24 Feb 2025, 05:33 am

বিশ্বের আধিপত্য বিস্তারের লড়েইয়ে ‘ইউক্রেন বলির পাঠা’

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : ইউক্রেনে বর্তমানে যে শহরটি মানুষের কাছে খুব পরিচিত সেটি হচ্ছে বাখমুত। পূর্ব ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলের দোনেত্স্ক ও লুহানস্কে রসদ-পত্র সরবরাহের জন্য একটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ পথের ওপর এই বাখমুত শহরের অবস্থান। এই শহরের নিয়ন্ত্রণ দখল করতে পারলে রাশিয়া এই এলাকাটিকে ক্রামাটরস্ক ও স্লোভিয়ানস্কের মতো দুটি বড় শহরের দিকে এগিয়ে যাবার জন্য ভিত্তি তৈরি করতে পারবে। ইউক্রেনের ডেপুটি কমান্ডার জানিয়েছেন, বাখমুত এখন যেন নরক। রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ। বেসামরিক নাগরিকরা নিজের শেষ আশ্রয়টুকু ছেড়ে পালাচ্ছে। বাসিন্দাদের এমন দুঃখ-দুর্দশার মধ্যেও কিন্তু বিশ্বের ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রগুলো কীভাবে এই মরনের যুদ্ধ শেষ করবে তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং দিনে দিনে যুদ্ধের পরিধি বাড়ছে। যুদ্ধটা ইউক্রেনে হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে ক্ষমতার লড়াই। এই যুদ্ধের হার-জিতই বিশ্বকে ভবিষ্যতে কারা নিয়ন্ত্রণ করবে তার ইঙ্গিত পাওয়া যাবে—এমনটাই ধারণা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।

আধিপত্যের লড়াইটা কীভাবে : ভোরের আলো ফোটার আগেই ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলে হামলা চালায়। দেশটি একে বিশেষ সামরিক অভিযান হিসেবে বর্ণনা করে। যদিও পশ্চিমারা এই হামলাকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের ওপর আগ্রাসন এবং জাতিসংঘ সনদের ভয়াবহ লংঘন বলে অভিহিত করেছে। রাশিয়ার ভাবনার চেয়েও বহুগুণ বেশি সহায়তা পাচ্ছে ইউক্রেন। এই যুদ্ধ যে আধিপত্যের লড়াই তার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল গত বছর রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের বক্তব্যে। তিনি বলেছিলেন, বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকার অবসান ঘটাতেই ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান চালানো হচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করছে। তাই বিশ্বে শৃঙ্খলা ফেরাতেই এই অভিযান। এর কয়েক মাস পর তারই প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছিলেন, সংঘাতকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করতে চায় পশ্চিমা বিশ্ব।

যুদ্ধের এক বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। এখন বোঝা যাচ্ছে যে, রাশিয়ার সেই লক্ষ্যটা হয়তো বা পূরণ হচ্ছে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব এতটাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে যে, তারা এর শেষ দেখে ছাড়বে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ ভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকে শাস্তি পেতে হবে। কোনোভাবেই রাশিয়াকে দায়মুক্তি দেওয়া যাবে না। কারণ এর মাধ্যমে অন্য আক্রমণকারীরাও বার্তা পাবে যে, কোনো স্বাধীন দেশের ওপর হামলা চালালে তার পরিণতি কী হয়। ধারণা করা হচ্ছে, ব্লিনকেন মূলত চীনকে ইঙ্গিত করেই এমন মন্তব্য করেছেন। কারণ সিআইএ এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তাইওয়ানে হামলা চালিয়ে দখল করে নিতে চায় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সরকার। এজন্য তাইওয়ানেও অস্ত্র বিক্রি বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন কর্মকর্তারা বহুবার বলেছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধ চীনের জন্য শিক্ষা। এমনকি তাইওয়ানের কর্মকর্তারাও মনে করছেন, চীন হয়তো আর তাদের ওপর হামলা চালানোর সাহস নেবে না।

ইউক্রেন যুদ্ধের ইতি টানতে সম্প্রতি ১২ দফার শান্তি পরিকল্পনা পেশ করেছে চীন। কিন্তু পরিকল্পনা পেশ করার পরদিনই সমালোচনায় মাতে পশ্চিমারা। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশ ও ন্যাটো জোট এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। নেতারা বলেন, যেখানে চীন আজ পর্যন্ত ইউক্রেনে হামলার নিন্দা জানায়নি সেখানে নিরপেক্ষ কিছু একটা তারা করবে তা আশা করা যায় না। আবার প্রস্তাবের পরেই রাশিয়া সফর করেছেন চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়েং ই (সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী)। তার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং ল্যাভরভের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে ইস্পাতসম সম্পর্ক বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। চলতি মাসে প্রেসিডেন্ট শির রাশিয়া সফরের কথা। এরই মধ্যে মার্কিন গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, চীন রাশিয়াকে প্রাণঘাতী সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করছে। এমনকি ব্লিনকেনও এই তথ্য জানিয়ে চীনকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এতদিন কেবল যুক্তরাষ্ট্রই চীনকে হুমকি দিয়ে আসছিল। এবার সঙ্গে যোগ হয়েছে অন্যতম প্রধান মিত্র জার্মানি। চ্যান্সেলর ওলাফ শোলত্জ যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তারা ইউক্রেনকে আরো সামরিক সরঞ্জাম ও অর্থ-সহায়তার অঙ্গীকার করেছেন। একই সঙ্গে হুমকি দিয়েছেন যে, রাশিয়াকে অস্ত্র দিলে চীনকে কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে।

