21 Nov 2024, 02:51 pm

গণতন্ত্র-মানুষের অধিকার —- এম এ কবীর (সাংবাদিক)

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

বাবা আদম এবং মা হাওয়ার সম্পর্ক সূত্রে মানবজাতির বিকাশ। সেই ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। মানুষের মধ্যে নানা ভাব আছে, আছে অনুভাবও। রসশাস্ত্রে এসব বিষয়ের বিশ্লেষণ রয়েছে। বীর রস, করুণ রস, ভক্তি রস, বাৎসল্য রসের চর্চা মানব সমাজে বহুলভাবেই হয়। তবে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসার কাঙ্খিত পরিণতি দেখতে চেয়েছে। ইহলৌকিকবাদী বর্তমান সভ্যতায় দাম্পত্য জীবনের বিপরীতে, দায়িত্বমুক্ত এক ধরনের জীবনের উদাহরণও লক্ষ্য করা যায়। এসবে মানবজাতির সুস্থ বিকাশের কোনো বার্তা নেই, বরং আছে বিকৃতি ও অসুস্থতার দুঃসংবাদ। দাম্পত্য জীবনের সামাজিক রূপ হলো বিয়ে। বিয়ের পবিত্র সম্পর্কে জড়িত থাকেন নর-নারী, পিতা-মাতা, পরিবার এবং সমাজ। আর বিয়ের সম্পর্ককে মহীয়ান করে তোলে নর-নারীর পারস্পরিক ভালোবাসা, সম্মান-সম্ভ্রমবোধ ও দায়িত্ব সচেতনতা। এমন দাম্পত্য জীবনে যে নতুন প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটবে, তারাই হবে মানবজাতির ভবিষ্যৎ সম্পদ। মানবজাতির এমন স্বাভাবিক সম্পর্কসূত্রের বিপরীতে আজকাল প্রবৃত্তিপ্রসূত নানা খেয়ালিপনার প্রকাশও লক্ষ্য করা যায়, যা সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। নিউইয়র্ক পোস্টের এক প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ হয়, এক তরুণী প্রেমিক চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। বিজ্ঞাপনের ধরনও আলাদা। রীতিমতো নির্ধারিত ফরম পূরণ করে আবেদন করতে হবে প্রেম-প্রার্থীকে। অসংখ্য প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হতে পারলেই কেউ প্রেমিক হতে পারবেন ভেরা ডেকম্যানস-এর। এভাবেই নিজের  প্রেমিক বেছে নিতে চান নেদারল্যান্ডসের এই তরুণী। ইতোমধ্যে তিন হাজারের বেশি প্রার্থী আবেদন ফরম পূরণ করে পাঠিয়েছেন। আবেদনপত্রে প্রার্থীদের কাছে তাদের কাজ ও  প্রেম সম্পর্কিত ইতিহাস নিয়ে একগাদা প্রশ্ন রাখা হয়েছে। প্রশ্নের মধ্যে আছে, কতজন সাবেক  প্রেমিকা ছিল, প্রার্থী পূর্ণ সময় চাকরি করে কিনা, গাড়ি আছে কিনা, প্রার্থী কার্টুন দেখতে পছন্দ করে কিনা এমন উদ্ভট প্রশ্নও আছে ওই ফরমে। ভেরা ডেকম্যানস বলেন, প্রেমিককে মজার মানুষ হতে হবে, গানে ভালো রুচি থাকতে হবে এবং নিজে আয় করতে হবে। এছাড়া তাকে সৎ, অনুগত ও কার্টুন দেখার মানসিকতাসম্পন্ন হতে হবে। ভেরা ডেকম্যানস পেশায় একজন মডেল। বর্তমানে বসবাস করছেন লন্ডনে। আয়-রোজগার তিনি ভালোই করেন। আবেদন ফরমে ভেরা দাবি করেছেন, মডেলিং করে তিনি মাসে প্রায় ৩ কোটি ৯৫ লাখ ৭২ হাজার ৪৯৬ টাকা (৩ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার) আয় করেন। অর্থের একটা উত্তাপ আছে। হয়তো এই কারণে তিনি প্রেমিকদের আবেদন করতে বলেছেন। ভেরা বাছাই করবেন যোগ্য প্রেমিক, যেভাবে চাকরি প্রার্থীদের বাছাই করা হয়। তিনি যোগ্যতার যেসব মাপকাঠি ঠিক করেছেন সেখানে ‘অনুগত’ শব্দটিও আছে। তবে সেখানে দাম্পত্য জীবনের কাঙ্খিত বার্তা নেই।

