অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : চাঁদপুরের সঙ্গে সীমান্তবর্তী এলাকা ও আন্তঃজেলা যোগাযোগের জন্য সড়ক, রেল ও নৌপথের ব্যবস্থা রয়েছে। যে কারণে খুবই সহজেই মাদক কারবারিরা এই জেলার রুটগুলো ব্যবহার করে। কিন্তু জেলার মাদক নিয়ন্ত্রণে রক্ষক হিসেবে যারা দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ ভক্ষকের ভূমিকা পালন করায় কারবারিদের জন্য মাদক বেচাকেনার বড় ধরনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। চাঁদপুর জেলার মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাদক বেচাকেনার সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িত বলে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে সম্প্রতি লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় তারা এখনও সদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
অভিযুক্তরা হলেন চাঁদপুর জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এসআই পিয়ার হোসেন, সহকারী এসআই মো. সাইফুল ইসলাম ও পরিদর্শক (ভারপ্রাপ্ত) সেন্টু রঞ্জন নাথ। জেলা মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক এ কে এম দিদারুল আলম গত ১৩ সেপ্টেম্বর তাদের বিরুদ্ধে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্ত চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ পাঠানো হলেও এখন পর্যন্ত তারা চাঁদপুর জেলা কার্যালয়ে বহাল তবিয়তে। এই অভিযোগের অনুলিপি একই সাথে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকায় মহাপরিচালক (ডিজি) ও পরিচালকের (অপারেশন ও গোয়েন্দা) কাছে পাঠানো হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সেন্টু, পিয়ার ও সাইফুল নামে ৩ কর্মকর্তা চাঁদপুরে যোগদান করার পর থেকে গত ৫ বছরে বিভিন্ন সময় মাদক কারবারিদের সঙ্গে গোপনে সখ্যতা গড়ে তোলেন। যার কারণে মাদকের বড় ধরনের কোনো মামলা উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। একই সাথে তারা মাদক কারবারিদের কাছ থেকে মাসিক হিসেবে নগদ টাকা নিতেন বলেও কয়েকজন কারবারি অভিযোগ করেছেন। শুধুই তাই নয়, এই তিনজন সংঘবদ্ধভাবে মাদক বিক্রিতে কারবারিদের বাধ্য করতেন।
এই ৩ কর্মকর্তার মাদক বেচাকেনার অনুসন্ধ্যানে গিয়ে কথা হয় একাধিক মাদক বিক্রেতার সঙ্গে। তাদের কথাগুলো সংরক্ষণ করেছেন এই প্রতিনিধি। একই সঙ্গে ৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এক সপ্তাহ আগে শহরের ভুক্তভোগীরা জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
চাঁদপুর শহরের আদালাত পাড়া এলাকার অন্যতম মাদক বিক্রেতা দেওয়ান মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমি এক সময় মাদকের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। কিন্তু আমার সন্তানরা বড় হওয়ার পর এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু এরপরও ভালো থাকতে পারেনি। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ৩ কর্মকর্তা সাইফুল, পিয়ার ও সেন্টু আমাকে মাদক বিক্রি করতে বাধ্য করেছে। সাইফুলের বাড়ি কুমিল্লা হওয়ায় তারা সেখান থেকে মাদক নিরাপত্তা দিয়ে এনে আমাকে দিয়ে বিক্রি করিয়েছে। এর জন্য তারা আমার কাছ থেকে মাসিক ৩০হাজার টাকা নিতেন। তাদের কারণে আমি চাঁদপুর থেকে ফরিদগঞ্জে বাসা নিয়েছি। সেখানে গিয়েও তারা আমার সঙ্গে মাসিক নির্ধারিত টাকা না দেওয়ায় সমস্যা করে ও আমাকে মাদক দিয়ে চালান দেয়।’
