অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : প্রতি বছর দেশে প্রায় ১৪ হাজার মানুষ স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করে, যা আত্মহত্যা নামে বিবেচিত। নিজে মৃত্যুর দিনক্ষণ ঠিক করে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর পথ বেছে নিলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানসিক রোগীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। মানসিক রোগে আক্রান্ত ৯২-৯৪ শতাংশ রোগী চিকিৎসা নেন না, ফলে সারা বিশ্বেই আত্মহত্যা বাড়ছে। তবে আত্মহত্যার পেছনের কারণগুলো যদি চিহ্নিত করা যায় এবং মনের স্বাস্থ্যের পরিচর্যা করা যায়, তাহলে আত্মহত্যার একটা বড় অংশ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে থাকেন। এর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা, বুলিং এবং সামাজিক বৈষম্য। প্রযুক্তির অধিক ব্যবহার মানুষকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে ভার্চুয়াল নাগরিকে পরিণত করছে। ফলে তারা মনের অজান্তে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এই নিঃসঙ্গতাও আত্মহত্যার বড় কারণ। এছাড়া আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য মানুষকে হতাশার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। হতাশা থেকে তৈরি হয় বিষণ্নতা। আর বিষণ্নতায় আক্রান্ত মানুষ তীব্র আশাহীনতায় ভোগে, ফলে সেখান থেকে মানুষ মনে করে মৃত্যুই তাদের মুক্তির একমাত্র পথ। এ ধরনের চিন্তা থেকে তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। আত্মহত্যায় মৃত্যু নিয়ে দেশে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে ধারাবাহিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিক্ষিপ্তভাবে কিছু গবেষণা হয়েছে। ২০১৪ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন ও বছরে ১০ হাজার ২০০ মানুষ আত্মহত্যা করে। এর সাত বছর পর আঁচল ফাউন্ডেশনের করা আত্মহত্যা নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ৭ মার্চ এক বছরে আত্মহত্যা করে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন। এই সময়ে দিনে গড়ে আত্মহত্যা করে প্রায় ৪০ জন। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, বছরে আত্মহত্যায় মৃত্যু হয় প্রায় ১৩ হাজার মানুষের।
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের ১৮.৭ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভোগেন। পুরুষের তুলনায় নারীদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি। যদিও মানসিক রোগে ভুগতে থাকা ৯২-৯৪ শতাংশই চিকিৎসার বাইরে রয়েছেন। মানসিক রোগের চিকিত্সা নিয়ে সমাজে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। ফলে অনেকে সমাজের ভয়ে সমস্যাকে চেপে রাখেন এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন না।
আজ ১০ সেপ্টেম্বর, ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস-২০২৪’। এটি সচেতনতা বাড়ানোর দিন। ২০০৩ সাল থেকে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও যথাযথ মর্যাদায় দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আত্মহত্যার প্রবণতার ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান দশম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে বিশ্বে কেউ না কেউ আত্মহত্যার মাধ্যমে পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে। প্রতি বছর আত্মহত্যাজনিত কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ৮ লাখ, যার ৭৫ শতাংশই ঘটে নিম্ন ও নিম্নমধ্য আয়ের দেশগুলোতে। আত্মহত্যার তালিকায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম এবং ভারতের অবস্থান প্রথম।
দেশে আত্মহত্যা নিয়ে কাজ করছে আঁচল ফাউন্ডেশন। তাদের হিসেবে ২০২৩ সালে দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। এ সময়ে আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২২৭ জন স্কুলশিক্ষার্থী, কলেজশিক্ষার্থী ১৪০ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ৯৮ জন। সংগঠনটি ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত আত্মহত্যার ৩২২টি ঘটনা পর্যালোচনা করে। তাদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরা, যা মোট আত্মহত্যাকারীর ৪৯ শতাংশ। ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৩৫ শতাংশ। ৩৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সী আত্মহত্যাকারী ১১ শতাংশ এবং ৪৬ থেকে ৮০ বছর বয়সী ৫ শতাংশ। অন্যান্য দেশে নারীর তুলনায় আত্মহত্যায় পুরুষরা এগিয়ে থাকলেও বাংলাদেশে তার বিপরীত। দেশে আত্মহত্যাকারীদের ৫৭ শতাংশ নারী, পুরুষ ৪৩ শতাংশ।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ এই প্রতিবেদককে বলেন সারা বিশ্বেই আত্মহত্যা বাড়ছে। এই আত্মহত্যার পেছনে কোনো একটা কারণ দায়ী নয়; আছে বহুবিধ কারণ। আত্মহত্যার পেছনের কারণগুলো যদি আমরা শনাক্ত করতে পারি, মানুষের মনের স্বাস্থ্যের যদি আমরা যত্ন নিতে পারি এবং যাদের মধ্যে মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দেবে, তাদের যদি দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনতে পারি, তাহলে আত্মহত্যা অনেকাংশেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। তিনি বলেন, সব আত্মহত্যা হয়তো প্রতিরোধ করা যাবে না, তবে আত্মহত্যার একটা বড় অংশ প্রতিরোধ করা সম্ভব। তিনি বলেন, আমাদের দেশে যারা মানসিক রোগে ভুগছে তার মধ্যে ৯২ থেকে ৯৪ শতাংশই চিকিৎসার বাইরে রয়েছে। দেশে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন (সাইকিয়াট্রিস্ট) ৩৫০ জন এবং মনোবিজ্ঞানীর (সাইকোলজিস্ট) সংখ্যা ৫ শতাধিক, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। মানসিক স্বাস্থ্য ও এর চিকিৎসার বিষয়ে আরও যত্নবান হতে হবে।
Leave a Reply