23 Feb 2025, 09:47 pm

ভাষা আন্দোলনের জন্য বঙ্গবন্ধুকে বার বার কারাবরণ করতে হয়েছিল : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলনের জন্য বারবার কারাবরণ করলেও তার অবদান ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর যে অবদান, সেই অবদানটুকু কিন্তু মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। অনেক বিজ্ঞজন, আমি কারো নাম বলতে চাই না, চিনি তো সবাইকে। অনেকে বলেছেন, ওনার আবার কী অবদান ছিল? উনি তো জেলেই ছিলেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন বলে উনার কোন অবদান নেই? তাহলে উনি জেলে ছিলেন কেন? এই ভাষা আন্দোলন করতে গিয়েই তো তিনি বারবার কারাগারে গিয়েছেন। সেই গুরুত্ব কিন্তু কেউ দিতে চায়নি।’
সরকার প্রধান আজ সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘একুশে পদক-২০২৩’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও দ’ুটি প্রতিষ্ঠানের মাঝে পদক বিতরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের ভাষা মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলন সূচনা করেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারই উদ্যোগে ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং আমাদের ভাষার জন্য আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সাল থেকে। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা অর্জন।
পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের রিপোর্টে বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলনে অবদানের কথা উল্লেখ আছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টগুলো পাওয়ার পরে আমি একটা ভাষণ দিয়েছিলাম। তখন একজন বিদগ্ধ জন আমাকে খুব ক্রিটিসাইজ করে একটা লেখা লিখলেন যে, আমি নাকি সব বানিয়ে বানিয়ে বলছি।
তিনি বলেন, গোয়েন্দা রিপোর্টগুলো নিয়ে আমি আর আমার বান্ধবী বেবি মওদুদ, এম আর আক্তার মুকুলের কাছে যাই। মুকুল ভাইকে বললাম আপনার কাছে এই যে সমস্ত রিপোর্ট দিলাম, কোন তারিখে কখন কি করেছেন এখানে সব বিস্তারিত আছে। ফাইলটা দিলাম; আপনি এর জবাবটা লিখুন। তিনি সত্যিই লিখেছিলেন। কারণ, ওনারাতো (সমালোচক) অনেক উঁচু মাপের লোক। আমাদের মত ছোট চুনোপুটিরা কিছু লিখলে তো হবে না সে জন্য। পরে অবশ্য সেগুলো ১৪ খন্ডের পুস্তক আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি জাতির পিতার লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও তাঁর ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন ভূমিকার উল্লেখ রয়েছে বলেও তিনি জানান।
‘বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার একটা প্রবণতা সব সময় ছিল’, উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার পর দেখা গেল আমাদের সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান, যে স্লোগান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে, সেই জয়বাংলা স্লোগান নিষিদ্ধ। ৭ মার্চের ভাষণ, যে ভাষণে গেরিলা যুদ্ধের সমস্ত নির্দেশনা এবং সে ঐতিহাসিক কথা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, রেডিওতে প্রতিদিন এই বার্তাটা পৌঁছানো হতো। এই ভাষণের কারণে মুক্তিযোদ্ধারা যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। সেই ভাষণটাও নিষিদ্ধ। আসলে বঙ্গবন্ধুর নামই তো মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল।
এ বছর ভাষা আন্দোলন ক্যাটাগরিতে তিনজন, মুক্তিযুদ্ধে একজন, শিল্পকলায় আটজন (অভিনয়, সঙ্গীত, আবৃত্তি, চারু ও চিত্রকলা), রাজনীতিতে দুইজন, শিক্ষায় একজন ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠান, সমাজ সেবায় একজন ও একটি প্রতিষ্ঠান এবং সাংবাদিকতা, গবেষণা এবং ভাষা ও সাহিত্যে একজন করে একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন।
ভাষা আন্দোলন ক্যাটাগরিতে খালেদা মঞ্জুর-ই খুদা, বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম শামসুল হক (মরণোত্তর) এবং হাজী মোহাম্মদ মজিবুর রহমান। শিল্পকলা বিভাগে অভিনয় ক্যাটাগরিতে মাসুদ আলী খান ও শিমুল ইউসুফ এবং সংগীত বিভাগে মনোরঞ্জন ঘোষাল, গাজী আবদুল হাকিম ও ফজল-এ-খোদা (মরণোত্তর), আবৃত্তি বিভাগে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, শিল্পকলায় নওয়াজিশ আলী খান এবং চিত্রকলা বিভাগে কনক চাঁপা চাকমা পুরস্কার পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ বিভাগে মমতাজ উদ্দিন (মরণোত্তর), সাংবাদিকতায় মো. শাহ আলমগীর (মরণোত্তর), গবেষণায় ড. মো. আব্দুল মজিদ, শিক্ষায় অধ্যাপক ড. মযহারুল ইসলাম (মরণোত্তর), সমাজসেবায় মো. সাইদুল হক, অ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইসলাম (মরণোত্তর) এবং রাজনীতিতে আকতার উদ্দিন মিয়া (মরণোত্তর) এবং ভাষা ও সাহিত্যে ড. মনিরুজ্জামান পুরস্কার পেয়েছেন। শিক্ষা ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর এবং সমাজসেবায় বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এ পুরস্কার লাভ করেছে।
পুরস্কার হিসেবে প্রত্যেককে স্বর্ণপদক, সম্মাননা সনদ এবং চার লাখ টাকার চেক প্রদান করা হয।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন পদক বিতরণ পর্বটি সঞ্চালনা ও পদক বিজয়ীদের সাইটেশন পাঠ করেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর স্বাগত বক্তৃতা করেন।
মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, উর্ধ্বতন বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, বিদেশি আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ এবং কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পীসহ দেশ বরেণ্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও বুদ্ধিজীবিগণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে আমাদের আসতে হয়েছে, এখনকার প্রজন্ম যার অনেক কিছু জানেও না।
তিনি বলেন, উর্দ্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রচেষ্টা, রোমান ও আরবি হরফে বাংলা লেখানোর প্রচেষ্টা এমনকি রবীন্দ্র সঙ্গীতও অন্যদের দিয়ে লেখানোর প্রচেষ্টা বাঙালি দেখেছে, কিন্তু আমরা তখন আন্দোলন করেছি সকলে মিলে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রসহ সারা বাংলাদেশে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে এবং এভাবেই আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম আরো দানা বেঁধেছে। আর সেই সংগ্রামের মধ্যদিয়েই আমরা জাতির পিতার নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতাও অর্জন করেছি।
ভাষা ও সাহিত্যের ওপর এমন বার বার আঘাত আর কোন দেশে এসেছে বলে তাঁর জানা নেই উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, অনেক দেশে যুদ্ধের মধ্যেও তাদের সাহিত্য সংস্কৃতি চলমান থাকে। ব্রিটিশ এবং ফ্রান্সের মধ্যে সারাজীবন শত্রুতা চললেও তাদের আর্ট, কালচার ও ভাষা-সাহিত্যচর্চা কোনদিনই বন্ধ ছিল না। কিন্তু, আমাদের পাকিস্তান নামের একই দেশে বাঙালিদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর বার বার আঘাত এসেছে।
তিনি বলেন, কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর থেকেই আমরা সব সময় চেষ্টা করেছি আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি যেন সুন্দরভাবে বিকশিত হয় এবং আমরা বাঙালি এই বাঙালি হিসেবেই বিশ^দরবারে মাথা উঁচু করে চলবো। আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি কাজেই এই দেশকে আমরা আরো এগিয়ে নিয়ে যাব উন্নয়নের পথে।
জাতির পিতা মাত্র ৩ বছর ৭ মাস ক্ষমতায় ছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যেই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলে তিনি জাতিসংঘের কাছ থেকে স্বল্পোন্নত দেশের স্বীকৃতি এনে দিয়েছিলেন। বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য পদ লাভ বাংলাদেশকে একটা উচ্চ মর্যাদায় নিয়ে গিয়েছিল। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর আমাদের সেই মর্যাদা ভূলুন্ঠিত হয়।

