অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : মার্কিন কূটনীতিক, বিতর্কিত নোবেল বিজয়ী ও বাংলাদেশের তলাবিহনি ঝুড়ির খেতাব প্রদানকারী হেনরি কিসিঞ্জার মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ১০০ বছর।
স্থানীয় সময় বুধবার তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাটে তার নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। বার্তা সংস্থা রয়টার্স কিসিঞ্জার অ্যাসোসিয়েটস এর বরাতে নিশ্চিত করেছে এ খবর।
কিসিঞ্জার ছিলেন হার্ভার্ডের একজন অধ্যাপক যিনি পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে নাম লেখান। মার্কিন-সোভিয়েত শীতল যুদ্ধের অন্যতম কারিগর মনে করা হয় তাকে।
১৯২৩ সালে জার্মানিতে তার জন্ম হলেও ১৯৩৮ সালে তার পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে আসে। ১৯৪৩ সালে তিনি মার্কিন নাগরিকত্ব পান এবং তিন বছরের জন্য দেশটির সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।
ব্যাচেলর, মাস্টার্স এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি হার্ভার্ডের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তাকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন। এর মাধ্যমে তিনি মার্কিন রাজনীতিতে বিপুল ক্ষমতা লাভ করেন। এর মাধ্যমে তার পূর্ণকালীন অধ্যাপনাও শেষ হয়।
পরে তিনি নিক্সনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের আমলেও তিনি একই পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালে ইসরায়েল এবং প্রতিবেশীদের ইয়ম কিপুর যুদ্ধ এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে প্যারিস শান্তিচুক্তি করে ব্যাপক আলোচনায় আসেন।
১৯৭৩ সালেই তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। এ নিয়ে শুরু হয় চরম বিতর্ক। তার সঙ্গে নোবেল পান উত্তর ভিয়েতনামের নেতা লি ডুক থো, যিনি এটি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন।
জার্মানিতে জন্ম নেওয়া এ কূটনীতিক ছিলেন ইহুদী ধর্মের অনুসারী। রাজনীতি করতেন রিপাবলিকান দলে।
আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন কিসিঞ্জার অ্যাসোসিয়েটস। এটি একটি রাজনৈতিক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে দক্ষিণ এশিয়া পরিস্থিতি নিয়ে হওয়া এক বৈঠকে বাংলাদেশে খাদ্য সহায়তার কথা উঠলে কিসিঞ্জার ‘বাস্কেট কেস’ প্রসঙ্গ তোলেন। এরপর থেকে ‘বটমলেস বাস্কেট’ বা তলাবিহীন ঝুড়ি কথাটা বাংলাদেশের হয়ে যায়।
বৈঠকে আলোচনা হচ্ছিল মূলত পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে। বিশেষ করে মার্চে যে বাংলাদেশে বড় ধরনের খাদ্যসংকট হবে, দুর্ভিক্ষও হবে—এ বিষয়গুলো নিয়ে। একপর্যায়ে বৈঠকের কথোপকথনে ‘বটমলেস বাস্কেট’’ প্রসঙ্গ আসে। অর্থাৎ, দেশটিতে যে সাহায্য দেওয়া হোক, তা ঝুড়ির ফুটো দিয়ে পড়ে যাবে। এরপর থেকে দীর্ঘ বছর পর্যন্ত প্রসঙ্গ এলেই বাংলাদেশকে বলা হতো বটমলেস বাস্কেট।
সেই বৈঠকে বক্তব্য রাখার সময় মার্কিন সেনাপ্রধান চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল উইলিয়াম ওয়েস্টমোরল্যান্ড বলেন, ১৯৭২ সালের মার্চের মধ্যে বাংলাদেশে আরও অনেক ধরনের সহায়তা প্রয়োজন হতে পারে। তার জবাবে জাপানে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউ এলেক্সিস জনসন বলেন, সেটা (বাংলাদেশ) হবে একটা ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস। যেখানে বৈদেশিক সহায়তার কোনো হিসাব-নিকাশ থাকবে না।
এলেক্সিস জনসনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কিসিঞ্জার বলেছিলেন, বাংলাদেশ শুধু আমাদের (যুক্তরাষ্ট্র) বাস্কেট কেস না। ওই সভায় উপস্থিত সবার চেয়ে পদাধিকার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন কিসিঞ্জার। সেই কারণেই হয়তো তার সভাপতিত্বে হওয়া বৈঠকে সব আলোচনায় দায়ভার এড়াতে পারেননি কিসিঞ্জার। সেই থেকে চালু হয়ে যায়, কিসিঞ্জারই প্রথম তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ বাংলাদেশের ওপর চাপিয়েছেন।
১৯৭১ সালের সেই বৈঠকের পর প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলোতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এলেই ‘বটমলেস বাস্কেট’ বলে উল্লেখ করতে শুরু করে। ১৯৭২ সালের ৮ অক্টোবর বাংলাদেশের খাদ্যসংকট ও খাদ্য সহায়তা নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত নিবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘বটমলেস বাস্কেট’। প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমটির সম্পাদকীয়ের শিরোনাম ছিল, ‘ওয়ান ম্যান’স বটমলেস বাস্কেট কেস’।