শহরের কয়লা ঘাট এলাকার লোক কলোনীর মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সোর্স রিপন ঢালী জানান, আমি দীর্ঘদিন সোর্স হিসেবে কাজ করি। সম্প্রতি সাইফুল, পিয়ার ও সেন্টু এই ৩ কর্মকর্তা মাদক বিক্রেতা রানা, রহিমসহ তার সহযোগীদের টাকা খেয়ে ছেড়ে দিয়েছে। এছাড়া, শহরের খুচরা মাদক বিক্রেতা ক্লাব রোডের জোনাকি, আল-আমিনের স্ত্রী, লেংড়ি খালা, রাজিব, লাকী, রানা, বারেক ও জসিম মিজি থেকে সাপ্তাহিক অন্তত ৩০ হাজার টাকা করে নেয়। তাছাড়া মাদক বিক্রেতা শাহাজাহান ঘর থেকে ৮০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট পেয়ে না এনে ১ লাখ টাকা নিয়ে আসেন ওই অসাধু ৩ কর্মকর্তা।
শহরের জামতলার চিহ্নিত মাদক বিক্রেতা শাহজাহানের স্ত্রী ইয়াছমিন আক্তার পুতুল বলেন, ‘আমার স্বামী মাদকের সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন নেই। আমার স্বামী মাদক খায়, কিন্তু বিক্রি করে না। যখন বিক্রি করেছে তখন মাদক অফিসের কর্মকর্তা সাইফুল, পিয়ার ও সেন্টু মাসিক টাকা নিতেন। এখন মাসিক টাকা না দেওয়ায় বিভিন্নভাবে হয়রানি ও মামলার হুমকি দিচ্ছে।’
অধিদপ্তরের অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, এই অভিযুক্ত তিনজন চাঁদপুর শহরের একাধিক মাদক ব্যবসায়ির সঙ্গে জড়িত। অভিযানের আগে তারা মুঠোফোনে কারবারিদেরকে জানিয়ে দিতেন। যে কারণে অভিযান করেও সফলতা পাওয়া যায়নি। যার ফলে কাজের ধীরগতি ও তাদের কারণে অধিদপ্তরের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে বলা হয়।
অভিযুক্ত ৩ কর্মকর্তা সাইফুল, পিয়ার হোসেন ও সেন্টু রঞ্জন দেবনাথ এর বক্তব্য নেয়ার জন্য তাদের ব্যাক্তিগত মোবাইল নম্বরে বেশ কয়েকবার ফোন করা হয়। কিন্তু তারা ফোন রিসিভ করেননি। পরে রোববার (১ অক্টোবর) অফিস চলাকালীন সময়ে তাদের দপ্তরে গিয়েও তাদেরকে পাওয়া যায়নি। তাদের অপারেশন কক্ষটি বন্ধ থাকায় তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা যায়নি। এই প্রতিনিধি তাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করেন।
চাঁদপর জেলা মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক এ কে এম দিদারুল আলম বলেন, ‘আমি এই জেলায় আগেও ছিলাম। চলতি বছরের জুনে এসে আবার যোগদান করেছি। এখানকার প্রশাসন ও অন্যান্য লোকজন আমার পরিচিত হওয়ায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আমার কাছে বিভিন্নভাবে অভিযোগ আসতে থাকে। এগুলো আমার কাছে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলে আমাকে লিখিত দেয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয় ও গত ১৩ সেপ্টেম্বর বিভাগীয় অতিরিক্ত পরিচালকের নিকট লিখিত অভিযোগ পাঠাই। অধিদপ্তর তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি দেখবেন। তবে অভিযোগ দেওয়ার পরে তারা নিজেদের রক্ষায় সংঘবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন ধরণের অপপ্রচার চালাচ্ছে।
এদিকে এসব অভিযোগের বিষয়ে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় অতিরিক্ত পরিচালক জাফর উল্যাহ কাজলকে প্রশ্ন করেন এই প্রতিনিধি। জবাবে তিনি বলেন, ‘এসব অভিযোগের বিষয়ে আমাদের প্রধান দপ্তর কাজ করছে। আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না।’
Leave a Reply