অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : করোনার অভিঘাত পেরিয়ে পরিস্থিতি যখন একটু স্বাভাবিক হতে শুরু করে, তখনই এক নতুন সংকট দেখা দিয়েছে। করোনার সময় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় টালমাটাল পরিস্থিতিতে পড়েছিল অভিবাসন খাত। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে সারা বিশ্বে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বড় ধরনের জটিলতার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে আপাতত যুদ্ধের কারণে এ খাতে খুব একটা বিপদ দেখছেন না বাংলাদেশে অভিবাসন খাতের সংশ্লিষ্টরা।
গত বছরের শেষে মালয়েশিয়ার সঙ্গে শ্রম চুক্তির পর এই বছরের আগস্টে প্রথম কর্মী যায় সেদেশে। এর মধ্যে দিয়ে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু পুনরায় চালু হয়। বাজার চালু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত এক লাখ ১৫ হাজার ৫৪১ জনের নিয়োগানুমতি দিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এছাড়া নতুন বাজার হিসেবে কর্মী পাঠানোর বিষয়ে গ্রিসের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি আগ্রহপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জানায়, আলবেনিয়া, মাল্টা ও বসনিয়ার সঙ্গে কর্মী পাঠানোর বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে বর্তমানে নতুন শ্রমবাজার হিসেবে কম্বোডিয়া, উজবেকিস্তান, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়াসহ আফ্রিকা মহাদেশের কয়েকটি দেশ এবং জাপান, চীন, ক্রোয়েশিয়া, সেনেগাল, বুরুন্ডি, সেশেলসে কর্মী পাঠানো শুরু হয়েছে।
কোভিড মহামারির সময় বিভিন্ন দেশে অভিবাসীরা কর্মসংস্থান নিয়ে বেশি বিপাকে পড়েন। বিশেষ করে মৌসুমি আর অভিবাসী শ্রমিকরা দ্রুত চাকরি হারান। বিভিন্ন দেশে স্থানীয় মানুষও চাকরি হারাতে থাকেন। তবে পরিসংখ্যান বলছে, এক্ষেত্রে অভিবাসী শ্রমিকরা বেশি ভুক্তভোগী হয়েছেন। হাঙেরি, স্পেন এবং ইটালিতে স্থানীয়দের তুলনায় অভিবাসীরা ৫০ শতাংশ বেশি চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে ছিলেন।
অনিশ্চিত এবং কম মজুরির খাতগুলোতে অভিবাসীরা নিয়োজিত থাকায় তাদের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা বেশি ছিল বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও। করোনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এমন খাতের মধ্যে রয়েছে খাদ্য সরবরাহ, পর্যটন, বিনোদন, খুচরা বিক্রি এবং নির্মাণ শিল্প।
এক্ষেত্রে অভিবাসী শ্রমিকদের অনেকে চাকরি হারিয়ে নিজ দেশে ফেরত যান, যারা পরিসংখ্যানের আওতায় আসেননি। মহামারির সময় শুধু ভারতেরই ৬১ লাখ শ্রমিক চাকরি হারিয়ে দেশে ফেরত আসার পরিস্থিতিতে পড়েন। থাইল্যান্ড, নেপাল, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কার লাখো অভিবাসীও এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েন আরব উপসাগরীয় দেশগুলোতে কর্মরত শ্রমিকেরা। এই সময় কয়েক লাখ প্রবাসী কর্মী চাকরি হারিয়ে দেশে ফেরত আসেন। যার মধ্যে প্রায় অর্ধেকই কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন বলে বিভিন্ন গবেষণায় জানা যায়।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, যেকোনও বৈশ্বিক সংকটে নতুন অভিবাসী তৈরি হয়। এর মধ্যে আবার একটা দিক থাকে সেটি হচ্ছে ‘শোষণ’ । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন মহামারি শুরু হয় তখন ইউরোপের অনেক দেশেই কর্মী সংকট দেখা দেয়। তাদের অনেক মানুষের মৃত্যুর পর অভিবাসীদের স্বাগত জানানো শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রচুর অভিবাসী প্রবেশের সুযোগ দিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের অর্থনীতি পুনুরুদ্ধার করে। যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পর দুর্ভীক্ষ, মহামারি তৈরি হয়। সেসময় অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে অভিবাসীরা একটি ভূমিকা পালন করে। তখন তাদের একটি ডিমান্ড তৈরি হয়। কৃষি কাজ, সেবাখাত, স্বাস্থ্যখাতে অভিবাসীদের একটা ভূমিকা থাকে।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর মাইগ্রেশন স্টাডিজের সমন্বয়ক ও সহকারী অধ্যাপক ড. জালাল উদ্দিন সিকদার বলেন, যুদ্ধচলাকালীন সময় কিংবা মহামারির সময় এমন হয় না সাধারণত। অভিবাসী কর্মীর ডিমান্ড বেড়ে যায় এরপর। যেকোনও দুর্ভীক্ষ, যুদ্ধাবস্থা, মহামারির পর কর্মীর একটা সংকট তৈরি হয়। এরকম প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটা দেখা গেছে। স্প্যানিশ ফ্লু’র অভিঘাতের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন কলোনিয়াল দেশগুলো থেকে প্রচুর কর্মী নিয়েছিল অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে। এখনও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করছে অভিবাসী দ্বারা। কিন্তু এবারের সমস্যা হচ্ছে একের পর এক ক্রাইসিস থেকে যাচ্ছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর হয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লু , তারপর কিন্তু পুনরুদ্ধার হয়েছে। ২০২৩ এর পর মহামারি থাকবে না। কিন্তু যুদ্ধ যদি চলতে থাকে তাহলে কিন্তু আমাদের জন্য অনেক বড় সমস্যা। দুর্ভীক্ষ আর যুদ্ধ যদি একসঙ্গে চলে তাহলে এই লোকগুলো যাবে কোথায়।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জানায়, বিশ্বব্যাপী কোভিড মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে অন্যান্য খাতের মতো বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতেও প্রভাব পড়েছে। বিশ্বব্যাপী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর ২০২২-২৩ অর্থবছরের নভেম্বর মাস পর্যন্ত পাঁচ মাসে চার লাখ ১২ হাজার ২৭০ জনের বৈদেশিক কর্মসংস্থান হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন আশা করছেন, কর্মী যাওয়ার এই ধারা অব্যাহত থাকলে এই অর্থ বছরে ৯ থেকে ১০ লাখ লোকের বিদেশে কর্মসংস্থান হবে।
তিনি বলেন, আমার কাছে মনে হয় যুদ্ধের বড় যে প্রভাব সেটা আমরা অতিক্রান্ত করে এসেছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়েছে। বিভিন্ন সংস্থা কর্মী ছাঁটাই করছে। এজন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেতনভাতা কমেছে। কিন্তু বড় ধরনের ক্রাইসিস অভিবাসন খাতে সৃষ্টি হয়েছে এই ধরনের ঘটনা আমরা এখনও শুনিনি।
জনশক্তি কর্মসংস্খান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) এর মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে তেলের দাম বেশি, সেখানেই কর্মী যায় ৮০ ভাগ। যাদের অর্থনীতি ভালো আমাদের কর্মী সেখানেই যায়। যুদ্ধের কারণে কর্মী যাওয়ার হার আরও বেড়েছে।
Leave a Reply