ফারুক আহমেদ, মাগুরা প্রতিনিধি : ২২ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে ১৮ তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। এ দিবসটি বিশ্বব্যাপি সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। অটিজম সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিই এ দিবস পালনের উদ্দেশ্য। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো “স্নায়ু বৈচিত্রকে বরণ করি, টেকসই সমাজ গড়ি” ১৮ তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস-২০২৫ র্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল সকাল ১০ টার সময় র্যালি ও ১০.১৫ টার সময় মাগুরা জেলা প্রশাসন এর সম্মেলন কক্ষ “চাঁদের হাট” এ মাগুরা জেলা প্রশাসন ও জেলা সমাজসেবা কার্যালয় এবং মাগুরা প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের সহযোগিতায় দিনব্যাপী প্রোগ্রাম করা হয়।
অনুষ্ঠানে মাগুরা সমাজসেবা কার্যালয় সহকারী পরিচালক জাহিদুল আলম এর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শাশ্বতী শীল।
এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত মাগুরা জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ আব্দুল কাদের, মাগুরা প্রতিবন্ধী বিষয়ক কর্মকর্তা মোঃ বাবলুর রহমান। উপস্থাপনা করেন সমাজসেবা কার্যালয় সমাজসেবা অফিসার (রেজি:) ওয়াসিম আকরাম।
বক্তব্য রাখেন মাগুরা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ডালিফা ইয়াসমিন, তরঙ্গ প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি আব্দুল আলিম, কোরআন শরিফ তেলওয়াত করে পারনান্দুয়ালী সম্মনিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রমের ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র মোঃ মেহেদী হাসান, গীতা পাঠ করে ৯ম শ্রেণির ছাত্র পল্লব কুমার বালা।
মাগুরা প্রতিবন্ধী বিষয়ক কর্মকর্তা মোঃ বাবলুর রহমান অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার নিয়ে আলোচনা করে বলেন অটিজম একটি ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডার যা সাধারণত: জীবনের প্রথম তিন বছরের মধ্যে প্রকাশ পেয়ে থাকে। অনেকের মতে অটিজম হচ্ছে শিশুদের মস্তিস্ক বিকাশের এক প্রকার প্রতিবন্ধকতা। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ, সামাজিক আচারণ, সামাজিক কল্পনা ইত্যাদি ক্ষেত্রসমূহে বেশ সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। সম্প্রতিকালে বিশেষজ্ঞরা এক ‘অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। অটিস্টিক (আত্মসংবৃত) শিশুদের চোখ, কান এবং মুখের বৈশিষ্ট্য সুস্থ শিশুদের চেয়ে অনেক সময় ভিন্নতর হয়ে থাকে। মার্তৃজঠরে ভ্রণ বিভাজন থেকে শুরু করে কৈশর কাল পর্যন্ত তাদের মুখমণ্ডল এবং মস্তিকের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। তবে এ পরিবর্তন বংশানুগতিক নাকি পরিবেশের প্রভাবে ঘটে থাকে। সে ব্যাপারে গবেষক বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট করে কিছু জানাতে পারেননি। আমেরিকার বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিনা অলরিভজ এর মতে অটিস্টিক শিশুদের মুখমন্ডল এবং চোখের আকৃতি স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক প্রশস্ত। নাক ও চিবুকসহ মুখের মধ্যবর্তি অংশটুকু অনেকটা সংকীর্ণ হয়। তাদের মুখগহবর প্রশস্ত হয়ে থাকে। নাক ও ঠোটের মধ্যবর্তি স্থানের মধ্যে ফাঁক। শিশুরা কেন অটিজমের শিকার হয় তা স্পষ্ট নয়। তবে ভ্রণ বিকাশের সময় এই ত্রুটি ঘটে যা পরবর্তী সময় বেশ কয়েক বছর ধরে চলে।
অটিজমের কারণ এখনও সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। অনেকে মনে করেন মস্তিষ্কের কিছু কোষের অস্বাভিক রাসায়নিক ত্রিয়াকলাপ কিংবা মস্তিস্ক অস্বাভাবিক গঠন এর জন্য দায়ী আবার অনেকের মতে বংশগতির কারণে এরুপ অস্বাভাবিকতার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
অটিজমের ব্যাপ্তি বেশ ব্যাপক। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেও প্রত্যেকটি দৃষ্টান্ত স্বতন্ত্র। তবে অটিস্টিক শিশুদের ক্ষেত্রে সামাজিক আচরণে সমস্যা, সাধারণ খেলাধূলা ও কল্পনা যুক্ত খেলার ক্ষেত্রে সমস্যা, মৌখিক ও অমৌখিক যোগাযোগের সমস্যা, পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ, এতদ্ব্যতীত অটিস্টিক ব্যক্তিরা দেখা, শুনা, স্বাদ, গন্ধ, স্পর্শ ও চলাচলে কোনো না কোনভাবে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে থাকে।
অটিজম শনাক্তকরণ: অন্যান্য অসুস্থতার ন্যায় কোন ল্যাবরেটরি টেস্ট দ্বারা’ অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার’ শনাক্ত করা সম্ভব নয়। কোন ব্যক্তি বা শিশুর ব্যবহারিক কার্যকলাপ, যোগাযোগের দক্ষতা এবং বিকাশের ধারা দেখে এ অসুস্থতা শনাক্ত করা হয়ে থাকে। তবে কিছু পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে একজন অটিজম শনাক্তকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখাতে পারেন। অটিজমের প্রতিকার: বিভিন্ন রকম অভিব্যক্তির সমন্বয়ে অটিজমের উদ্ভব ঘটে বিধায় একটি শিশু বেড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপের দিকে নিবিড়ভাবে খেয়াল রাখতে হবে। স্বাভাবিক অভিব্যক্তির অভাব পরিলক্ষিত হলে বিশেষজ্ঞ অথবা চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণসহ হেয়ারিং টেস্ট, ভিজুয়াল টেস্ট, স্ক্রিনিং টেস্ট ফর অটিজম করানো যেতে পারে। অটিজম নামক প্রতিবন্ধকতা প্রতিরোধের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন একে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শনাক্ত করা। দ্রুত শনাক্ত করে শৈশবে যথাযথ চিকিৎসা ও নিবিড় পরিচর্যা করলে অটিস্টিক শিশুদের মধ্যে স্বাভাবিক অভিব্যক্তির বিকাশ ঘটানো সম্ভব। পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে অটিজমের শিকার শিশুদের চাহিদা বা আগ্রহের উপর ভিত্তি করে তাদের জন্য মজার ছবি এবং অনুষ্ঠান বা মেলার আয়োজন করা। এর মাধ্যমে এসব শিশুরা আত্মনির্ভরশীল হওয়ার শিক্ষা লাভে সমর্থ হয়, স্পিচ এবং ল্যাংগুয়েজ থেরাপির ব্যবস্থা করা, অকুপেশনাল এবং ফিজিক্যাল থেরাপির ব্যবস্থা করা, অভ্যাসগত আচার-আচারণ বিশ্লেষণ করা।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শাশ্বতী শীল বলেন অটিজম নামক প্রতিবন্ধকতা সফল ও সার্থকভাবে মোকাবেলা লক্ষ্যে বর্তমান সরকার বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে অটিজম রির্সোস সেন্টার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের অঙ্গনে চালু করা হয়েছে একটি অটিজম রির্সোস সেন্টার। উক্ত সেন্টার সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার নিমিত্ত জিও-এনজিও সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে। অকুপেশনাল থেরাপিস্ট এর মাধ্যমে অটিজমের শিকার শিশু অথবা ব্যক্তিবর্গকে উক্ত সেন্টার থেকে থেরাপি ও কাউন্সিলিং সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এ ছাড়া নিয়মিত অটিস্টিক শিশুর অভিভাবকদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
মাগুরা সমাজসেবা কার্যালয় সহকারী পরিচালক জাহিদুল আলম বলেন অটিস্টিক স্কুল অটিজম রিসোর্স সেন্টারের সাফল্যের ভিত্তিতে ২০১১ সালে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ক্যাম্পাসে একটি অবৈতনিক অটিস্টিক স্কুল চালু করা হয়েছে। সেন্টার ফর নিউরোডিভেলপমেন্ট এ্যান্ড অটিজম ইন চিল্ড্রেন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা হয়েছে ‘সেন্টার ফর নিউরোডিভেলপমেন্ট এ্যান্ড অটিজম ইন চিল্ড্রেন’। কর্মসংস্থানে অটিজম সম্পন্ন ব্যক্তি অগ্রাধিকার পেলে দেশে আর্থসামাজিক অগ্রগতির সূচক বৃদ্ধি পাবে। অটিজম সচেতনতা দিবস উদযাপনের মাধ্যমে এ বার্তা পৌছে যাক সমাজের স্তরে।