এরপর একুশ বছর পর ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পুণরায় সরকার গঠন করলে দেশের স্তিমিত উন্নয়ন অগ্রযাত্রা গতি লাভ করে এবং বিগত ৩ মেয়াদে টানা সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকায় বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। কাজেই এই দেশকে এখন আর কেউ পেছনে টানতে পারবেনা, বলেন তিনি।
তিনি একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি অর্জনে কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশী সালাম ও রফিক এবং ‘ভালবাসি মাতৃভাষা’ নামক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার উল্লেখ করেন। তাঁদের এবং আওয়ামী লীগ সরকারের জোর প্রচেষ্টাতেই ইউনেস্কো অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি দিয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘শহীদের রক্ত কখনো বৃথা যায়না, বৃথা যায়নি। যারা আত্মত্যাগ করেছেন তাদের সেই অবদান আমরা সবসময় স্মরণ করি।’
তিনি একুশে পদক প্রাপ্ত গুণিজন সকলকে তাঁর আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, আমাদের সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন অনেক গুণিজন রয়েছেন যাদের অনেকে নামটি পর্যন্ত জানে না এই পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে তাদের অবদানকেই সকলের সামনে নিয়ে আসায় তাঁর সরকারের প্রচেষ্টা। এজন্য সম্মাননা প্রাপ্তদের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে।
সরকার প্রধান বলেন, আমি আশাকরি আমাদের নতুন প্রজন্মও এভাবে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখবে। কারণ, গুণিজনদের পদাংক অনুসরণ করেই আমাদের দেশকে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা আমাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেব কিন্তু আধুনিক বিশে^র সাথে আধুনিক প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব এবং আমাদের লক্ষ্য ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত সমৃদ্ধ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ আমরা গড়ে তুলবো।

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 13612
  • Total Visits: 1626997
  • Total Visitors: 4
  • Total Countries: 1708

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ রবিবার, ২৩শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ ইং
  • ১১ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (বসন্তকাল)
  • ২৪শে শা'বান, ১৪৪৬ হিজরী
  • এখন সময়, রাত ৯:৪৭

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
     12
2425262728  
       
15161718192021
293031    
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018