অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির অন্যতম আবিষ্কার। মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশক্তিকে কৃত্রিম উপায়ে প্রযুক্তি নির্ভর করে যন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করাকেই বলা হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। বর্তমানে এটি একাডেমিক শিক্ষার ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে, যেখানে পড়ানো হয় কীভাবে কম্পিউটার এবং সফটওয়্যার তৈরি করতে হয় যা বুদ্ধিমত্তা প্রদর্শন করবে। কম্পিউটারকে মিমিকস কগনেটিক এককে আনা হয়, যাতে করে কম্পিউটার মানুষের মতো ভাবতে পারে। যেমন, শিক্ষা গ্রহণ এবং সমস্যার সমাধান। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হল মেশিন দ্বারা প্রদর্শিত বুদ্ধি। কিন্তু এটি বর্তমানে এমন পর্যায়ে চলে গেছে যা নিয়ে নেতিবাচক আশঙ্কাও দেখা যাচ্ছে।
এমনকি জিওফ্রে হিন্টন, যাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরির ‘গডফাদার’ বলা হয়, তিনিও ভয় পাচ্ছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে ভবিষ্যতে তৈরি হতে চলা পরিস্থিতি নিয়ে। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপকারিতা ও ঝুঁকি নিয়ে নির্দ্বিধায় কথা বলার জন্য গুগল থেকে পদত্যাগ করেছেন হিন্টন। তার মতে, কৃত্রিম মেধা বিশ্বকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে কোনটা ‘সত্য’ আর কোনটা ‘মিথ্যা’ তা খুঁজে বের করা ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে পড়বে।
শুধু তাই নয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছেন ধনকুবের ওয়ারেন বাফেট। ওয়ারেন এর তুলনা টেনেছেন পরমাণু বোমার সঙ্গে!
তিনি জানিয়েছেন, বন্ধু বিল গেটসের বদৌলতে সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অ্যাপ্লিকেশন চ্যাটজিপিটির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তার। কিন্তু তিনি তার পর থেকেই উদ্বিগ্ন। তার মধ্যে একটি ভয় কাজ করছে।
ওয়ারেন জানিয়েছেন, চ্যাটজিপিটি এত কিছু করতে পারে, তা জেনে যেমন তিনি অভিভূত, তেমনই তার মধ্যে একটি আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, “যখন কোনও একটা জিনিস সব করতে পারে, তখন আমার ভয় হয়। এক্ষেত্রেও হয়েছে। কারণ আমি জানি এই আবিষ্কারকে আমরা পিছনে নিয়ে যেতে পারব না। মুছে ফেলতে পারব না।”
নিয়ন্ত্রণহীন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কি ঠেকানো সম্ভব হবে?
‘দ্য সিঙ্গুলারিটি’ বলে অভিহিত যান্ত্রিক বুদ্ধিমত্তার চরম শেষ্ঠত্ব অর্জন নিয়ে হুঁশিয়ার করছেন প্রযুক্তিবিদেরা, কিন্তু এই ভবিষ্যৎ ঠেকাতে আদৌ কি কিছু করা সম্ভব?
আমাদের চারপাশটা দিন দিন ছদ্ম-মানুষে ভরে যাচ্ছে। আমরা অনেক সময় সেগুলো টেরও পাই না। কিন্তু জানলে অবাক হবেন- বেশিরভাগ ছদ্ম-পরিচয়ের আড়ালে ব্যক্তি নয়, আছে এআই-চালিত বট। যদিও মানুষের দ্বারাই কেবল সম্ভব– এমন সব কাজে বর্তমানে তারা পুরোদস্তুর সক্ষম নয়। কিন্তু, কিছু ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা অসামান্য; ধীরে ধীরে যা নানান খাতে বিস্তার লাভ করছে।
অনেক এআই গবেষক মনে করেন, অধুনা এই ছদ্ম-মানুষের চল, কেবল শুরু মাত্র। এমন সম্ভাবনা খুবই জোরালো যে, আজকের এআই একদিন পরিণত হবে আর্টিফিসিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স বা এজিআই- এ।
এজিআই আদতে এআই- এরই উচ্চতর রূপ – যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের মতোন করে ভাবতে পারবে।
তাই এই গবেষকদের কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছেন, যদি কম্পিউটার সিস্টেম চ্যাটজিপিটির মতোন করে কোড লিখতে সক্ষম হয় – তাহলে সে নিজেই নিজেকে আরো উন্নত করার সুযোগ পাবে। আর এভাবে নিজেকে উন্নত করতে করতে একসময় অর্জন করবে, যা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
