“ হক কথার পর আর সবই ভ্রান্তি।” (সূরা ঃ ইউনুস ঃ আয়াত ঃ ২২)
“আমি এ কিতাবে কোন কিছু বাদ দেইনি।” (সূরা ঃ আনআম ঃ আয়াত ঃ ৮)
“যদি তোমরা কোন ব্যাপারে পরস্পর মতবিরোধি হও তবে সে ব্যাপারটি মহান আল্লাহ তা’আলা ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও।” (সূরা ঃ নিসা ঃ আয়াত ঃ ৫৯)
‘আর আমার এই রাস্তা সরল ও মজবুত, কাজেই তোমরা এই রাস্তায়ই চল, এ রাস্তা ব্যতীত অন্য সব রাস্তায় চলো না, তা তোমাদেরকে তার রাস্তা হতে সরিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেবে।’ (সূরা ঃ আনআম ঃ আয়াত ঃ ১৫৩)
“তুমি বলে দাও তোমরা যদি মহান আল্লাহ তা’আলাকে ভালবাস তবে আমার অনুসরণ কর।” (সূরা ঃ আল ইমরান ঃ আয়াত ঃ ৩১)
১. হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-রসুলুল্লাহ সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বক্তৃতা দিতেন তখন তার চোখ দু’টি লাল হয়ে যেত। তার আওয়াজ বড় হয়ে যেত এবং তার রাগ বৃদ্ধি পেত যেন তিনি কোন সেনাবাহিনীকে সতর্ক করছেন। তিনি বলতেন, মহান আল্লাহ তা’আলা তোমাদের সকাল-সন্ধ্যায় ভাল রাখুন। তিনি আরও বলতেন আমাকে কিয়ামতসহ এভাবে পাঠানো হয়েছে। এ কথা বলে তিনি তার মধ্যমা ও তর্জনি অঙ্গুলি মিশাতেন, তিনি আরও বলতেন, সবচেয়ে ভাল কথা হচ্ছে, মহান আল্লাহ তা’আলার কিতাব, আর সবচেয়ে ভাল আদর্শ হচ্ছে রসুলুল্লাহ সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদর্শ। আর দ্বীনের ব্যাপারে নতুন বিষয়গুলো অর্থাৎ নতুন বিষয় সৃষ্টি করা সবচেয়ে খারাপ। আর সব বিদা’আতই ভ্রান্তি। তারপর তিনি বলতেন, আমি প্রত্যেক মু’মিনের জন্য আর নিজের চেয়ে উত্তম। যে লোক কোন সম্পদ রেখে যায় তা তার পরিবার বর্গের জন্য। আর যে লোক কোন ঋণ অথবা অসহায় সন্তান রেখে যায় তার দায়িত্ব আমারই উপর। (মুসলিম)
নামাযের ফযীলত সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা কুরআন মাজীদে বলেন ঃ “নিশ্চয়ই নামায মানুষকে অশ্লীলতা ওঅন্যায় কার্য হইতে ফিরাইয়া রাখে” (যারা) ভয় ও নম্রতার সহিত নামায আদায় করে তাহারাই মুক্তি লাভ করিবে।”
আল্লাহ তা’আলা অন্য আর এক আয়াতে এরশাদ করেন ঃ
“যাহারা স্বযত্নে নামায আদায় করিবে, তাহারাই বেহেশতে মর্যাদার অধিকারী হইবে।”
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত রসুলুল্লাহ (সঃ) ফরমাইয়াছেন ঃ যখন কোন লোক নিয়মিত অযু করতঃ ভয় ও ভক্তির সহিত নামায আদায় করিবে, তাহার জন্য আল্লাহ পাক জাহান্নামের আগুন হারাম করিয়া দিবেন এবং রোজ কেয়ামতে ঐ নামাযই তাহাকে জাহান্নাম হইতে মুক্তি দিবে।
অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত রসুলুল্লহ (সঃ) ফরমাইয়াছেন ঃ পাঁচ ওয়াক্তের নামায উহার মধ্যস্থিত সময়ের গুনাহ্ মিটাইয়া দেয়। (অর্থাৎ এক ওয়াক্ত নামায হইতে অন্য ওয়াক্ত নামাযের মধ্যবর্তী সময়ে যেই গুনাহ্ করা হয় দ্বিতীয়বার নামায আদায় করিলে উহা মাফ হইয়া যায়) আর জুম্মা’র নামায এক জুমুয়া’ হইতে পরবর্তী জুমুয়া’ পর্যন্ত সময়ের গুনাহ্ মিটাইয়া দেয়। (মুসলিম)
একদা হযরত রসুলুল্লাহ (সঃ) উপস্থিত সাহাবাগণকে উদ্দেশ্য করিয়া ফরমাইলেন ঃ যদি কাহারো বসবাসকৃত গৃহের অতি নিকট দিয়া পানির নহর প্রবাহিত হইতে থাকে এবং সেই লোক উক্ত প্রবাহিত নহরে প্রত্যহ পাঁচ বার গোসল করে, তবে কি তাহার শরীরে ময়লা থাকিতে পারে? তখন সাহাবায়ে কেরামগণ বলিলেন, ইয়া রাসুলুলাহ! পাঁচ বার গোসল করার পর কি প্রকারে শরীরে ময়লা থাকিতে পারে? অতঃপর হযরত রাসুলুলাহ (সঃ) ফরমাইলেন ঃ যেইভাবে পাঁচবার গোসলকারী ব্যক্তির শরীরে ময়লা থাকিতে পারে না, তদ্রুপ পাঁচ ওয়াক্ত নামায কায়েমকারীর কোন গুনাহই অবশিষ্ট থাকিতে পারে না। নামায গুনাহকে মিটাইয়া দেয়। (বোখারী ও মুসলিম)
অন্য এক হাদীসে বর্ণিত আছে, হযরত আবু যার (রাঃ) বর্ণনা করেন, একদা হযরত রসুলুল্লাহ (সঃ) শীতের মৌসুমে বাহিরে তাশরীপ নিয়াছিলেন, তখন তিনি বৃক্ষের একটি শাখা ধরিলেন, সঙ্গে সঙ্গে শাখা হইতে সমস্ত পাতা ঝরিয়া পড়িল। তৎসময় রসুলুল্লাহ (সঃ) ফরমাইলেন ঃ কোন মুসলমান ব্যক্তি নামায আদায় করিলে তাহার গুনাহ সমূহ এই পাতাগুলি যেইরূপ ঝরিয়া পড়িল সেইরূপ ঝরিয়া যায়। (মেশকাত)
“নিশ্চয়ই নামায অশ্লীল অসৎকাজ থেকে মানুষকে বারণ করে।” (সূরা ঃ আনকাবুত ঃ আয়াত ঃ ৪৫)
আল্লাহ তা’আলা সুরা হুদের ১১৪ তম আয়াতে এরশাদ করেন ঃ
“তোমরা নামায আদায় করিবে দিনের দুই প্রান্তভাগে ও রাত্রির প্রথমাংশে। নিশ্চয়ই সৎকাজ অসৎকাজকে দূর করিয়া দেয়। যাহারা উপদেশ গ্রহণ করিয়া থাকে তাহাদের জন্য ইহা এক উপদেশ।”
কুরআন শরীফের সূরা বাকারার ১৫৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন ঃ
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্যের জন্য প্রার্থনা কর।”
এই আয়াতের মাধ্যমে বুঝা যাইতেছে যে, যদি কোন মুসলমান ব্যক্তি মূছীবতে পতিত হইয়া ধৈর্য্য ধারণ করতঃ নফল নামায আদায় করিয়া বিপদ মুক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে, তবে তিনি তাহার বিপদ দূর করিয়া দিবেন।
