গত ৫৪ বছরে সরকারের নানা আইন জারি ও হস্তক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি, দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়নি। ১৬ বছরে এ নির্যাতন সব সীমা ছাড়িয়ে যায়। কার্টুন প্রকাশ ও কঠোর সমালোচনামূলক রিপোর্ট ও নিবন্ধ প্রকাশ বন্ধ করতে বাধ্য হয় গণমাধ্যম। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে সামাজিক সাইটে সরকারের বিপক্ষে পোস্ট আপলোড করার জন্য গ্রেফতার, মামলা ও রিমান্ডের শিকার হয়েছেন অনেকেই। একপর্যায়ে সরকারের সঙ্গে হাত মেলান সুবিধাপ্রত্যাশী কিছু সাংবাদিক এবং মুনাফালোভী মালিক। কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপ গণমাধ্যমে বিনিয়োগ করে তাদের অন্য খাতের ব্যবসায় বিশেষ সরকারি সুবিধা লাভের প্রত্যাশায়। গণমাধ্যমকে তারা সরকার-তোষণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে।
গণমাধ্যমগুলোর দলীয় লেজুড় বৃত্তির কারণে সাংবাদিকতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। বিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়নগুলো দীর্ঘদিন ধরে গণমাধ্যম ও কর্মীদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ। যার কারণে সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সাধারণ গণমাধ্যমকর্মীরা আক্রমণের শিকার হন। একইসঙ্গে গণমাধ্যমের প্রতি এখন মানুষের আস্থা প্রশ্নবিদ্ধ। স্বৈরাচারের ১৬ বছরে মিডিয়া কখনও গণমাধ্যম হওয়ার চেষ্টা করেনি। তারা শুধু সংবাদমাধ্যম হিসেবেই ক্ষমতাসীনদের ফুট-ফরমায়েশ খেটেছে। ফলে তারা গণমানুষ থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
এ কারণে ‘গণমাধ্যম সংস্কারের উদ্যোগে’ নিতে বেশ কয়েকটি দাবির কথা বলা হয়েছে। দাবি গুলোর মধ্যে রয়েছে- ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত সাংবাদিকদের হত্যার বিচার নিশ্চিত করা, ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে ঘিরে আহত গণমাধ্যমকর্মী ও আক্রান্ত গণমাধ্যমকে ক্ষতিপূরণ দেয়া, গণমাধ্যমের যেসব মালিক ও নির্বাহীরা গণমাধ্যমকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে, তদন্ত সাপেক্ষ তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা, গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য অভিন্ন ওয়েজবোর্ড প্রণয়ন এবং অনতিবিলম্বে নবম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করা, শ্রম আইন অনুযায়ী লভ্যাংশ বন্টন করা, অগণতান্ত্রিক উপায়ে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান দখলদারিত্ব বন্ধ করা, গণমাধ্যম কর্মীদের সর্বস্তরের ভয়ভীতি বন্ধ করা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, গণমাধ্যম পরিচালনার ধরনসহ সার্বিক বিষয়ে সংস্কারের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিশন গঠন, গণমাধ্যম ও স্বাধীন মত প্রকাশবিরোধী নিবর্তনমূলক আইনের সকল ধারা বাতিল করা, আইসিটি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার সিকিউরিটি আইনের অধীনে গণমাধ্যমকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সব মামলা প্রত্যাহার করা।
