অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : এক শতাব্দী আগেও আমেরিকার নির্বাচনের খরচের মাত্র ০.২৫% আসত শীর্ষ ১০০ ধনী ব্যক্তির পকেট থেকে। কিন্তু আজ পরিস্থিতি পুরো পাল্টে গেছে—এখন মার্কিন ফেডারেল নির্বাচনে খরচ হওয়া প্রতি ১৩ ডলারের মধ্যে ১ ডলার সরাসরি আসে বিলিয়নেয়ারদের পকেট থেকে। ওয়াশিংটন পোস্ট এই পরিবর্তনকে বর্ণনা করেছে—“আমেরিকার রাজনীতির দখলদারিত্ব বিলিয়নেয়ারদের হাতে।”
গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতার কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে, যেখানে শীর্ষ ধনী ব্যক্তিরা কেন্দ্রীয় ভূমিকা দখল করেছেন। ওয়াশিংটন পোস্ট-এর “কিভাবে বিলিয়নেয়াররা আমেরিকার রাজনীতি দখল করল” শিরোনামের নিবন্ধে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখানো হয়েছে যে, অতি অল্পসংখ্যক ধনী মানুষের হাতে সম্পদের কেন্দ্রীকরণ কীভাবে গণতন্ত্রকে বিপদে ফেলছে। শুধু নির্বাচন নয়, তাদের প্রভাব নীতিনির্ধারণ ও সরকারি নিয়োগ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।
২০০০ সালে আমেরিকার শীর্ষ ১০০ ধনী ব্যক্তি ফেডারেল নির্বাচনী খরচে মাত্র ০.২৫% (৪৬ মিলিয়ন ডলার) দিয়েছিলেন। কিন্তু ২০২৪ সালে এই অর্থ বেড়ে দাঁড়ায় ৭.৫% অর্থাৎ ১.১ বিলিয়ন ডলার!
আগে এক দশকে এদের গড় অনুদান ছিল বছরে ২১ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই পরিমাণ দ্রুত বেড়ে গিয়ে ২০২৪ সালে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর অর্থ হলো, মার্কিন রাজনৈতিক দলগুলো ক্রমেই বিলিয়নেয়ারদের ওপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে উঠছে।
২০২৪ সালে এই শীর্ষ ধনীদের ৮০ শতাংশ অনুদান রিপাবলিকান ও রক্ষণশীল গোষ্ঠী পেয়েছে। ২০২০ সালের তুলনায় এটি বড় পরিবর্তন, যখন প্রযুক্তি ও আর্থিক খাতের বিলিয়নেয়াররা ডেমোক্র্যাটদের বেশি অর্থ দিয়েছিলেন।
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ক একাই ২৯৪ মিলিয়ন ডলার ট্রাম্প ও রিপাবলিকানদের দিয়েছে এবং সে সময়ে তিনি টেসলায় নিজের ১ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ নিশ্চিত করেন।
এই প্রভাব শুধু দানে সীমাবদ্ধ নয়। ২০১০ সালে “সিটিজেন্স ইউনাইটেড” নামের একটা আদালতের রায়ের পর কোম্পানি ও ব্যক্তিরা নির্বাচনে অসীম টাকা খরচ করতে পারছে। এর ফলে “সুপার পিএসি” নামের সংগঠনগুলো এখন সবচেয়ে বড় অস্ত্র। ২০১৫ সাল থেকে অন্তত ৪৪ জন বিলিয়নেয়ার বা তাদের স্ত্রী/স্বামী সরাসরি রাজ্য বা ফেডারেল পদে বসেছেন।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফা শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ১৭ জন বিলিয়নেয়ার, যাদের সম্মিলিত সম্পদ এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি—এদের মধ্যে ছিলেন মাস্ক, বেজোস, জাকারবার্গ, বার্নার্ড আরনো, টিম কুক, রুপার্ট মারডক প্রমুখ।
ট্রাম্পের মন্ত্রিসভার মোট সম্পদ ছিল ৭.৫ বিলিয়ন ডলার, যা আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে ধনী মন্ত্রিসভা।
এটা ১৯ শতকের “গিল্ডেড এইজ” বা সোনালী যুগের কথা মনে করিয়ে দেয় – যখন কয়েকজনের হাতে সব টাকা আর ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল। আজ আমেরিকায় ৯০২ জন বিলিয়নেয়ারের মোট সম্পদ ৬.৭ ট্রিলিয়ন ডলার– মাত্র ১০ বছর আগের চেয়ে দ্বিগুণ!
২০২৪ সালের ওয়াশিংটন পোস্ট–ইপসোস জরিপে দেখা যায়, অধিকাংশ আমেরিকান মনে করেন—বিলিয়নেয়ারদের বাড়তি প্রভাব ‘খুব খারাপ’। মাত্র ১২ শতাংশ মানুষ এটিকে ইতিবাচক বলে মনে করেন।
ফলাফল আরও স্পষ্ট যে, মার্কিন গণতন্ত্র ধীরে ধীরে বিলিয়নেয়ারদের প্রজাতন্ত্রে পরিণত হচ্ছে।
যদি সুপার পিএসি’র ওপর কড়া নিয়ম না আসে, তাহলে আমেরিকা আর গণতন্ত্র থাকবে না– থাকবে শুধু একটা ‘বিলিয়নেয়ারদের প্রজাতন্ত্র’। ২০২৪ সালে ট্রাম্প ২০১৬ সালের চেয়ে ১৫ গুণ বেশি টাকা ধনীদের কাছ থেকে তুলেছেন। কমলা হ্যারিসও হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে তিন গুণ বেশি তুলেছেন। টাকা যত বাড়ছে, সাধারণ মানুষের কথা তত কম শোনা যাচ্ছে।
এ কারণেই বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক অর্থায়নে সংস্কার না এলে যুক্তরাষ্ট্র আরও স্পষ্টভাবে একটি ‘বিলিয়নেয়ারদের প্রজাতন্ত্রে’ রূপ নেবে—যেখানে নীতি নির্ধারিত হবে অল্প কয়েকজন অতিধনীর স্বার্থে, আর সাধারণ মানুষের কণ্ঠ আরও ক্ষীণ হয়ে পড়বে।