অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : চট্টগ্রাম ও সিলেটের পর চা আবাদে তৃতীয় অবস্থানে থাকার পর চা উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থান দখল করে নিয়েছে পঞ্চগড় জেলার চা শিল্প। গত দুই যুগে নীরব চা বিপ্লবে বদলে দিয়েছে দেশের উত্তরের সীমান্ত জনপদ পঞ্চগড়কে। এক সময়ের কঠিন দারিদ্রতা ও অর্থনৈতিক সংকট ঘুচিয়ে বদলে দিয়েছে জীবনযাত্রা। সবুজ চা শিল্পকে কেন্দ্র করে অগ্রসর করেছে অনুন্নত জনগোষ্ঠীকে। বদলেছে আর্থ-সামাজিক, কর্মসংস্থান ও আবাসন স্থাপত্য।
২০০০ সালের দিকে এ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় চা আবাদ। তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি লিমিটেড ও কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট। ২০০১ সালে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইন্সটিটিউটের (বিটিআরআই) একটি উপকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে পঞ্চগড়ে প্রথম নারী চা চাষি আমেনা খাতুন ,আ: জব্বার, মতিয়ার রহমান, সিরাজুল ইসলাম, ইসাহাক আলী মন্ডল, আবদুর রহমান, আবুল হোসেনসহ কয়েকজন ক্ষুদ্র চাষি চা চাষ শুরু করেন। এখান থেকেই বাড়তে থাকে ব্যাপকতা । অনাবাদি পতিত জমি হয়ে উঠেছে সমতলের চা ভূ-স্বর্গ। চা অর্থনীতির সাথে যুক্ত হয়েছে পর্যটনের নতুনমাত্রা।
দুই যুগে চা শিল্পের নীরব বিপ্লবে এখন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের পরের অবস্থানে পঞ্চগড়। তৃতীয় চা অঞ্চল হলেও চা উৎপাদনে দ্বিতীয়। এ বৃহত্তর শিল্পের চাষিদের চা পাতার ন্যায্য মূল্য পেতে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২০২৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর এ জেলায় চালু করা হয় বহুল কাঙ্ক্ষিত তৃতীয় চা নিলাম কেন্দ্র। এর আগে ২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর পঞ্চগড়ে দেশের তৃতীয় চা নিলাম কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেয় সরকার।
চাষিদের অভিযোগ, বিগত কয়েক বছর ধরেই রেকর্ড পরিমাণে কাচা পাতার উৎপাদন বাড়লেও কৃষকদের কাচা চা পাতার ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় হতাশায় পড়েছেন ক্ষুদ্র চা চাষিরা। চা পাতার ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় চরম দুর্দশায় পড়েছেন তারা। শক্তিশালী সিন্ডিকেটের যাঁতাকলে প্রতিনিয়ত লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। ইংরেজ নীলকরদের মতোই চুষে নেয়া হচ্ছে কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য। কয়েক বছর ধরে লোকসান গুনতে গুনতে অনেকে হতাশ হয়ে চা আবাদে মুখ ফিরিয়ে নিলেও হাল ছাড়ছেন না চা চাষিরা। তাদের অভিযোগ, বর্তমানে পাতার কিছুটা পাতার দাম থাকলেও পার্সেন্ট নামে কেটে নেয়া হচ্ছে উৎপাদিত চা পাতার শতকরা ৩০-৩৫ শতাংশ। এতে লোকসান গুনতে গুনতে নীরবে কান্না ঝরছে কৃষকদের। এ পরিস্থিতি দ্রুত নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ চান তারা। স্বপ্ন দেখছেন সামনে সুদিন ফিরবে। যেভাবে সুদিন শুরু হয়েছিল চা আবাদের যাত্রাকালে।
সমতলের চা বাগানে বেকার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। হাজার হাজার নারী-পুরুষের কাজের কর্মসংস্থান হয়েছে। অর্থনীতিতেও স্বাবলম্বী হয়েছেন তারা। চা অর্থকরী ফসল হিসেবে বছরের নয় মাস চলে বাগানের বিভিন্ন কাজ। বাগানের পরিচর্যার কাজ হিসেবে ফ্লাইং কাটিং অর্থাৎ গাছের মাথা ফ্লাইং কাটিং, পুনিং, সার ও কীটনাশক স্প্রে, পানি নিষ্কাশন। তিন মাস বাগান পরিচর্যার পর নতুন কুঁড়ি গজে উঠে। এর মাস খানেকের মধ্যেই শুরু হয় পাতা তোলা। শ্রমিকরা বাগানে বাগানে দলবেঁধে কেজিতে ৩-৪ টাকা চুক্তিতে পাতা তুলেন। দিনশেষে শ্রমিকদের হাতে আসে ৫শ থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত। পাতার দাম বাড়লে শ্রমের দাম বেড়ে যায়। কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে চা কারখানাগুলোতেও।