দেশে ৯০ পরবর্তী সময়ে করপোরেট সংবাদমাধ্যম পুঁজির কাছে কুক্ষিগত হতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় গণমাধ্যম তার চরিত্র হারিয়ে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করে। গণমাধ্যম ধীরে ধীরে সংবাদমাধ্যমে রূপ নেয়। গত ৩ দশকে সাংবাদিকতা ডালপালা মেলে অনেকটা মহীরুহ হলেও নীতি-নৈতিকতার বাছ-বিচারসহ মানের দিক থেকে সবকিছুই তলানিতে গিয়ে ঠেকে। সেই অবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য গণমাধ্যমকে প্রকৃত গণমাধ্যমে রূপান্তর করতে সংস্কার জরুরি। সংস্কার করতে যে সকল বিষয়ে নজর দেয়া দরকার তা হচ্ছে- ক) শিক্ষাগত যোগ্যতা ঃ অপসাংবাদিকতা রুখতে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টিও সংস্কার প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন। খ) নিয়োগ পত্র ঃ গণমাধ্যমে নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা নেই। স্বচ্ছতাও নেই। এর ফলে ন্যূনতম অভিজ্ঞতা ছাড়াই পানদোকানদার থেকে কাঠ মিস্ত্রি, জেলে, মাদক ব্যবসায়ীসহ নানা ক্ষেত্রের দাগী অপরাধীরাও সাংবাদিকতায় ঢুকে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বার কাউন্সিলের মতো পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। অন্যদিকে অনেক মিডিয়া হাউজ রয়েছে যারা সাংবাদিকদেরকে নিয়োগপত্র দেয় না। অপেশাদার এমন আচরণ বন্ধ করে বাধ্যতামূলক নিয়োগপত্র দেয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। এছাড়া অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টিও এখন ওপেন সিক্রেট।
গ) বেতন সংক্রান্ত সংস্কার ঃ বিগত কয়েক দশকে সাংবাদিকতা পুঁজির কাছে কুক্ষিগত হলেও এর সুফল পায়নি পেশাদার সাংবাদিকরা। বেতন-ভাতা দেয়া হবে বলে নিয়োগ দিলেও শেষ পর্যন্ত বেতন দেয়া হয় না। দিলেও সেটি হয় অনিয়মিত। যে কারণে অনেক সংবাদকর্মী অনৈতিক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন। এখানে অনেক সাংবাদিক নেতার আচরণও সাংবাদিক সুলভ নয়। অনেকে মালিক পক্ষের দালাল সাজেন। নিজের স্বার্থর্ ক্ষার জন্য সহকর্মীদের স্বার্থ জলাঞ্জলী দেন। ঘ) চাকরির নিশ্চয়তা ঃ পেশাদার সাংবাদিকতায় যারা রয়েছেন,তাদের বেশির ভাগই চাকরি নিয়ে এক অজানা আতঙ্কে থাকেন। কখন যেন আকস্মিক নোটিশে চাকরিহারা হতে হয়। এমনও অনেক সময় হয় যে,রাতে কাজ করে গিয়ে সকালে শুনতে পান তার চাকরি নেই। ঙ) ওয়েজবোর্ড সংশোধন ঃ প্রিন্ট মাধ্যমে ওয়েজবোর্ডের বিষয় থাকলেও টেলিভিশন এবং অনলাইন মাধ্যমে তার বালাইও নেই। সেজন্য কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের মনমতো অন্যায্য বেতন নির্ধারণ করেন। প্রিন্টে ওয়েজবোর্ড থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটি মানা হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাগজে-কলমে ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন দেখিয়ে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেয় পত্রিকাগুলো। এ কারণে ওয়েজবোর্ড সংশোধন করে টেলিভিশন এবং অনলাইন গণমাধ্যম অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। ওয়েজবোর্ড যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা সেটিও মনিটরিং হওয়া প্রয়োজন। চ) পেশাদারিত্ব সংক্রান্ত সংস্কার ঃ অনেক সময় সংবাদমাধ্যমকে লজ্জাবতীর মতো চুপসে যেতে দেখা যায়। আবার বেশকিছু সংবাদমাধ্যম আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে প্রোাপাগান্ডার মেশিনে পরিণত হয়। অন্যদিকে মালিকপক্ষও নানা সুবিধা পেতে নিউজ রুমের কাছে অন্যায় আবদার করে থাকেন। এ জন্য সংবাদমাধ্যমের মালিক, সম্পাদক এবং সাংবাদিকসহ সবার দলীয় লেজুড়বৃত্তি বন্ধ করা দরকার। ছ) প্রচার সংখ্যা ঃ প্রচার সংখ্যা বেশী দেখানোর যে প্রবনতা তা দূর করতে হবে। ঘুষের বিনিময়ে ডিএফপি থেকে প্রচার সংখ্যা বাড়ানোর যে ব্যবস্থা তা দুর করতে হবে। প্রকৃত ছাপার সংখ্যা ঠিক থাকতে হবে। জ) প্রেস কাউন্সিল শক্তিশালীকরণ ঃ প্রেস কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। থানা বা কোর্টে নয়, সংবাদ সংক্রান্ত সব মামলা প্রেস কাউন্সিলে করতে হবে। প্রেস কাউন্সিলের অনুমতি বা অবগতি ব্যতীত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সংবাদ সংক্রান্ত মামলা করতে না দেয়ার বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া দরকার। ঝ) নিবন্ধন সংক্রান্ত সংস্কার ঃ সংবাদমাধ্যমের নিবন্ধন পাওয়ার ক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ে আবেদন নিষ্পত্তি করতে হবে। আবেদন প্রক্রিয়াও অনলাইনভিত্তিক করা জরুরি। নিবন্ধন পেতে হয়রানি, ঘুষ দাবিসহ সব ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে সংবাদমাধ্যমের অবমূল্যায়ন ও হয়রানি বন্ধ করে যেকোনো এক জায়গায় সংবাদমাধ্যমের নিবন্ধন সংক্রান্ত বিশেষ সেল রাখা যেতে পারে। ভেরিফিকেশন থেকে শুরু করে নিবন্ধনসহ সবকিছু বিশেষ সেলের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা করবেন। একইসঙ্গে কালো টাকার মালিক, অসাধু ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, মাফিয়া চক্রসহ অপেশাদার কিংবা রাজনৈতিক বিবেচনায় কাউকে সংবাদমাধ্যমের নিবন্ধন দেয়া যাবে না। এরপরও সরকার কোনো সংবাদমাধ্যম বন্ধ করলে সরকারকে অন্তত ছয় মাস ওই মিডিয়ার সব সংবাদ কর্মী,কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বহন করতে হবে। স্বাধীন বিচার বিভাগের মতো করেই সরকার যেন নিবন্ধন ইস্যু বা অন্য কোনোভাবেই মিডিয়ার ওপর কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ অথবা খবরদারি করতে না পারে সংস্কারের মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ঞ) বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত সংস্কার ঃ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর বর্তমানে প্রিন্ট পত্রিকার প্রচার সংখ্যা ও বিজ্ঞাপন হার নির্ধারণ করে থাকে। যেসব পত্রিকা দৈনিক ৫০০ কপিও ছাপা হয় না, সেসব পত্রিকা লাখ লাখ কপি ছাপানোর ভুয়া তথ্য দেখিয়ে টাকার বিনিময়ে বেশি বিজ্ঞাপন রেট নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। অর্থের বিনিময়ে রেট আপ-ডাউন করানো বন্ধের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। এছাড়া সামগ্রিক মিডিয়াকে শিল্প ঘোষণা করে এই শিল্পের বিকাশে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকারি বিজ্ঞাপনের বিল দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সংবাদের কারণে কোনো গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপন বন্ধ করাকে অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ট) মিডিয়া সিটি তৈরি ঃ বাংলাদেশে মিডিয়া হাউজগুলো পুরো শহরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও এটি কোনো আদর্শ পন্থা নয়। সেক্ষেত্রে মিডিয়া সিটি তৈরি করা যেতে পারে। সেখানে স্বল্পমূল্যে একই ভবনে একাধিক মিডিয়া হাউজের অফিস থাকবে। এটা উৎকৃষ্ট পদ্ধতি হতে পারে। দেশের সবগুলো সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠান এক এলাকায় থাকলে সব দিক থেকেই সুবিধা রয়েছে। সংবাদমাধ্যমের অফিস ছাড়াও সেখানে বা পাশাপাশি কোথাও সংবাদকর্মীদের জন্য ট্রেনিং