জগত ও জীবনের সর্বক্ষেত্রে পুনর্জাগরণকে রেনেসাঁস বলে অভিহিত করা হয়। যে পুনর্জাগরণ সব শৃঙ্খল, কুসংস্কার, শোষণ, বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ নির্দেশ করে ব্যাপক অর্থে তাই রেনেসাঁস। রেনেসাঁস ঘোষণা করে মানুষের মুক্তি। ব্যক্তি মানুষের স্বাধীন সত্তার স্বীকৃতি দিয়েছিল ইউরোপের রেনেসাঁস। ইউরোপের মধ্যযুগকে বলা হয় কৃষ্ণ সময় বা অন্ধকার যুগ। তখন সামন্তবাদী শোষণ এবং ক্যাথোলিক চার্চের অনাচার ও নিষ্পেষণে মানুষের জীবন ছিল জর্জরিত। অধিকারহারা ইউরোপবাসী যেন ছিল গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন। কিন্তু কোনো জনগোষ্ঠী যে চিরদিন ঘুমিয়ে থাকে না তার বহু প্রমাণ মানব ইতিহাসে পাওয়া যায়। সে সময়ে করের বোঝায় মানুষের জীবন ছিল অতিষ্ঠ। চার্চের সর্বশেষ অনাচারের উদাহরণ ছিল স্বর্গে যাবার সার্টিফিকেট বিক্রি (ঝবষষ ড়ভ ওহফঁষমবহপব)। এ ধরনের চরম অত্যাচার ও নিপীড়নের ফলে অবশেষে ইউরোপবাসীর নিদ্রা ভঙ্গ শুরু হয়।

পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপে শুরু হয় এক সামাজিক পালাবদলের এবং রেনেসাঁসের মাধ্যমেই এর সূত্রপাত। ১৪৫৩ সাল ইউরোপের ইতিহাসে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় যখন থেকে মধ্যযুগের অবসান এবং আধুনিক যুগের (গড়ফবৎহ অমব) শুরু। ১৪৫৩ সালে অটোমান শাসকেরা যখন কনস্টান্টিনপল দখল করে তখন সেখানকার স্থানীয় অধিবাসী গ্রিকরা রোমে পালিয়ে যায়। গ্রিক এবং রোমানরা ছিল এক উন্নত সংস্কৃতি ও সভ্যতার ধারক-বাহক। এ দুই সংস্কৃতির মিলনে যে উন্নত জীবন ও চিন্তা-চেতনার মিশ্রণ ঘটে তারই ফলে সৃষ্টি হয় রেনেসাঁসের। রেনেসাঁস মানুষের দৃষ্টিকে যোজনা করে লোকাতীত থেকে লোকায়তে, উদ্রিক্ত করে বিশালতার আহ্বান, যা কিছু দুর্জেয়, যা কিছু বিপজ্জনক তার দিকে প্রসারিত করে মানুষের দুঃসাহসিকতা। জন্ম হয় ব্যক্তি দুঃসাহসী,সংগ্রামী এবং অর্জননিষ্ঠ ব্যক্তি যা আধুনিক সমাজ ও সভ্যতার ভিত্তি। রেনেসাঁস জন্ম দেয় আধুনিককালের ব্যক্তি চেতনার ও ইতিহাস চেতনার। মানুষের মনকে মুক্তি দেয় সামন্ত সমাজের অজস্র বাঁধন থেকে, মৃত ঐতিহ্যের শাসন থেকে। মানুষের মন নতুন আবিষ্কার,সৃষ্টি ও কল্পনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। এ আত্মিক বিস্ফোরণের ফসল হলো ইউরোপের রেনেসাঁস। মানুষের মহত্ত্ব, সাফল্য অথবা ব্যর্থতা নির্ভর করে তার নিজস্ব ক্ষমতার ওপর। নিজস্ব শক্তিতে বলীয়ান, কর্মঠ, যুক্তিবাদী ব্যক্তিই বিপ্লবের পর বিপ্লবের ভেতর দিয়ে ইউরোপের সমাজ ও সভ্যতাকে বিকাশের পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