চা শিল্প ঘিরে শুধু চা চাষি ও চা শ্রমিক অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটেনি। শ্রমিক থেকে অনেকেই হয়ে উঠেছেন চা বাগানের মালিক। নিজের জমি না থাকলেও অন্যের কাছ থেকে দীর্ঘ মেয়াদে ভূমি লিজ নিয়ে বাগানের মালিক হয়েছেন। অর্থনৈতিক সচ্ছলতায় বদলে গেছে আর্থ সামাজিকতায় বেড়েছে আভিজাত্যের পরশ। ছনের ছাউনির জায়গায় ইট-কংক্রিটের ঘর-বাড়ি। স্ত্রী-সন্তানের ভরণ-পোষণ, লেখাপড়া খরচ করতে পারছে। উন্নত হয়েছে গ্রামীণ পরিবেশ। আধুনিকতার শহরের আদলে গড়ে উঠছে চা গ্রাম ।
চা বোর্ডের আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০০০ সালে বেশ কয়েকটি কোম্পানি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় চায়ের বাগান গড়ে তোলা হয়। এরপর পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলের পাঁচটি উপজেলায় ক্ষুদ্র চাষি পর্যায়ে চা চাষ ছড়িয়ে পড়ে। পঞ্চগড় জেলার পর ২০০৭ সালে লালমনিরহাট ও ঠাকুরগাঁও এবং ২০১৪ সালে দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলায় চা চাষ শুরু হয়। উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায় বর্তমানে নিবন্ধিত ১০টি ও অনিবন্ধিত ২০টি বড় চা-বাগান (২৫ একরের ওপরে) রয়েছে।
এ ছাড়া ২ হাজার ১৭৪টি নিবন্ধিত ও ৬ হাজার ১৯৭টি অনিবন্ধিত ক্ষুদ্রায়তনের চা-বাগান (২৫ একরের কম) আছে। ২০২৩ সালে উত্তরাঞ্চলে ১২ হাজার ১৩২ দশমিক ১৮ একর জমিতে চা চাষ হলেও এবার কিছুটা কমেছে। বর্তমানে উত্তরাঞ্চলে ১১ হাজার ৫২৬ দশমিক ৮৭ একর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। এদিকে উত্তরাঞ্চলের চা চাষের পরিধি ও উৎপাদন বিবেচনায় ২০২৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর পঞ্চগড়ে চায়ের তৃতীয় নিলাম কেন্দ্র (অনলাইনভিত্তিক) চালু হয়েছে। উত্তরাঞ্চলে এখন পর্যন্ত ৫৩টি চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা অনুমোদন নিয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চগড় জেলায় ২৮টি ও ঠাকুরগাঁও জেলায় একটি কারখানা চালু রয়েছে।
পৃথিবীর সেরা চা উৎপাদিত হচ্ছে এখানে। বাংলাদেশে একমাত্র প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে ১০০ ভাগ অর্গানিক চা উৎপাদন করছে কাজী অ্যান্ড কাজী। তাদের চা বাগান সম্পূর্ণ কম্পোজিট টি এস্টেট। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশে অর্গানিক চা উৎপাদনে খ্যাতি পেয়েছে কাজী অ্যান্ড কাজী। এই অর্গানিক চা উৎপন্ন হয়ে বিক্রি হচ্ছে লন্ডনের হ্যারোড অকশন মার্কেটে। রপ্তানি হচ্ছে দুবাই, জাপান ও আমেরিকায়। দেশীয় বাজারে চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করেছে এখানকার চা।
সমতলে চা বাগান ঘিরে সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছে পর্যটন শিল্পের। গ্রামীণ পর্যটন হিসেবে ইকো ট্যুরিজম ও গ্রিন ট্যুরিজমের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে কৃষিতে চা শিল্প। পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের উত্তরের সীমান্ত জনপদ পঞ্চগড়ে গড়ে উঠা চা শিল্প গ্রামীণ পর্যটনে নতুন মাত্রা দিয়েছে। চা শিল্পটাকে ফার্মিং ট্যুরিজমের মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। প্রতি বছর সিলেটে, মৌলভীবাজার ও চট্টগ্রামে চা বাগান দেখতে পারি দেয় লাখ লাখ পর্যটক। সিলেট-চট্টগ্রামের মতোই চা বাগান পর্যটনে নতুনমাত্রা তৈরি করেছে।