সেন্টার এবং আবাসন ব্যবস্থাও তৈরি করা যেতে পারে। ঠ) ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী সাংবাদিক ইউনিয়ন ঃ সংবাদকর্মীদের অধিকার রক্ষায় সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ‘৯০ পরবর্তী কথিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর সময়ে ঐক্যবদ্ধ ইউনিয়ন দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। সাংবাদিকতার আজকের দুর্দিনের জন্য এটিও অন্যতম কারণ। সেজন্য সাংবাদিক ইউনিয়নকে পেশাজীবী সংগঠন করতে হবে। এই সংগঠনগুলো যাতে কোনোভাবেই দলীয় রাজনীতির হাতিয়ার হতে না পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেছেন, গণমাধ্যম মানুষের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, কিন্তু বর্তমানে তা জনমানুষের কথা বলতে ব্যর্থ। সংস্কার ছাড়া গণমাধ্যম গণতন্ত্রের সঠিক প্রতিফলন ঘটাতে পারবে না। সাংবাদিক আশরাফ কায়সার বলেছেন, “গণমাধ্যমকে প্রশ্ন তোলার বদলে প্রশংসার মাধ্যমে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এটি সরকারের দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার ফল। করপোরেট চাপ এবং সরকারি সংস্থার হস্তক্ষেপে গণমাধ্যমের ভূমিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
এদিকে দুর্নীতির মাধ্যমে ডিএফপির কেউ কেউ হয়েছেন বিস্তর অর্থের মালিক। সরকারিভাবে বলা আছে, সর্বশেষ ওয়েজবোর্ড কার্যকর না করলে সরকারি বিজ্ঞাপন পাবে না কোনো পত্রিকা। তবে কিছু পত্রিকা ভুয়া স্যালারি শিট তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। সাংবাদিক-কর্মচারীদের তাতে সই করতে বাধ্য করে। অনেক সময় স্বাক্ষরগুলো হয় জাল। ডিএফপি ও মন্ত্রণালয়ের কতিপয় অসাধু ব্যক্তির যোগসাজশেই এমনটা করা হয়ে থাকে। গণমাধ্যমের জন্য সরকারের অনুমতি (ডিক্লারেশন) প্রাপ্তি নিয়েও নানা ধরনের দুর্নীতি হয়। সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে ডিক্লারেশন প্রাপ্ত কিছু ব্যক্তি ডিক্লারেশন বেচাকেনা করে আর্থিকভাবে লাভবান হন। সাংবাদিক-কর্মচারীদের বড় অংশ সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বরাবরই তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। চাকরিচ্যুতি বা পদত্যাগের কারণে অনেক সাংবাদিক-কর্মচারী তাদের আইনগত প্রাপ্য পাওনা পাননি। অর্থকষ্টে থাকা সাংবাদিকদের জন্য সরকারিভাবে ভিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে। এটাও ক্ষমতাসীন সরকার নিয়ন্ত্রণ করে সরকারের আস্থাভাজন কিছু সাংবাদিকের পরামর্শে।
সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নানা ধরনের অভিযোগ শোনা যায়। এরশাদ সরকারের পতনের পর অভিযোগ সংবলিত লিফলেট বিতরণ করা হতো। এখন ফেসবুক হয়েছে অভিযোগকারীদের মাধ্যম। এখানে যেসব অভিযোগ করা হয় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে, সেসব অভিযোগ আমলে নিয়ে সরকারিভাবে বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। ড) পেশাজীবী সাংবাদিকদের জন্য পেনশনব্যবস্থা চালু করা ঃ একটি প্রতিষ্ঠানে তিন বছর সাংবাদিকতা করলে তিনি পেনশন পাওয়ার যোগ্য হবেন। পেনশন ফান্ড তৈরি হবে প্রতিষ্ঠান,কর্মরত সাংবাদিক ও সরকারের আর্থিক কন্ট্রিবিউশনে। বর্তমান সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ফান্ড প্রভিডেন্ট ফান্ডে স্থানান্তর করা যেতে পারে। বর্তমানে ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থ দিয়ে আসল ‘অসহায় ও দুস্থ’ চিহ্নিত করে অর্থ সাহায্যের নামে সমাজে হেয় করা হয় আর্থিকভাবে অসচ্ছল সাংবাদিকদের। পেনশন প্রথা এ অপমানজনক অবস্থা থেকে তাদের মুক্তি দিতে পারে। ঢ) মফঃস্বল সাংবাদিকদের জন্য নীতিমালা তৈরী ঃ ঢাকার বাইরে যারা সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত তাদেরকে মফঃস্বল সাংবাদিক বলা হলেও তাদের জন্য কোন নীতিমাল নেই। তাদের কর্মক্ষেত্র সবথেকে বিস্তৃত। একাধারে তারা ক্রাইম রিপোর্টার,অর্থনৈতিক বিট, প্রশাসনিক বিট,কৃষি,শিক্ষা,স্বাস্থ্য,রাজনৈতিক বিট,দাঙ্গা,হাঙ্গামা,পারিবারিক কলহ,দুর্ঘটনা,অগ্নিকান্ড,দুর্নীতিসহ এমন কোন বিট নেই যা তাদের কাভার করতে হয় না। এ ক্ষেত্রে সংবাদ মাধ্যমের ডেস্কে যারা কাজ করেন তারা মফঃস্বলের সংবাদ কর্মীদের কোন ভাবেই সাংবাদিক মনে করেন না। অথচ সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে তারাই হামলা-মালার শিকার হন। শত্রু বেশি তাদেরই। সবথেকে বেশি জীবন দিতে হয়েছে তাদেরকেই। আবার সম্পাদক কিংবা মালিক পক্ষের কাছে তারাই খেলনার পাত্র। এ কারনে তাদের জন্য অবিলম্বে আলাদা চাকুরী বিধিমালা প্রণয়ন জরুরী। ণ) সাংবাদিক ডাটাবেজ তৈরী ঃ দেশের সকল মিডিয়ায় কর্মরত সাংবাদিকদের জন্য একটি ডাটাবেজ তৈরী করা একান্ত প্রয়োজন। যেখানে সকল সাংবাদিকের কর্মক্ষেত্র,ব্যক্তিগত তথ্য সন্নিবেশিত থাকবে। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক জেলা এবং উপজেলায় কর্মরতদের জন্য আলাদা সেল থাকতে পারে। এই সেল জেলা তথ্য অফিস,পিআইডি এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইটে থাকতে পারে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের প্রায় পাঁচ মাস পর সরকারি মালিকানাধীন দৈনিক বাংলার সাপ্তাহিক প্রকাশনা বিচিত্রা প্রকাশের পর এর সঙ্গে যুক্ত মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিকরা সুধীজনদের প্রশ্নের উত্তরে বলতেন, ‘জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন তুলে ধরার জন্যই আমরা সংবাদিকতায় এসেছি।’ ৫৪ বছর পর সাংবাদিকদের আবার নতুন করে বলতে হচ্ছে, জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন তুলে ধরার জন্যই গণমাধ্যম সংস্কার করা দরকার। গণমাধ্যমকে পুরোপুরি নিরপেক্ষ করা সম্ভব না হলেও, সংস্কারের মাধ্যমে যদি গণমুখী ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা যায়, তাহলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে।
লেকক : এম এ কবীর,সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং সভাপতি ঝিনইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি।
Leave a Reply