রেনেসাঁস বহু ঘটনার জন্ম দেয় যার ফলে পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মার্টিন লুথার ও জন কেলভিনের নেতৃত্বে রিফরমেশন আন্দোলন যা প্রটেস্ট্যান্ট আন্দোলন নামে খ্যাত। প্রটেস্ট্যান্ট আন্দোলন যে মূল্যবোধ, যে জীবন ধারণা প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব মানুষের জীবনে ও সমাজে পরিলক্ষিত হয়। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নতুন নতুন ভৌগোলিক আবিষ্কার। মানব মুক্তির স্পৃহা ও আকাঙ্খা বাড়তে থাকে। ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে মানুষ সোচ্চার হতে থাকে। সংগঠিত হয় আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বাণী নিয়ে সংগঠিত হয় ফরাসি বিপ্লব। এভাবে ধীরে ধীরে মানবজাতি গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হয়।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের আগে পৃথিবীতে সেসব সরকারব্যবস্থা প্রচলিত ছিল,তার মধ্যে রাজতন্ত্র,অভিজাততন্ত্র এবং একনায়কতন্ত্র উল্লেখযোগ্য। রাজতন্ত্রে (গড়হধৎপযু), অভিজাততন্ত্রে (অৎরংঃড়পৎধপু) এবং একনায়কতন্ত্রে (উরপঃধঃড়ৎংযরঢ়) রাজনীতি ও ক্ষমতা ছিল শাসকশ্রেণীর কুক্ষিগত। রাজতন্ত্রে (জঁষব ড়ভ শরহম) রাজা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, অভিজাততন্ত্রে (জঁষব ড়ভ ভব)ি সর্বময় ক্ষমতা শুধু অভিজাতদের হাতে, আর একনায়কতন্ত্রে সর্বময় ক্ষমতার মালিক ব্যক্তি একনায়ক। একনায়ক নিষ্ঠুর শাসন ও শোষণের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ কায়েম করে। উপরোল্লিখিত রাষ্ট্রব্যবস্থাগুলোতে রাজনীতি জনকল্যাণমুখী হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। সব রাষ্ট্রে রাজনীতির একমাত্র উদ্দেশ্য শাসক এবং শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করা এবং শাসিতদের শোষণ ও বঞ্চিত করা। তাই যুগে যুগে সমাজ দার্শনিকরা এবং রাজনীতি বিজ্ঞানীরা গণমানুষের মুক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন নতুন তত্ত্ব দিয়েছেন এবং তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য নব নব রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থা কায়েমের কথা বলেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ফরাসি বিপ্লবোত্তর দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাক রুশো ও ভলতেয়ারের কথা। রুশো তার ঝড়পরধষ ঈড়হঃৎধপঃ গ্রন্থের শুরুতেই উচ্চারণ করেন, ‘গধহ রং নড়ৎহ ভৎবব নঁঃ বাবৎুযিবৎব যব রং রহ পযধরহ’ অর্থাৎ মানুষ স্বাধীন হয়েই জন্মগ্রহণ করে কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত হয়। তাই তিনি মানুষকে শৃঙ্খলমুক্ত করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। রুশোর ‘এবহবৎধষ রিষষ’ অর্থাৎ জনসাধারণের অভিমতের ভিত্তিতে যে সামাজিক চুক্তির তত্ত্ব প্রদান করেন প্রকৃত অর্থে সেটাই গণতন্ত্রের মতবাদ।

