অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : গত ২৭ ডিসেম্বর ভারতীয় গণমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত ‘উর্দিতে বাঙালি গণহত্যার রক্তের ছিটে! ৫৩ বছর পর বাংলাদেশে ফিরছে সেই পরাজিত পাক ফৌজ’ শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর এবং ভিত্তিহীন তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার নীতিতে অটল। নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিভিন্ন দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখে এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ছাত্র বিনিময় ও প্রশিক্ষনসহ বিবিধ সহযোগিতামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোনো প্রশিক্ষক দল বা প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশের কোনো সেনানিবাসে প্রশিক্ষণের জন্য আসার কোনো পরিকল্পনা নেই। এই দাবি ভিত্তিহীন এবং বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
এছাড়াও, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার চাহিদার ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রয়োজনীয় গোলাবারুদ সংগ্রহ করে। সংবেদনশীল প্রতিরক্ষা বিষয়ে অজ্ঞতাপ্রসুত মতামত অনভিপ্রেত, অযাচিত ও আপত্তিকর।
সাংবাদিকতার সঠিক রীতি অনুসরণ করার বিপরীতে, উক্ত সংবাদপত্রটি প্রতিবেদন প্রকাশের পূর্বে বাংলাদেশের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)-এর কোনো মন্তব্য বা ব্যাখ্যা গ্রহণ করেনি। এই উপেক্ষা প্রতিবেদনের নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথ্যের স্বচ্ছতা এবং সঠিক তথ্য প্রচারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। গণমাধ্যমে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশের পূর্বে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে তথ্য যাচাই করতে বিনীতভাবে অনুরোধ করা হচ্ছে।
আনন্দবাজারে প্রকাশিত ‘উর্দিতে বাঙালি গণহত্যার রক্তের ছিটে! ৫৩ বছর পর বাংলাদেশে ফিরছে সেই পরাজিত পাক ফৌজ’ সংবাদটি নিম্নে হুবহু তুলে ধরা হলো :
“যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পেরিয়ে গিয়েছে পাঁচ দশক। আপাতশান্ত পদ্মাপারে ফের পা রাখতে চলেছে এককালের শত্রু তথা ‘গণহত্যাকারী’ ফৌজ? পরিস্থিতি যে ভাবে নতুন দিকে বাঁক নিয়েছে, তা দেখে ভুরু কুঁচকেছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা। উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের সুরও শোনা গিয়েছে তাঁদের গলায়।
কুর্সিতে বসা ইস্তক ভারত-বিরোধী মনোভাব বজায় রেখেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। এ বার আরও এক কদম এগিয়ে রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতরের জন্য তিনি পদ্মাপারের দরজা খুলে দিলেন বলে সূত্র মারফৎ মিলেছে খবর।
সূত্রের খবর, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ-খুলনা-কুমিল্লায় আসছে পাক সেনা। ফলে প্রায় ৫৩ বছর পর ফের রাওয়ালপিন্ডির সেনা অফিসারদের পা পড়বে পদ্মাপারে। মেজর জেনারেল পদমর্যাদার পাক সেনা অফিসার বাংলাদেশের ফৌজকে প্রশিক্ষণ দেবেন বলে জানা গিয়েছে।
একাধিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগামী বছরের (পড়ুন ২০২৫) ফেব্রুয়ারি থেকে ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণ দেবে পাক সেনা। প্রথম পর্যায়ের প্রশিক্ষণ চলবে ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্টে। বাংলাদেশের এই সেনাছাউনিতেই রয়েছে ‘ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কম্যান্ড’-এর সদর দফতর।
জানা গিয়েছে, প্রথম পর্যায়ের প্রশিক্ষণ শেষ হতে প্রায় এক বছর সময় লাগবে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মোট ১০টি কম্যান্ড রয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে প্রতিটি কম্যান্ডেই প্রশিক্ষণ দেবে পাক ফৌজ। কত দিন বা বছর ধরে এই প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া চলবে, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়।
