অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : ১৯৭১ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে যে রাজনৈতিক ও সামরিক সংকট ঘনীভূত হয়, তা একটি আঞ্চলিক সমস্যা ছিল। চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের ফলে তা একটি আন্তর্জাতিক সংকটে রূপ নেয়। নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানের ভৌগোলিক সংহতি রক্ষার প্রশ্নটি তাদের ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত রাজনীতির অংশ করায় তা দুই পরাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রূপ নেয়। কিসিঞ্জার, এই রণকৌশলের প্রণেতা এই যুক্তি দ্বারা চালিত হয়েছিলেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি ভারতের পক্ষে ও চীনের বিপক্ষে কোনো সামরিক পদক্ষেপ নেয়, সে পরিস্থিতিতে আমেরিকার চুপ করে থাকা ঠিক হবে না।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস। চলছে মুক্তিসংগ্রাম। পাকিস্তানি বাহিনীকে তখন চার দিক থেকে একটু একটু করে ঘিরে ধরছে বাঙালি মুক্তিসেনার দল। ইয়াহিয়া খান এই সময় ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ৩রা ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় এক জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। তখনই খবর পেলেন, ভারতের ৯টি বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ করেছে পাকিস্তানি বিমান বাহিনী। দিল্লিতে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকে যোগ দিতে ইন্দিরা গান্ধী দিল্লি ফিরে গেলেন খুব দ্রুত। শেষ রাত নাগাদ ভারতও পাকিস্তানের ঘাঁটিতে গোলাবর্ষণ শুরু করে, সম্মুখযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ভারত-পাকিস্তান। ভারতের ওপর আক্রমণ করার ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে মিত্রদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার আশা নিয়েই মাঠে নেমেছিলেন ইয়াহিয়া খান। তার হিসাব অনুযায়ী ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ’ শুরু হয়ে গেলে এটি থামানোর জন্য হলেও কূটনৈতিক মহলে মার্কিন তৎপরতা শুরু হবে। তখন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিষয়টি গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। এমন আশা ছিল পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে ভয়াবহ দুর্যোগ ঘনিয়ে এসেছিল। এমন একটি দুর্যোগ যে আসতে যাচ্ছে, তা নিশ্চিত জেনে নিক্সন ও কিসিঞ্জার সেই পথে হেঁটেছিলেন পাকিস্তানকে চূড়ান্ত পরাজয় থেকে উদ্ধার করতে এবং পাকিস্তানের মিত্র চীনকে প্রভাবিত করতে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের অন্তিম মুহূর্তে কিসিঞ্জার-নিক্সন আশায় ছিলেন যে, তাদের চীনা বন্ধুরা প্রতীকী অর্থে হলেও কোনো না কোনো সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। চীনাদের কাছে তেমন পদক্ষেপের প্রস্তাব করে একটি পরিকল্পনা নিয়ে কিসিঞ্জার ও চীনা রাষ্ট্রদূতের মধ্যে নিউ ইয়র্কে একটি গোপন বৈঠকও হয়। কিন্তু চীন সে পথে যায়নি।
পারমাণবিক শক্তিধর দুই রাষ্ট্র আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, ব্যাপারটি যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে সে ব্যাপারে ভালোই ধারণা ছিল চীনের। চীন ডিসেম্বরের ১২ তারিখ আমেরিকাকে জানিয়ে দেয় উপমহাদেশে কোনোভাবেই চীন সামরিক হস্তক্ষেপে উত্সাহী নয়, বরং নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে এই নিয়ে আবারও আলোচনা করতে আগ্রহী তারা। চীনের এই সিদ্ধান্তের ফলে আমেরিকা হঠাত্ করেই পিছিয়ে যায়। সপ্তম নৌবহর তখন বঙ্গোপসাগর থেকে ২৪ ঘণ্টার দূরত্বে মালাক্কা প্রণালিতে। পরবর্তী সিদ্ধান্তের আগ পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করতে বলা হয়ে এই নৌবহরকে। জেনারেল নিয়াজির কাছেও এই সংবাদ পৌঁছে দেওয়া হয়। ঢাকায় বসে নিয়াজির প্রতীক্ষার মুহূর্ত দীর্ঘ হতে থাকে।
৪ ডিসেম্বরের তৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রীর যৌথ সিদ্ধান্তে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি জরুরি বার্তা পাঠানো হয়। যেখানে বলা হয়, ‘পাকিস্তানের সর্বশেষ আক্রমণের জবাব দিতে ভারতীয় বাহিনী এবং বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর মিলিত ভূমিকা সফলতার হতে পারে, যদি এই দুটি দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।’
