবং ওপেনএআই’র ০৩ মডেলগুলো প্রচলিত এআই মডেলের তুলনায় বেশি কম্পিউটিং শক্তি ব্যবহার করে। ফলে এনভিডিয়া আশা করতে পারে, এই বাড়তি চাহিদা তাদের ব্যবসাকে দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখবে।
সাধারণ মানুষের জন্য সুসংবাদ : এআই প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী বিশেষজ্ঞরা। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার এআই ব্যবহার করে দেশের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন। ডিপসিকের মতো প্রযুক্তি থাকলে তাকে মাউক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর পেছনে বিপুল অর্থ খরচ করতে হবে না।
কিছু সমালোচক বলছেন, ডিপসিক মূলত মার্কিন মডেলেরই ‘পরিশোধিত’ সংস্করণ। সেটি যদি সত্যও হয়, তবু এটি একটি বড় উদ্ভাবন। ডিপসিক যে দক্ষতা দেখিয়েছে, তা এআই প্রযুক্তির ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক।
গত দুই বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ এআই প্রতিষ্ঠানগুলো ‘গুণগত মানের সামান্য উন্নতি’ আনতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছিল। কিন্তু ডিপসিক দেখিয়ে দিয়েছে, দ্রুত, সস্তা এবং কার্যকর এআই তৈরি করার জন্য আরও ভালো পথ রয়েছে। সূত্র : দ্য ইকোনমিস্ট
Leave a Reply