বর্তমান পৃথিবীর গণতন্ত্রমনা মানুষ ধীরে ধীরে রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, একনায়কতন্ত্র এবং ফ্যাসিবাদ প্রত্যাখ্যান করেছে। কারণ এসব রাজনৈতিক তথা সরকারব্যবস্থা মানুষের কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণই সাধন করেছে। নিপীড়ন, নিষ্পেষণ ও শোষণে মানুষের জীবনকে করেছে দুর্বিষহ। তাই জনগণ এসব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে, বিদ্রোহ করেছে, বিপ্লব করেছে। পতন হয়েছে ফ্যাসিবাদী একনায়ক শাসক জার্মানির হিটলারের, ইটালির মুসোলিনীর; পতন হয়েছে ফরাসি অত্যাচারী রাজা ষোড়শ লুইর এবং অত্যাচারী রানী মেরি আতোয়ির। সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার (টহরঃু, ষরনবৎঃু ধহফ ভৎধঃবৎহরঃু) আদর্শে অনুপ্রাণিত ফরাসি জনগণ রাজতন্ত্রের সমাধি রচনা করেছে। পতন হয়েছে রাশিয়ার অত্যাচারী শাসক জারের এবং চীনের চিয়ান কাইশেকের। রুশ এবং চীন বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এক নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থা কায়েম করা হয় যার নাম সমাজতন্ত্র এবং যার চূড়ান্ত লক্ষ্য সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু পৃথিবীর যে অঞ্চলে আমাদের বসবাস, আমাদের যে ভূখন্ড বাংলাদেশ, সেখানে এ রকম কোনো রেনেসাঁসের সৃষ্টি হয়নি। বস্তুতপক্ষে প্রাচ্যের সমাজ এ ধরনের রেনেসাঁস এবং বিপ্লবে মন্দ্রিত হয়ে ওঠেনি। প্রাচ্য সমাজ সম্পর্কে ধারণা হচ্ছে তা সময়হীন। আবহমানকাল ধরে একই ছকে নিশ্চল। রাজবংশের উত্থান-পতন,আগ্রাসন, জয়-পরাজয়ের ইতিহাস ছাড়া তার কোনো ইতিহাস নেই। প্রাচ্যের মানুষ নিয়তির কাছে নত,ক্ষুদ্রতম সীমার মধ্যে বদ্ধ। প্রাচ্যে তাই ইউরোপের মত আধুনিক সভ্যতার বিকাশ হওয়া সম্ভব ছিল না। ঔপনিবেশিক এবং সাম্রাজ্যবাদী শোষণই ছিল প্রাচ্যের নিয়তি। প্রাচ্যের দেশগুলো বারবার একনায়কতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসনের কবলে পড়েছে। প্রাচ্য সমাজের নিশ্চলতাকে বিভিন্ন লেখক বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কার্ল উইটফগেল ‘জলভিত্তিক সমাজের তত্ত্বের’ (ঐুফৎধঁষরপ ঞযবড়ৎু) সাহায্যে বিশ্লেষণ করেছেন কেমন করে এসব দেশের সরকার স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। তার বিখ্যাত গ্রন্থ (ঙৎরবহঃধষ উবংঢ়ড়ঃরংস) এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও আলোচনা রয়েছে। প্রাচ্য সমাজেরই অন্তর্গত প্রাক ব্রিটিশ ভারতীয় সমাজের বৈশিষ্ট্যের কথা বলতে গিয়ে মার্কস উল্লেখ করেন, ‘ভারতীয় সমাজের কোনো ইতিহাস, অন্তত সুপরিজ্ঞাত ইতিহাস নেই।’ আমরা যাকে তার ইতিহাস বলি তা হচ্ছে একের পর এক বহিরাগতদের ইতিহাস, যারা তাদের সাম্রাজ্য স্থাপন করেছে এই পরিবর্তনহীন, প্রতিরোধহীন সমাজের নিষ্ক্রিয় ভিত্তির ওপর। সমস্ত অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ, আগ্রাসন, বিপ্লব, বিজয়, দুর্ভিক্ষ যতই বিস্ময়করভাবে জটিল, দ্রুত এবং বিধ্বংসী মনে হোক না কেন পরবর্তী ঘটনাক্রম থেকে বোঝা যায় তা সমাজের গভীরে প্রবেশ করেনি’। এ ছাড়া আরো অনেক লেখক,গবেষক ভারতীয় সমাজের নিশ্চলতা সম্পর্কে অনুরূপ মত প্রকাশ করেছেন। কোনো মৌলিক পরিবর্তন এ সমাজে দেখা যায়নি। ব্রিটিশ শাসন আমলে ভারতীয় সমাজে যেটুকু পরিবর্তনের সূচনা হয়- তা হয় শুধুমাত্র ঔপনেবেশিক শাসন ও শোষণের স্বার্থে। প্রায় ২০০ বছর ভারতবর্ষ পরাধীন থাকে। ব্রিটিশ শাসনের নিষ্ঠুর শাসন ও শোষণের কথা কারো অজানা নয়।