৪ ডিসেম্বর থেকেই মিত্রবাহিনী সম্মিলিত আক্রমণ শুরু করে। আর ৬ ডিসেম্বর ভুটানের এবং এর কয়েক ঘণ্টা পর একই দিনে ভারতের বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্কেরও শুরু হয়। মিত্রবাহিনীর নিয়মতান্ত্রিক আক্রমণের পাশাপাশি বাঙালি গেরিলাদের অতর্কিত হামলায়ও পাকিস্তানি বাহিনী ধীরে ধীরে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় স্বাধীনতা।
তবে, পাকিস্তানের নকশায় তেমন একটা ভুল ছিল না। ডিসেম্বরের ৪ তারিখে ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ মিটিং অন ইন্দো-পাকিস্তান হস্টিলাইটিজ নামে বৈঠকে যুদ্ধবিরতির এবং সেনা প্রত্যাহারের প্রস্তাব আনেন হেনরি কিসিঞ্জার এবং সেই প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে তোলার প্রস্তাব করেন। সেই সময় নিরাপত্তা পরিষদে আমেরিকার প্রতিনিধি আরেক দক্ষ কূটনৈতিক সিনিয়র জর্জ বুশ। তিনি প্রস্তাব দিলেন—‘অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা, ভারত ও পাকিস্তানের সৈন্যদের নিজ নিজ সীমান্তের ভেতরে ফিরিয়ে নেওয়া এবং সেই সিদ্ধান্ত কার্যকরের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবকে ক্ষমতা দেওয়া হোক।’ মার্কিন প্রস্তাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘একতরফা’ আখ্যা দিয়ে ভেটো দেয়। মূলত পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নির্যাতন, পাকিস্তানের সামরিক অভিযানের পরে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি ভারতে শরণার্থী হিসেবে যাওয়ায় ভারতের ক্ষতির ব্যাপারটি বিবেচনা না করেই এই প্রস্তাব কোনোভাবেই গৃহীত হতে পারে না—এই যুক্তিতেই মার্কিন প্রস্তাবে ভেটো দেয় সোভিয়েত। ব্রিটেন আর ফ্রান্স অনেকটা নিরপেক্ষ দর্শক হয়ে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে।
পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা যে ফন্দি নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন, তা ভেস্তে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর কারণে। আর তাই সোভিয়েত প্রশাসনকে চাপে ফেলার উপায় খুঁজতে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট নিক্সন সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভকে জরুরি বার্তা পাঠান। বলেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য ভারতকে সামরিকভাবে নিষ্ক্রিয় না করা হয় তাহলে মস্কোতে প্রস্তাবিত সোভিয়েত-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়।’
একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর চাপ বাড়ছে অন্যদিকে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একের পর এক ঘাঁটির পতন ঘটছে। ডিসেম্বরের ৭ তারিখ মুক্ত হয় পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটি যশোরের। এক-এক করে বাকি শহরগুলোও মুক্তির অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে। গভর্নর মালিক ইয়াহিয়াকে এক জরুরি বার্তায় জানান যে, প্রত্যাশিত বৈদেশিক সাহায্য না পেলে যুদ্ধ আর বেশি দিন নিজেদের পক্ষে ধরে রাখা যাবে না। ইয়াহিয়ার পক্ষে তখন এই বার্তাকে বহুগুণে বর্ধিত করে হোয়াইটহাউজে পাঠানো ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না।
পাকিস্তানের মেজর সিদ্দিক সালিক উইটনেস টু সারেন্ডার গ্রন্থে লিখেছেন, নিয়াজি এবং পূর্ব পাকিস্তানে তার সহকর্মীরা যখন যুদ্ধবিরতি নিয়ে ভাবছেন, তখন পাকিস্তান হাইকমান্ড আশ্বাসবাণী ছড়াতে থাকে, ‘নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থন’ আসছে বাইরের দুনিয়া থেকে। বিশেষভাবে বলা হয়, ‘উত্তর থেকে ইয়েলো এবং দক্ষিণ থেকে হোয়াইটরা আসছে।’ ইয়েলো বলতে চীন এবং হোয়াইট বলতে যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানো হয়েছিল। এরা এগিয়ে এলে ভারতের প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন নিষ্ক্রিয় করা যাবে। এই ‘সুখবর’ বিভিন্ন সেনাছাউনিতে প্রচার করা হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত, কখন চীনারা নেমে আসবে। আর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকত কখন আমেরিকা আসবে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি।
অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের পক্ষে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন নিয়াজি আর মিত্রবাহিনীর পক্ষে জগজিৎ সিং অরোরা। সেই আত্মসমর্পণের দিনেই বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ প্রান্তে প্রবেশ করে সপ্তম নৌবহর। কিন্তু ততক্ষণে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের নাম লেখা হয়ে গেছে।
Leave a Reply