গত মাসে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল চীনের পরমাণু হুমকির কথা জানিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রেরও পরমাণুর মজুত বাড়ানো উচিত বলে কিছু মার্কিন আইনপ্রণেতা সরকারকে জানিয়েছেন। গত শনিবার চীন যুক্তরাষ্ট্রকে পরমাণু হুমকির উৎস বলে আখ্যায়িত করেছে। আবার রাশিয়া তো প্রায় প্রতিদিনই পরমাণু হামলার হুমকি দিচ্ছে। পুতিন-ঘনিষ্ঠ সাবেক প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন, যুদ্ধে জয় পেতে প্রয়োজনে পরমাণু হামলা চালাতেও রাশিয়া পিছপা হবে না। তার মতে, এই যুদ্ধে রাশিয়ার হারের অর্থ হচ্ছে, রাশিয়া নামের দেশটি খণ্ড খণ্ড হয়ে যাওয়া। পশ্চিমারা প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়াকে মুছে ফেলতে চায়। আবার রাশিয়ার ছোট্ট প্রতিবেশী মলদোভার কথাই ধরা যাক। দেশটির সরকার আতঙ্কে আছে যে, রাশিয়া তাদের ওপরও হামলা চালাতে পারে। দেশটির নেতৃত্ব গত মাসে পোল্যান্ড সফরে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। বাইডেন তাদেরকে রাশিয়ার হুমকি থেকে রক্ষায় সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তালিকায় কেবল মলদোভা নয়, ফিনল্যন্ড ও সুইডেনও রাশিয়ার হুমকিতে। তারা ইতিমধ্যে ন্যাটোর সদস্য হওয়ার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ইউরোপীয় অনেক দেশই মনে করছে, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার জয় হলে তা ইউরোপের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ধসে পড়ল, তখন কমিউনিজমের পতনকে পশ্চিমা গণতন্ত্রের চূড়ান্ত বিজয় বলে ঘোষণা করেছিলেন অনেকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা তো ‘দ্য অ্যান্ড অব হিস্ট্রি অ্যান্ড দ্য লাস্ট ম্যান’ বলে একটা বই লিখে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু ইউরোপে আবার এক রক্তাক্ত যুদ্ধে একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বব্যবস্থা উলটপালট হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

আমেরিকান পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক সাঈদ ইফতেখার আহমেদ বিবিসিকে বলেন, এই যুদ্ধ বিশ্ব রাজনীতিকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার ধারণা ছিল, স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটবে। অর্থাৎ, ইউরোপে বোধহয় আর কোনো যুদ্ধ ঘটবে না। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্ব জুড়ে উদার গণতান্ত্রিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আধিপত্য কায়েম হবে। কিন্তু তাদের হিসেবে একটা বড় ভুল ছিল।’ ‘রাশিয়ার যে আবার পুনরুত্থান ঘটতে পারে, সেখানে যে একটি পশ্চিমাবিরোধী রুশ জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে, এই সমীকরণটা গোণায় ধরা হয়নি। প্রেসিডেন্ট পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া তার অর্থনীতি এবং সামরিক শক্তিকে সংহত করার পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে আসলে এক বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। বিশ্ব জুড়ে এখন যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রাধান্য, এটি বজায় থাকবে কি না, সেটাই কিন্তু এখন পশ্চিমা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা বলে মনে করেন সাঈদ ইফতেখার আহমেদ। তিনি বলেন, সবকিছুই এখন নির্ভর করছে ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফলের ওপর। বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিশ্বে আধিপত্যের লড়াইয়ের চিন্তা পরাশক্তির মাথা থেকে না গেলে ইউক্রেন যুদ্ধ দ্রুত শেষ না হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ এখন কোন পর্যায়ে : ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বাখমুতের রাস্তায় রুশ এবং ইউক্রেন বাহিনীর মধ্যে লড়াই চলছে বলে জানিয়েছেন শহরটির ডেপুটি মেয়র আলেক্সান্ডার মারচেনকো। বে আলেক্সান্ডার মারচেনকো এটাও জানিয়েছেন, এখনো রুশ বাহিনী বাখমুতের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। মারচেনকো বলেন, শহরের কাছাকাছি লড়াই চলছে এবং রাস্তায় লড়াই হচ্ছে।  বাখমুতে এখনো ৪ হাজার বেসামরিক নাগরিক রয়েছে। তবে গ্যাস, বিদ্যুৎ বা পানি ছাড়াই তারা আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করছেন।

মারচেনকো আরো জানান, বাখমুতের এমন একটা ভবন নেই যেটি যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। শহরটি ‘প্রায় ধ্বংস’ হয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, রাশিয়ার সেনারা আসলে শহরকে অক্ষত রাখার কোনো চেষ্টাই করেননি। তারা ইউক্রেনের জনগণকে গণহারে হত্যা করতে চায়। মারচেনকো বলেন, বর্তমানে শহরে সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা অবশিষ্ট নেই, সব কেটে ফেলা হয়েছে। সেতুগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। রাশিয়ানরা আসলে বাখমুতে পোড়ামাটি নীতি ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর এক ডেপুটি কমান্ডার রেডিও সাক্ষাৎকারে বলেছেন, নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি উপেক্ষা করেও রুশ বাহিনী আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 12841
  • Total Visits: 1631730
  • Total Visitors: 4
  • Total Countries: 1714

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ সোমবার, ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ ইং
  • ১১ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (বসন্তকাল)
  • ২৪শে শা'বান, ১৪৪৬ হিজরী
  • এখন সময়, ভোর ৫:৩৩

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
     12
2425262728  
       
15161718192021
293031    
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018