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলেও বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হয় পাকিস্তান নামক এক কৃত্রিম রাষ্ট্রের। পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসকেরা এদেশের মানুষের সব অধিকার কেড়ে নেয়। নির্যাতন, নিষ্পেষণ, শোষণ ও বঞ্ছনার নতুন ইতিহাস তৈরি হয়। অবশেষে বাংলাদেশের বাঙালি জাতি বিদ্রোহ করে। ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে সত্যিকারের একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু তা কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? এ কথা ঠিক যে মাঝে মধ্যে গণতন্ত্র উঁকি দিয়েছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ দেখা গেছে। বলা যায় আশির দশকের স্বৈরাচারকে বিদায় করে নব্বইয়ের দশক থেকে তিনটি মোটামুটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার ক্ষমতায় আসে। আংশিকভাবে হলেও গণতন্ত্রের সূচনা ও চর্চা শুরু হয়। কিন্তু তার পরের ইতিহাস গণতন্ত্র নির্বাসনের ইতিহাস।

নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাই সর্বোত্তম ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে আধুনিক বিশে^র বেশির ভাগ মানুষের কাছে। কারণ গণতন্ত্রই মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে। তাই গত দুই শতাব্দী ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষ গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছে, গণতন্ত্র অর্জন করেছে এবং গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। আমাদের দেশেও প্রায়শ গণতন্ত্রের দাবিতে মানুষ সোচ্চার হয়েছে, সংগ্রাম করেছে এবং কখনো সফলও হয়েছে। কিন্তু আজকের দিনে, বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র আছে একথা কি বলা যাবে? গণতন্ত্র না থাকলে মানুষের অধিকারও থাকে না। অধিকারবঞ্চিত মানুষ তাই মুক্তির পথ খুঁজতে থাকে। জনমানুষের পুনর্জাগরণই শুধু বিদ্যমান সঙ্কট থেকে মুক্তির পথ রচনা করতে পারে। জনগণের শক্তি হিমালয় পর্বতের মতই অটল এবং শক্তিশালী। পৃথিবীর প্রতিটি বিদ্রোহ-বিপ্লব এ সত্য প্রমাণ করে। রেনেসাঁসের মত একটি সফল বিপ্লবাত্মক গণজাগরণের মাধ্যমে বাংলাদেশে সমসাময়িককালে সৃষ্ট সব সঙ্কট নিরসন করা সম্ভব। একমাত্র রেনেসাঁস এ মুক্তির পথ দেখাতে পারে। সব কালে সব দেশে ইউরোপের মত রেনেসাঁসের উন্মেষ না-ও ঘটতে পারে। নিজের দেশের বাস্তবতায় সে দেশের জনগণ মুক্তির পথ খুঁজে নেবে। তবে রেনেসাঁসের উন্মেষের জন্য অনুপ্রেরণা জোগাবে দেশের চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবীরা। স্বল্পসংখ্যক মানবদরদি চিন্তাবিদ রেনেসাঁস ও রিফরমেশন আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এমন নজির আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ও দেখা গেছে। তবে বর্তমানে এ ক্ষেত্রে যে দৈন্যদশা, তা বলাই বাহুল্য। ভয় ও লোভের বশবর্তী হয়ে বুদ্ধিজীবীদের এক বিরাট অংশ আত্মসমর্পণ করেছেন। চাটুকার ও পদলেহনকারী এ সব চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবীর অভিধান থেকে গণতন্ত্র বিদায় নিয়েছে, বিদায় নিয়েছে এ দেশ থেকে। তাই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে পুনর্জাগরণের জন্য। রেনেসাঁসের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহ বিপ্লবে মন্দ্রিত হবে, সূচনা হবে পরিবর্তনের এক নবযুগ। একটি দুর্নীতিমুক্ত, প্রতিহিংসামুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত, দলীয় স্বৈরাচারিতামুক্ত, শোষণ-বঞ্চনাহীন একটি গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, অঙ্গীকার এবং সঙ্কট মুক্তির দীপ্ত শপথ রেনেসাঁসের জন্ম দেবে।

লেখক : এম এ কবীর, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *