অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খেরসনের পতনের পর সেই শহরের বাসিন্দারা উল্লাস করছেন কিন্তু কর্মকর্তারা সতর্ক করছেন – যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে খেরসন পুনর্দখল এই যুদ্ধের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
পশ্চিমা বিশ্লেষকরা একে তুলনা করছেন, এ বছরের প্রথম দিকে কিয়েভের বাইরে অবস্থান নেয়া রুশ সৈন্যদের পশ্চাদপসরণের সাথে।
প্রকৃত পক্ষে গত তিনটি মাস ছিল এ যুদ্ধে ভাগ্য পরিবর্তনের কাল। এ সময়টায় কিছুই যেন রুশদের পক্ষে যায়নি।
এই সময়টায় ইউক্রেনের পূর্ব প্রান্তে তারা বিস্তীর্ণ ভূমির দখল হারিয়েছে, কৃষ্ণসাগরে তাদের নৌবহরের প্রধান জাহাজটি ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে, অধিকৃত ক্রাইমিয়া ও রাশিয়ার মধ্যেকার অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি সেতু এক বিস্ফোরণের পর এখনো অকার্যকর।
এখন তাদের বাহিনীকে খেরসন শহরটিও ছেড়ে আসতে হলো – যেটি ছিল ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে একমাত্র প্রাদেশিক রাজধানী যা তারা দখলে নিতে পেরেছিল।
পরিকল্পিতভাবে নেয়া কিছু সামরিক পদক্ষেপ
গত জুলাই মাস থেকেই ইউক্রেনীয় বাহিনী খুব পরিকল্পিতভাবে কিছু সামরিক পদক্ষেপ নেয়।
আমেরিকান হিমার্স রকেট সিস্টেম হাতে পাবার পর থেকেই তারা বেছে বেছে কিছু আক্রমণ চালায়।
তারা খেরসন ও তার আশপাশে অবস্থান নেয়া রুশ বাহিনী এবং তাদের রসদপত্র যোগানের পথগুলোর ওপর থাকা কিছু গুরুত্বপূর্ণ সেতু আক্রমণ করে। এর ফলে রুশ সেনাদলগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়ে। দনিপ্রো নদীর পশ্চিম তীরে থাকা রুশ সেনাদের অবস্থান ক্রমাগত বিপজ্জনক হয়ে পড়ার পর সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিক থেকেই – প্রধানতঃ রাতের বেলা – রুশ সৈন্যদের সরিয়ে নেয়া শুরু হয়।
এক পর্যায়ে রুশ কম্যান্ডার জেনারেল সুরোভিকিন বলেন, খেরসন শহরটিতে রসদপত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না।
বুধবার মস্কো ঘোষণা করে যে অব্যাহত ইউক্রেনীয় আক্রমণের মুখে তারা খেরসন শহর থেকে রুশ সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।
“আমি জানি এটা একটি কঠিন সিদ্ধান্ত তবে আমরা আমাদের সৈন্যদের জীবন এবং আমাদের বাহিনীর লড়াই করার সক্ষমতাকে রক্ষা করবো।” – বলেন জেনারেল সুরোভিকিন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, খেরসন থেকে এই সেনা প্রত্যাহার রাশিয়া এবং ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য একটি বড় এবং অপমানজনক আঘাত। তবে ক্রেমলিনের মুখপাত্র বলছেন ব্যাপারটাকে তারা মোটেও এভাবে দেখছেন না।
দিমিত্রি পেসকভ বিবিসির এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, খেরসন থেকে রুশ সৈন্যদের হটে যাওয়াটা প্রেসিডেন্ট পুতিনের জন্য অপমানজনক কিছু নয়।
রুশ পক্ষের কথাবার্তা কীভাবে বদলে গেছে
মস্কো থেকে বিবিসির স্টিভ রোজেনবার্গ লিখছেন, রাশিয়া ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে অভিযান শুরু করার পর রুশ টিভির টক শো হোস্টরা আত্মবিশ্বাসের সাথেই বলছিলেন – মাত্র কিছুদিন পরই রুশ সৈন্যরা কিয়েভের রাস্তা্য় কুচকাওয়াজ করবে।
নয় মাস পর সেই একই টিভি উপস্থাপকদের বিষণ্ণ মুখে সেনাবাহিনীর খেরসন ছাড়ার “দুরূহ সিদ্ধান্তের” খবর ঘোষণা করতে হচ্ছে।
যে খেরসনকে – ইউক্রেনের আরো বহু এলাকাসহ – রাশিয়ার অংশ করে নেবার কথা মাত্র ছয় সপ্তাহ আগে ঘোষণা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট পুতিন।
টিভি উপস্থাপক ভ্লাদিমির সলোভিয়ভ তার অনুষ্ঠানে বলছিলেন, “আমি চেয়েছিলাম মার্চ মাসেই কিয়েভে আমাদের পতাকা উড়ুক। তাই কিয়েভ ও চেরনিহিভ থেকে আমাদের সৈন্যদের পিছিয়ে আসাটা ছিল বেদনাদায়ক। ”
“কিন্তু এটাই যুদ্ধের নিয়ম…আমরা নেটোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি” – বলেন তিনি।
ইউক্রেন নয় – যুদ্ধ হচ্ছে নেটোর বিরুদ্ধে
যুদ্ধে কী হচ্ছে তার বর্ণনার ভাষাকে ক্রেমলিন ঠিক এভাবেই ঘুরিযে দিচ্ছে -বলছেন স্টিভ রোজেনবার্গ।
রুশ রাষ্ট্রীয় মিডিয়ার বার্তাটা হচ্ছে এই রকম: ইউক্রেনে রাশিয়াকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে আমেরিকা, ব্রিটেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং নেটোর সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে।
অন্য কথায়, ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে যে বিপর্যয় হচ্ছে তা ক্রেমলিনের কোন দোষে নয় – এসব ঘটছে বাইরের শত্রুদের কারসাজির ফলে।
আরেকটি বার্তা হচ্ছে – ইউক্রেনে যেসব সমস্যা হয়েছে এগুলোর জন্য যেন রুশ সামরিক বাহিনী বা রুশ প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করা না হয়, এবং সবাই যেন রাশিয়ার পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ থাকেন।
সমালোচকরা এখন কথা বলছেন ভিন্ন সুরে
মনে হচ্ছে রাশিয়ার সুপরিচিত কণ্ঠস্বর যারা তারা এসব পরামর্শ মেনে চলছেন।
যেমন চেচেন নেতা রমজান কাদিরভ, ভাড়াটে সৈন্য সরবরাহকারী গ্রুপ ওয়াগনারের প্রতিষ্ঠাতা ইয়েভগেনি প্রিগোশিন – এরা এতদিন রুশ সামরিক নেতৃত্বের প্রকাশ্য সমালোচক ছিলেন।
কিন্তু খেরসন থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর এরা দুজনেই জেনারেল সুরোভিকিনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বার্তা পোস্ট করেছেন।
অবশ্য ইউক্রেন যুদ্ধের সমর্থক রুশ সামরিক ব্লগারদের সম্পর্কে এ কথা বলা যাবে না।
তারা রুশ বাহিনীর খেরসন ছাড়ার পর পোস্ট করছেন ক্রুদ্ধ সব বার্তা।
যেমন একজন লিখেছেন “রাশিয়ার আশাকে যেভাবে খুন করা হয়েছে তা কখনো আমি ভুলবো না। আমার হৃদয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই প্রতারণার কথা লেখা থাকবে।”
আরেকজন লিখেছেন – “পুতিন ও রাশিযার জন্য এটি এক বিশা্ল ভূ-রাজনৈতিক পরাজয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অনেকদিন আগেই সমাজের আস্থা হারিয়েছে… এখন প্রেসিডেন্টের ওপর আস্থাও হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে।”
পুতিনকে “দূরে রাখার প্রয়াস“
ক্রেমলিন যে এটা ঠেকাতে কিছু চেষ্টা করছে না তা নয় – বলছেন স্টিভ রোজেনবার্গ।
খেরসন থেকে রুশ সৈন্যদের চলে যাওয়াকে যে অনেকেই একটা সামরিক বিপর্যয় এবং রাশিয়ার মর্যাদায় এক আঘাত হিসেবে দেখবে এটা তারা বোঝে।
তারা মি. পুতিনকে এই পশ্চাদপসরণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এই প্রত্যাহারের ঘোষণাও এসেছে জেনারেলদের মুখ থেকে। রুশ টিভিতে দেখা গেছে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এ আদেশ জারি করছেন।
রুশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ভ্লাদিমির পুতিনকে কোথাও দেখা যায়নি। যদিও ইউক্রেনে রুশ অভিযানের আদেশ দিয়েছিলেন তিনিই।
“প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আমার এ ব্যাপারে কিছুই বলার নেই” শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন মি. পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ ।
বিবিসির সংবাদদাতা রোজেনবার্গ বলছেন, মি. পুতিনের জন্য বিপদের ব্যাপার হলো সাম্প্রতিক এই ঘটনাগুলো তার ব্যাপারে শুধু যে রুশ জনগণের ধারণা পাল্টে দিতে পারে তাই নয়, আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো যেসব ক্ষমতাধর লোকেরা তার চারপাশে থাকেন – বদলে দিতে পারে সেই রুশ এলিটদের ধারণাও ।
তারা এতদিন মি. পুতিনকে দেখতেন একজন ঝানু কৌশলবিদ হিসেবে যিনি সবসময়ই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছেন। মি. পুতিনকে কেন্দ্র করেই একটা ‘সিস্টেম’ গড়ে উঠেছে – যার অংশ তারা নিজেরাও।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেনে রুশ বিশেষ সামরিক অপারেশন পরিকল্পনা মত এগোয়নি। এ যুদ্ধে ইউক্রেনে মৃত্যু ও ধ্বংস ছাড়াও রুশ পক্ষে বহু সৈন্যের মৃত্রু হয়েছে, মি. পুতিনকে ‘শুধু পেশাদার সৈন্যদের দিয়ে যুদ্ধ চালানোর’ অঙ্গীকার ত্যাগ করে লক্ষ লক্ষ রুশ নাগরিককে সৈনিক হিসেবে যুদ্ধ করতে পাঠাতে হয়েছে। এর ওপর রাশিয়ার অর্থনৈতিক ক্ষতিতো রয়েছেই।
ক্রেমলিন এতদিন ভ্লাদিমির পুতিনকে যেভাবে স্থিতিশীলতার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরতো – তা এখন লোককে গেলানো কঠিন হয়ে পড়তে পারে।
তাহলে ভ্লাদিমির পুতিন কী হিসেব নিকেশ করছেন?
যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের সাম্প্রতিক বিজয়গুলো সত্ত্বেও একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে রাশিয়া ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে নিয়েছে এবং সেসব এলাকায় অনেক ক্ষেত্রে বিক্ষিপ্ত যুদ্ধ চলতে থাকলেও রুশ দখল এখনো কায়েম আছে।
রুশ সৈন্যদের প্রস্থানের পর খেরসন শহরে উল্লাস হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এমন আতংকও আছে যে রাশিয়া হয়তো সেখানে পাল্টা আক্রমণও চালাতে পারে – জানাচ্ছেন নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদদাতারা।
রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের স্থলযুদ্ধ বিষয়ক সিনিয়র রিসার্চ ফেলো জ্যাক ওয়াটলিং গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক নিবন্ধে লিখেছেন মি. পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার কৌশলে একটা পরিবর্তন এনেছেন।
তিনি বলছেন, “এর লক্ষ্য হচ্ছে তাদের নতুন তৈরি করা প্রতিরক্ষা ব্যুহের বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয় বাহিনীর আক্রমণকে মোকাবিলা করে তাকে দুর্বল করে ফেলা, এবং অর্থনৈতিক যুদ্ধ চালিয়ে পশ্চিমা জোটের মনোবল ও অস্ত্রের মজুতকে হ্রাস করা। অন্যদিকে আগামী বছরে নতুন লোক এনে সামরিক বাহিনীকে পুনরুজ্জীবিত করা।”
রাশিয়া ও ইউক্রেনে এখন শীতকাল প্রায় এসে গেছে। এসময় প্রচণ্ড ঠান্ডা ও ভারী তুষারপাতের কারণে যুদ্ধ হয়ে উঠবে অত্যন্ত কঠিন।
জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন, ইউক্রেনের জন্য যা জরুরি তা হলো রুশ সৈন্যরা যেন শীতের সময়টায় ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না পারে তা নিশ্চিত করা।
তিনি আরো বলছেন, এমন কিছু খবরও আছে যে মার্কিন সামরিক বাহিনী ইউক্রেনকে সুপারিশ করছে যেন তারা আলোচনায় বসে।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে – ইউক্রেন আভাস দিয়েছে যে তারা অভিযান অব্যাহত রাখবে।
তবে কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, এ যুদ্ধে শীত একটা নির্ণায়ক ভুমিকা পালন করবে এবং এ সময়টায় উভয় পক্ষই হয়তো অভিযানে বিরত থাকবে – এমনটাও হতে পারে।
কিছু বিশ্লেষক ও কূটনীতিক এমনকি শীতের সময়টায় একটা শান্তি আলোচনার সম্ভাবনার কথাও বলছেন। সূত্র: বিবিসি বাংলা
Leave a Reply