হযরত হুযাইফা (রাঃ) বর্ণনা করিয়াছেন, হযরত রসুলুল্লাহ (সঃ) যখন কোন কঠিন অবস্থান সম্মুখীন হইতেন, তখন তিনি নামায আদায় করিতেন। তাফসীরে দুর্রে মানসূরে উল্লেখ আছে, একদা (রসূল কন্যা) হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ) এর স্বামী হযরত আব্দুর রহমান (রাঃ) রোগে আক্রান্ত হইয়া এমনি অবস্থায় পৌছিয়াছিলেন যে, সকল মানুষেই তাঁহাকে মৃত্যু বলিয়া ধারণা করিয়াছিলেন। এমনি অবস্থায় রসূল কন্যা হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ) তাঁহার স্বামী হযরত আব্দুর রহমান (রাঃ)-এর বিছানা হইতে উঠিয়া গিয়া নফল নামায আদায় করতঃ আল্লাহর দরবারে অনুনয়-বিনয় সহকারে স্বামীর রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনা করিলেন, এতে মহান আল্লাহ তাঁহার স্বামীকে রোগ হইতে আরোগ্য প্রদান করিয়াছিলেন।
আল্লাহ তা’আলা কুরআন মাজীদের সূরা মাউ’ন এ বলেন ঃ
“অতএব আক্ষেপ ঐ নামাযীদের জন্য। যাহারা তাহাদের নামায হইতে উদাসীন থাকে। আর যাহারা লোক দেখানো জন্য করে।”
অর্থাৎ যাহারা আলস্য করিয়া সময়মত নামায আদায় করে না, আর লোক দেখানো নামায পড়ে, যখন মানুষের সঙ্গে থাকে তখন নামায পড়ে এবং যখন একাকী থাকে কিংবা কাজে ব্যস্ত থাকে অখন নামায পড়ে না, সেই সব লোকের জন্য পরকালে দোযখের শাস্তি রহিয়াছে।
‘মাজালিছুল আবরার’ নামক কেতাবে বর্ণিত আছে, হযরত রসুলুল্লাহ (সঃ) ফরমাইয়াছেন ঃ যেই লোক সময়মত নামায পড়িল না, নামাযের ওয়াক্ত শেহ হইবার পরে নামাযের কাজা পড়িল, সেই লোকও জাহান্নামে আশি (৮০) হুকবা আযাব ভোগ করিবে। ৮০ ৮০ = ২৮,৮০০´বৎসরে এক হুকবা আর ৩৬০ দিনে এক বৎসর (আরবি হিসাবে)। ৩৬০ দিন, অতএব তাহাকে আটাশ হাজার আটশত দিন এক ওয়াক্ত নামায না পড়িবার জন্য দোযখের আগুনে জ্বলিতে হইবে। আর আখেরাতের এক দিন হইবে দুনিয়ার এক সহস্র বৎসরের তুল্য। এই হিসাবে এক ওয়াক্ত নামায তরককারীকে দুইকোটি অষ্টাশি বৎসর জাহান্নামের আগুনে শাস্তি ভোগ করিতে হইবে।
হাদীস শরীফে বর্ণিনত আছে, হযরত আব্দুলাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করিয়াছেন, হযরত রসুলুল্লাহ (সঃ) ফরমাইয়াছেন ঃ জাহান্নামের মধ্যে একটি বড় গর্ত রহিয়াছে, উাহার নাম ‘ওয়াইল’। ইহা এতই কঠোর আযাবের সামগ্রী দ্বার পরিপূর্ণ যে , জাহান্নামের অন্যান্য অধিবাসীগণ প্রত্যহ একশত বার আল্লাহর দরবারে দোয়া করিয়া থাকে, যে আল্লাহ! আমাকে ‘ওয়াইল’ দোযখ হইতে রক্ষা করিও। এই ওয়াইল দোযখে আখেরাতে বে-নামাযীদের দ্বরা পরিপূর্ণ করা হইব। হে আল্লাহ আমাদিগকে উহা হইতে রক্ষা কর। আমিন
আর এক হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত রসুলুল্লাহ (সঃ) ফরমাইয়াছেন ঃ যাহারা নামাযে অলসতা করিবে তাহাদিগকে আলল্লহ পাক ১৫টি শাস্তি দিবেন। উহার মধ্যে হইতে ৬টি শাস্তি দুনিয়ায় দিবেন, তিনটি শাস্তি মরণকালে দিবেন, তিনটি শাস্তি অন্ধকার কবরে দিবেন এবং কেয়ামতে ৩টি শাস্তি দিবেন।
দুনিয়ার ৬টি শাস্তি ঃ (১) তাহার জীবনের বরকত সমূহ উঠাইয়া নিবেন। (২) আল্লাহ তা’আলা তাহার চেহারা হইতে কে বখতীর নূর বিতাড়িত করিয়া দিবেন। (৩) তাহার ব্রত নেক কার্যাদির পূর্ণ আমল নামায লিখা হইবে না। (৪) তাহার প্রার্থনা আল্লাহ তা’আলার দরবারে কবুল হইবে না। (৫) মানুষ ও ফেরেশতাগণ তাহার প্রতি ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিবে। (৬) আল্লাহ তা’আলার নেয়ামত সমূহ হইতে বঞ্চিত থাকিবে।
মৃত্যু সময়ের ৩টি শাস্তি ঃ (১) মরণকাল ক্ষধার্ত অবস্থায় মরিবে। (২) অত্যাধিক দূর্দশাগ্রস্ত ও লাঞ্ছিত হইয়া মৃত্যু বরণ করিবে এবং (৩) মৃত্যুর সময় তাহার এত অধিক পিপাসা হইবে যে, সমগ্র পৃথিবীর সমুদ্র সমূহের পানি পান করিলেও তাহার পিপাসা লাঘব হইবে না।
কবররের মধ্যের ৩টি শাস্তি ঃ (১) তাহার কবরটি এতই সংকুচিত হইবে যে, উহাতে পাজরের হাড্ডি ভাঙ্গিয়া চুরমার হইয়া যাইবে। (২) মহান আল্লাহ তা’আলা তাহাকে শাস্তি দিবার জন্য একজন ফেরেশতা নিযুক্ত করিয়া দিবেন, তাহার হাতে অগ্নির মুগুর থাকিবে এবং সে উহা দ্বারা শাস্তি দিতে থাকিবে এবং বলিবে, হে হতভাগা! পৃথিবীতে থাকিয়া কেন নামায সঠিকভাবে আদায় কর নাই । লও, উহার আজাব এখন ভোগ কর, ইহা বলিয়া পিটাইতে থাকিবে, (৩) তাহার কবরের মধ্যে শুজা আকরা নামীয় আগুনের চক্ষু ও লোহার নখ বিশিষ্ট একটি সাপ পাঠানো হইবে। উক্ত সাপটির আঙ্গুলের নখ এক দিবসের রাস্তার দূরত্বের তুল্য দীর্ঘ হইব। সাপটি মুর্দা ব্যক্তিকে বলিবে, তুমি পৃথিবীতে থাকাবস্থায় নামায আদায় কর নাই, সেই জন্য আল্লাহ তা’আলা তোমাকে শাস্তি দিবার জন্য আমাকে পাঠাইয়াছেন। ইহা বলিয়া শুজা আকরা স্বীয় লোহার নখের দ্বারা তাহাকে আঘাত করিতে থাকিবে। এই আঘাতের কারণে বে-নামাযী লোকটি সত্তর গজ মাটির গভীরে চলিয়া যাইবে। তখন শুজা আকরা তাহাকে ধরিয়া টানিয়া বাহির করতঃ পুনঃ আঘাত করিতে থাকিবে এবং টানিয়া বাহির করিয়া পুনঃ পুনঃ আঘাত করিতে থাকিবে। এই প্রকারে রোজ কেয়ামত পর্যন্ত তাহাকে শাস্তি দিতে থাকিবে।
কেয়ামতের ৩টি শাস্তি ঃ , (১) আল্লাহ তা’আলা তাহার প্রতি গজবের সহিত দৃষ্টিপাত করিবেন, ইহাতে তাহার শরীরের সমস্ত মাংস ঝরিয়া যাইবে। অন্য এক রেওয়ায়েতে আছে যে, একজন ফেরেশতা তাহার পদদ্বয় উর্দ্ধমুখী করিয়া এবং মস্তক নিম্নমুখী করতঃ হাশর ময়দানে নিয়া হাজির করিবে। (২) আল্লাহ তা’আলা তাহার হিসাব অতি কড়াকড়িভাবে লইবেন। (৩) শেষ পর্যন্ত তাহাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হইবে এবং তথায় সে চিরকাল আযাব ভোগ করিতে থাকিবে। (কুর্বাতুল উ’য়ুন)
Leave a Reply