অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণের হাতছানি দিচ্ছে হাওড়ের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়া-বিজয়নগরের শেখ হাসিনা সড়ক। দিগন্তজুড়ে হাওড়ের স্বচ্ছ জলরাশি ভেদ করে এঁকে বেঁকে যাওয়া সড়কটির কাজ শেষ পর্যায়ে। কার্পেটিংয়ের কাজ হলেই উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে সড়কটি।
এটি কেবল একটি সড়কই নয়, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর এগিয়ে যাওয়ার বার্তা। সড়কটির ফলে জেলা সদরের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হচ্ছে সুবিধা বঞ্চিত বিজয়নগর উপজেলার মানুষের। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে ওই অঞ্চলের শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষিসহ সামগ্রি আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে।
বহুল কাঙ্ক্ষিত সড়কটির নির্মাণকাজ শেষ দিকে হলেও এখন থেকেই এর সুফল পেতে শুরু করেছে বিজয়নগর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের অন্তত আড়াই লক্ষাধিক জনগোষ্ঠী। ইতোমধ্যে জেলা সদর ও বিজয়নগর উপজেলার মানুষ পায়ে হেঁটে ও সিএনজি অটোরিক্সাতে করে আসা-যাওয়া করতে পারছে।
এতে করে তাদের আর অন্য উপজেলার ওপর দিয়ে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হচ্ছে না। দ্রুত অবশিষ্ট কাজ শেষ করে স্বপ্নের এ সড়কটি পুরোপুরি চালুর দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, ২০২৩ সালের জানুয়ারির শুরুতেই সড়কটি পুরোপুরিভাবে যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া সম্ভব হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভারত সীমান্তবর্তী বিজয়নগর উপজেলা মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম পীঠস্থান। অঞ্চলটি এক সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের অন্তর্ভুক্ত হলেও এই জনপদের বিশাল জনগোষ্ঠীর দাবির প্রেক্ষিতে সরকার ২০০৯ সালে ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে এই অঞ্চলকে বিজয়নগর উপজেলা হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। যার প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয় ২০১০ সালের ৩ আগস্ট।
কৃষি সমৃদ্ধ বিজয়নগর উপজেলায় প্রতিবছর বিপুল অর্থের ফলসহ বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজির চাষ হয়ে থাকে। তবে সবেচেয় বড় সমস্যা ছিল জেলা সদরের সঙ্গে হাওড় বেষ্টিত এই উপজেলার সরাসরি সড়ক যোগযোগ ব্যবস্থা না থাকা।
উপজেলার অধিবাসীদের জেলা সদরে আসতে অন্তত ৩০ কিলোমিটার পথ ঘুরে আখাউড়া অথবা সরাইল উপজেলার ওপর দিয়ে আসতে হতো। ফলে তাদের অতিরিক্ত সময় ও অর্থ ব্যয় হওয়ার পাশাপাশি দুর্দশার কোন সীমা ছিল না। বিভিন্ন সময় মুমূর্ষু রোগীদের পড়তে হতো বিড়ম্বনায়।
এছাড়াও উপজেলা সদরে আসতে বিজয়নগরের পত্তন, সিঙ্গারবিল, চম্পকনগরসহ কয়েকটি ইউনিয়নের জনসাধারণকে নৌপথকেই বেছে নিতে হতো। তবে সকল বিড়ম্বনার অবসান ঘটিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতির আলোকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে জেলা সদরের সঙ্গে বিজয়নগরের সরাসরি সড়ক যোগযোগ স্থাপনের কাজ শুরু করে।
হাওড়ের বুক চিরে বিজয়নগরের পত্তন ইউনিয়নের সিমনা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর শহরের শিমরাইলকান্দি পয়েন্টে এসে (সিমনা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া) শেখ হাসিনা সড়কের সংযুক্তি ঘটানো হয়েছে। ২৪ ফুট প্রস্থের এই সড়কের ৩টি স্থানে ব্রিজ নির্মাণসহ ভাঙ্গন রোধে সড়কের দু’পাশে ব্লক স্থাপন ও সলিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। এখন বাকি রয়েছে শুধু কার্পেটিংয়ের কাজ।
২০১৮ সালের মার্চে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও হাওড়ের প্রতিকূল পরিবেশ ও করোনা মহামারীর কারণে প্রকল্পের কাজ কিছুটা ধীর গতিতে চলে। প্রায় ৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কাজটি বাস্তবায়ন করছেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
সড়কটি চালু হলে অন্তত ২০ কিলোমিটার পথ অতিরিক্ত ঘুরতে হবে না। স্থানীয়রা জানান, কৃষিতে ভরপুর এই উপজেলায় লিচু, কাঁঠাল, মাল্টাসহ বিভিন্ন ধরনের ফলমূল ও শাক সবজির চাষ হলেও তা সরাসরি জেলা সদরের বাজারে পৌঁছানো যেত না। অসুস্থ মানুষের দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করাটাও কঠিন ছিল।
তবে এখন সড়কটি হয়ে যাওয়ায় এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দুঃখের অবসান ঘটবে। সড়কটি দ্রুত চালু হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধিত হবে। সে সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর শহরেরও পরিধিও বাড়বে।
চম্পকনগর বাজারের ব্যবসায়ী মো. রাসেল জানান, জেলা শহর থেকে মালামাল আনার জন্য আখাউড়া অথবা সরাইল উপজেলা ঘুরে যেতে হয়। এতে করে পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। আর এর প্রভাব পড়ে পণ্যের মূল্যে। এছাড়া নৌপথে মালামাল আনাটা ঝুঁকিপূর্ণ। শেখ হাসিনা সড়কটি চালু হলে সহজে এবং কম খরচে পণ্য আনা যাবে জেলা শহর থেকে। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি এর সুফল পাবেন সাধারণ ক্রেতারাও।
সড়কটি চালু না হলেও হাওরের স্বচ্ছ জলরাশির সঙ্গে নীল আকাশের মিতালি দেখতে এখন থেকেই শেখ হাসিনা সড়কে ভিড় জমাচ্ছেন দর্শনার্থীরা। বর্ষাকালে এটিই হয়ে উঠবে অন্যতম পর্যটন স্পট। সব মিলিয়ে শেখ হাসিনা সড়কটিকে কেন্দ্র করে প্রসার ঘটবে ব্যবসা-বাণিজ্যের।
এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার বিভাগ (এলজিইডি) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী এটিএম রবিউল আলম বলেন, ব্রিজ, এপ্রোচসহ সড়কের সকল কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। দ্রুত সময়ের মধ্যে কার্পেটিংয়ের কাজ শুরু হবে। আগামী ১-২ মাসের মধ্যে কাজ শেষ করে জানুয়ারি নাগাদ চলাচলের জন্য পুরোপুরিভাবে উন্মুক্ত করে দেয়া সম্ভব হবে।
নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, হাওড়ের মাঝে সড়কটি নির্মাণ করতে গিয়ে বেগ পেতে হয়েছে। সে সঙ্গে করোনা মহামারীর কারণেও নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা যায়নি। সব ঠিক থাকলে জানুয়ারিতেই সড়কটিতে যান চলাচল শুরু হবে বলে জানান তিনি।
Leave a Reply