অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : দিনাজপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত দিনমজুর আব্দুর রশিদের তিন দিনের শিশু কন্যা বিক্রির ঘটনা তদন্ত ও উদ্ধারে স্থানীয় প্রশাসন উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো.ফয়সাল রায়হান। সোমবার রাতে তিনি সাংবাদিকদের এ ব্যাপারে নিশ্চিত করেছেন। শিশুটি উদ্ধার করে পরিবারের নিকট ফেরত দিতে প্রশাসন কাজ করছে।
তিনি বলেন, স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করে আব্দুর রশিদের পরিবারের নিকট হস্তান্তরের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই শিশুটিকে উদ্ধার করে পরিবারের নিকট হস্তান্তর করা হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
জানা গেছে, দিনাজপুর শহরের রাজবাড়ী এলাকার দিনমজুর আব্দুর রশিদ গত ৪ আগস্ট দুপুর ১২টায় তার অন্তঃসত্তা স্ত্রী রোকসানা বেগমের চিকিৎসার জন্য দিনাজপুর সদর জেনারেল হাসপাতালে যান। হাসপাতালের কাউন্টারে টিকিট নিতে এসে হাসপাতালে বাইরে আব্দুর রশিদ গুলিবিদ্ধ হন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক সার্জিক্যাল ওয়ার্ডেই তার চিকিৎসার ব্যবস্থা নেন।
সদর জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. সোহেল পারভেজ-এর বরাত দিয়ে ইউএনও বলেন, ৪ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর রাবার বুলেট এবং টিয়ারশেল নিক্ষেপে আহতরা চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে আসে। অনেকে ভয়ে ছুটাছুটি করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। আহতদের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ উদ্ধার করে তাৎক্ষণিক সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তাদের চিকিৎসায় ওষুধ পত্র ক্রয়ের জন্য কাউকেই বলা হয়নি। হাসপাতাল থেকে ওষুধ পত্র দিয়ে তাদের যথাযথ প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
আহত আব্দুর রশিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি ৪ আগস্ট দুপুরে দিনাজপুর সদর হাসপাতালের টিকিট কাউন্টারের সামনে পুলিশের ছোড়া গুলিতে আহত হন। হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে গর্ভবতী স্ত্রীসহ বাড়ীতে চলে আসেন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় গত ৮ আগস্ট তিনি দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালের চিকিৎসক পরদিন তার ক্ষতস্থানে অস্ত্রোপচার করেন। ৯ আগস্ট শহরের রাজবাড়ী এলাকায় তার বাসায় কন্যা সন্তানের জন্ম দেন গৃহবধূ রোকসানা বেগম।
তিনি জানান, তার অসুস্থতা, নবজাতক শিশুর পরিচর্যা ও সংসারের ব্যয় নির্বাহের জন্য স্ত্রী রোকসানা পরিবারের লোকজনের কথায় স্বামীকে না জানিয়ে গত ১২ আগস্ট রংপুর শহরে বসবাসকারি নিঃসন্তান দম্পত্তির নিকট ২৫ হাজার টাকায় কন্যা শিশুকে বিক্রি করে দেন।
নবজাতকের মা গৃহবধু রোকসানা বেগম জানিয়েছেন, হাসপাতালে চিকিৎসক তাকে বলেছেন, এক মাস পর তার স্বামী আব্দুর রশিদের আরেকটি অস্ত্রোপচার করতে হবে। এ কারণেই তিনি পরিবারের সদস্যদের কথায় শিশুটি বিক্রি করতে রাজি হয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ৮ আগস্টে আমার স্বামীর অবস্থা খারাপ হলে তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাই। সেখানে আমার স্বামীর অস্ত্রোপচার হয়। অস্ত্রোপচারের পর অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়। এর মধ্যে আমার বাচ্চা হয়। সেই সময় হাতে টাকা ছিল না। স্বামীর চিকিৎসা করাতে হবে তাই ৩ দিনের বাচ্চাকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেই। সেই টাকা দিয়ে স্বামীর চিকিৎসা ও সংসারে ব্যয় নির্বাহ করেছি। এক মাস পর আবার অস্ত্রোপচার করতে হবে। সুস্থ হতে আরো এক, দু’বছর সময় লাগবে। নিজের কোন জায়গা-জমি নাই। মানুষের বাসায় থাকি। রোকসানা বেগম, স্বামীর সুচিকিৎসা ও স্থায়ী কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন।
নিজের আকস্মিক অসুস্থতায় দিশেহারা আহত আব্দুর রশিদ বাসস’কে বলেছেন, আমি কত দিনে সুস্থ হবো নিজেও বুঝতে পারছি না। অনিশ্চয়তার মধ্য দিন কাটাচ্ছি। শরীরে রাবার বুলেটের আঘাতের যন্ত্রণা নিয়ে দিনাতিপাত করছি। রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারিনা। কে চালাবে আমার চিকিৎসার খরচ? আমি যদি শারীরিকভাবে পঙ্গু বা অক্ষম হয়ে যাই, তাহলে আমার সংসার কিভাবে চলবে। তিনি তার চিকিৎসা ও জীবন ধারনের জন্য সরকারের সহায়তা কামনা করেন।
জানা গেছে, আহত আব্দুর রশিদের নিজস্ব কোন ঘর বাড়ি নাই। পঞ্চগড় জেলা থেকে কয়েক বছর আগে দিনাজপুর শহরে কাজের সন্ধানে এসেছিলেন। দিন মজুরের কাজ করতে গিয়ে শহরের রাজবাড়ী এলাকায় অন্যের জমিতে মাথা গুজার ঠাঁই হয়েছিল তার। শহরের রাজবাড়ী এলাকার ব্যবসায়ী সুনীল চন্দ্র জানান, আহত আব্দুর রশিদের চিকিৎসার খরচ যোগাতে প্রতিবেশিরা চাঁদা তুলে তাকে সহায়তা করে যাচ্ছেন।
দিনাজপুর এম. আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এটিএম নুরুজ্জামান বলেন, ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে আহত ১৮২ জনের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকজনের অস্ত্রোপচার হয়েছে এবং কয়েকজন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ভর্তি হওয়া আহতদের মধ্যে অনেকে সুস্থ হয়ে বাড়ী চলে গেছেন। এরপরও কোন সমস্যা হলে আমরা চিকিৎসা সেবায় নিয়মিত পারমর্শ প্রদান করে যাব।
Leave a Reply