চলতি বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে সেনা প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন পাক ফৌজের জয়েন্ট চিফ অফ স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল শাহির সামশেদ মির্জ়া। রাওয়ালপিন্ডির সেই প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করেছেন পদ্মাপারের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ়-জামান। সম্প্রতি বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে তিনিই পাক সেনা অফিসারদের বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
পাকিস্তান থেকে বিপুল পরিমাণ গোলা-বারুদও আমদানি করা শুরু করেছে বাংলাদেশ। এ বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ইসলামাবাদের কাছে ৪০ হাজার রাউন্ড বুলেট চেয়ে পাঠিয়েছে ঢাকা। গত বছরের (পড়ুন ২০২৩) তুলনায় এই আমদানির মাত্রা প্রায় তিন গুণ বলে জানা গিয়েছে।
২০২৩ সালে ১২ হাজার রাউন্ড গোলা-বারুদ আমদানি করে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী। এ বছর রাইফেলের গুলির পাশাপাশি দু’হাজার রাউন্ড ট্যাঙ্কের গোলা এবং ৪০ টন আরডিএক্স (উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক) ইসলামাবাদের থেকে ঢাকা কিনছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে মিলেছে খবর।
পাশাপাশি, পাক নৌসেনার সঙ্গে যৌথ মহড়ায় যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের জল-যোদ্ধারা। করাচি বন্দরে হওয়া ওই মহড়ার পোশাকি নাম ছিল ‘আমন ২০২৫’। প্রায় ১৫ বছর পর পাক নৌবাহিনীর সঙ্গে গা ঘামাতে দেখা গিয়েছে বাংলাদেশের নৌসেনাকে। একে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলেছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন পাকিস্তানের সঙ্গে কোনও মহড়ায় যোগ দিত না বাংলাদেশের ফৌজ। এক বার ইসলামাবাদের যুদ্ধজাহাজ ‘তৈমুর’ কিছু ক্ষণের জন্য বাংলাদেশের বন্দরে নোঙর করার অনুমতি চেয়েছিল। পত্রপাঠ সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছিল হাসিনা প্রশাসন।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের কথায়, উত্তর-পূর্ব ভারতকে মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা করতে বাংলাদেশকে বোড়ের মতো ব্যবহার করছে পাকিস্তান। রাওয়ালপিন্ডির সেনা অফিসারদের মূল লক্ষ্য শিলিগুড়ি করিডর। মুরগির গলার (চিকেন’স নেক) মতো উত্তরবঙ্গের ওই এলাকাটির কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম।
আর এই কারণেই বাংলাদেশে সক্রিয় হয়েছে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। ক্রমাগত কট্টরপন্থীদের উৎসাহ দিচ্ছে ইসলামাবাদ। শিলিগুড়ি করিডর দখলের মাধ্যমে ভারত ভেঙে দু’টি দেশ তৈরির স্বপ্ন দেখছেন তাঁরা। উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিকে নিয়ে আলাদ রাষ্ট্র গঠনের ইচ্ছা রয়েছে পাকিস্তানের, এমনটাই আশঙ্কা প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশের।
দ্বিতীয়ত, যে ভাবে বাংলাদেশে কট্টরপন্থীদের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, তাতে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন গোয়েন্দাকর্তারা। তাঁদের আশঙ্কা, আগামিদিনে বাংলা, অসম এবং ত্রিপুরার মতো বাংলাদেশ লাগোয়া রাজ্যগুলিতে বাড়তে পারে জঙ্গি নাশকতা। পদ্মাপারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের পাক সেনা সন্ত্রাসের প্রশিক্ষণ দিলে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই থাকবে না।
এই পরিস্থিতিতে গত ২০ ডিসেম্বর সশস্ত্র সীমা বলের (এসএসবি) ৬১তম প্রতিষ্ঠা দিবসে শিলিগুড়ির সদর দফতরে যান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। বাহিনীর জওয়ান এবং অফিসারদের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। বাংলাদেশ সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী বিএসএফও রয়েছে তাঁরই মন্ত্রকের আওতায়। শিলিগুড়িতে মোতায়েন বাহিনীকে সদাসতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন শাহ।
গত দু’মাসে পাকিস্তান থেকে অন্তত দু’টি মালবাহী জাহাজ গিয়েছে বাংলাদেশের বন্দরে। সাধারণ পণ্য, না কি তার আড়ালে গোলা-বারুদ ঢাকায় পাঠাচ্ছে ইসলামাবাদ, ইতিমধ্যেই তা নিয়ে তৈরি হয়েছে সন্দেহ। গোটা ঘটনার উপর কড়া নজর রাখছে নয়াদিল্লি।
১৯৭১ সালে পদ্মাপারে নারকীয় গণহত্যা চালায় পাক সেনা। এর নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান। ওই সময়ে অবশ্য পাকিস্তানেরই অংশ ছিল আজকের বাংলাদেশ। অফিসার টিক্কার নির্দেশে ৩০ লক্ষ বাঙালিকে খুন করে তাঁর ফৌজ। এর পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’।
এই ঘটনায় হাজার হাজার শরণার্থী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে শুরু করেন। ফলে দ্রুত অবনতি ঘটে দিল্লি ও ইসলামাবাদের সম্পর্ক। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে পাক বায়ুসেনা হামলা চালালে শুরু হয় যুদ্ধ।
১৯৭১ সালের যুদ্ধে ভারতের সেনার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে ছিল বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী। মাত্র ১৩ দিনের মধ্যে মাথা নোয়াতে হয় ইসলামাবাদকে। ঢাকায় আত্মসমর্পণ করে ৯৩ হাজার পাক সেনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বড় আত্মসমর্পণ আর দেখেনি গোটা বিশ্ব। যুদ্ধশেষে নতুন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ। নবগঠিত দেশটির প্রথম শাসক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।
বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, পাঁচ দশক পর সেই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে চাইছে পাক সেনা। সেই কারণেই বাংলাদেশের মাটিতে কট্টরপন্থা এবং ভারত বিরোধিতার বীজ পুঁতে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে আইএসআই। এ ব্যাপারে চিনও তাদের সাহায্য করছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এর মধ্যে আবার সরাসরি রাশিয়াকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসেছে ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকার। এতে বেজায় চটেছে মস্কো। মুজিব-কন্যা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন রাশিয়ার সাহায্যে প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির কাজ শুরু করে বাংলাদেশ সরকার। সেখানে কাজ করছে বেশ কয়েকটি ভারতীয় সংস্থাও।
মুহাম্মদ ইউনূস প্রশাসনের অভিযোগ, সেই ‘রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প’ থেকে বিপুল পরিমাণ ঘুষ নিয়েছেন হাসিনা এবং তাঁর পুত্র। দু’জনের আর্থিক তছরুপের পরিমাণ ৫০০ কোটি ডলার হতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ফলে তাঁদের বিরুদ্ধে আর্থিক তছরুপের মামলা শুরু করার দাবি জোরালো হচ্ছে বাংলাদেশে।
রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে রুশ সরকারি সংস্থা ‘রোসাটম’। বিষয়টিতে বিবৃতি দিয়েছে মস্কোর ওই প্রতিষ্ঠান। ‘রোসাটম’ বলেছে, ‘‘যে কোনও কাজে আমরা স্বচ্ছতা বজায় রাখি। সেখানে দুর্নীতি বা ঘুষের প্রশ্নই ওঠে না। ঢাকা চাইলে যে কোনও আদালতে যেতে পারে। এই সংক্রান্ত মামলার মুখোমুখি হওয়ার সাহস আমাদের রয়েছে।’’
তবে বাংলাদেশে পাক সেনার আগমনের কথা অস্বীকার করেছে মুহাম্মদ ইউনূস সরকার। ঢাকা জানিয়েছে, পাক সেনার কোনও প্রশিক্ষক বা প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশের ছাউনিতে আসার পরিকল্পনা নেই। তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, পেশাদারিত্ব এবং নিরপেক্ষতা ঠিক রাখতে নিয়মিত ভাবে বিভিন্ন দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতামূলক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে থাকে সেখানকার ফৌজ।
Leave a Reply