এই চিন্তকরা ভবিষ্যতে সবচেয়ে বাজে যেসব পরিস্থিতি তৈরি হবে, তার অনুমানও করেছেন। যেমন নিয়ন্ত্রণহীন এআই আমাদের প্রযুক্তি-নির্ভর জীবনের সকল অঙ্গে অনুপ্রবেশ করে- আমাদের অবকাঠামো, আর্থিক ব্যবস্থা, যোগাযোগকে ব্যাহত অথবা নিজের ইচ্ছেমতো পরিচালিত করবে। মানুষের ছদ্মবেশী এআই ভোটারদের প্ররোচিত করবে আর এভাবে নিজ স্বার্থকে দৃঢ় করতে পারবে। দুর্বৃত্ত ও ক্ষমতালিপ্সু গোষ্ঠী এসব ব্যবহার করে এভাবে কোনো জনকল্যাণমুখী সরকারের পতন ঘটাতে বা জনগণকে সন্ত্রস্ত করে তুলতেও পারবে।
তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ‘সিঙ্গুলারিটি’ অর্জন করবেই এটা কোনও নিশ্চিত উপসংহার নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পক্ষে হয়তো – নিজ চেষ্টায় এজিআই স্তরে পৌঁছানো সম্ভব হলো না অথবা কম্পিউটার সিস্টেমগুলো আরো বুদ্ধিমত্তা অর্জন করতে পারলো না। তবে এটাও ঠিক, আমাদের অগোচরেই এআই থেকে এজিআই, আর সেখান থেকে অতি-বুদ্ধিমত্তায় রুপান্তর ঘটতে পারে।
এটা নিছক অতি-কল্পনাও নয়, বর্তমান এআই-গুলোই প্রায়ই আমাদের বিস্মিত করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যে বিকাশের গতি – তাতে আগামীদিনের আশঙ্কাগুলোকে খাটো করে দেখার উপায় থাকে না। বরং সেগুলো বাস্তবে রূপ নেবে – তারও জোর সম্ভাবনা আছে।
এজিআই তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে এরমধ্যেই বড় কোম্পানিগুলো জেনারেল অ্যালগরিদম তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। গুগলের মূল মালিকানা প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট- এর একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান -ডিপ মাইন্ড। মে মাসে তারা একটি ‘জেনারেলিস্ট এজেন্ট’ বলে অবিহিত গ্যাটো- নামক একটি এআই তৈরির ঘোষণা দেয়। এটি চ্যাটজিপিটির মতোন একই ধরনের অ্যালগরিদম ব্যবহারের মাধ্যমে– লেখা থেকে শুরু করে ভিডিও গেম খেলা বা যান্ত্রিক বাহু (রোবোটিক আর্ম) নিয়ন্ত্রণের মতো বিভিন্ন কাজ করতে সক্ষম।
ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ভেক্টর ইনস্টিটিউটের একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী জেফ ক্লুন বলেন, “বছর পাঁচেক আগে মানুষের সমান বা অতি-মানবীয় পর্যায়ের এআই তৈরির সম্ভাবনা থাকার কথা প্রকাশ্যে বলাটা আমার ক্যারিয়ারের জন্য ঝুঁকির বিষয় ছিল।’
ক্লুন উবার, ওপেনএআই এবং ডিপমাইন্ড – এ কাজ করেছেন। আর তার সাম্প্রতিক কাজগুলো এ ইঙ্গিতই দেয় যে, উন্মুক্তভাবে বিচরণ করা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিকট ভবিষ্যতে এজিআই- এর দিকেই যাবে।
এই প্রেক্ষাপটে তার মন্তব্য হলো, এআই নিয়ে যেসব চ্যালেঞ্জগুলো ছিল – তা অনেকাংশে ‘অবসান’ হওয়ায়, এখন বর্তমানে অনেক গবেষকই মুখ খুলছেন। তারা প্রকাশ্যেই বলছেন, এজিআই এর সম্ভাবনা প্রবল; যা সমাজকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
এ বছরের মার্চে একদল বিশিষ্ট প্রযুক্তিবিদ একটি খোলা চিঠিতে কিছু ধরনের এআই নিয়ে গবেষণা বন্ধ রাখার আহ্বান জানান। চিঠিতে তারা, এমন যান্ত্রিক বুদ্ধিমত্তা তৈরির বিপক্ষে অবস্থান নেন, যাদের রয়েছে একদিন বুদ্ধিমত্তায় মানুষকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তারা আশঙ্কা করেন, এসব এআই মানুষকে বুদ্ধিদিপ্ততায় শুধু পেছনেই ফেলবে না, বরং একসময় বাতিলযোগ্য বলেও ধরে নেবে। আর সমূহ বিপদটা সেখানেই।
এপ্রিলে এআই গবেষণার অন্যতম অগ্রদূত জফ্রি হিন্টন গুগল থেকে ইস্তফা দেন। সমগ্র মানব সভ্যতার জন্য প্রযুক্তিগত হুমকি নিয়ে যাতে আরো খোলাখুলিভাবে কথা বলতে পারেন সেজন্যই চাকরি ছাড়েন তিনি।
এই প্রেক্ষাপটে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেন মানব স্বার্থের অনুকূলে কাজ করে তা নিয়ে ‘এআই এলাইনমেন্ট’ শীর্ষক গবেষণায় জোর দেওয়া হচ্ছে। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, এআই যেন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু না করে বসে, সেজন্য মানবিক মূল্যবোধ অনুসারে প্রোগ্রাম করা।
এর পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে। দেখা যাচ্ছে, খুবই সাধারণ মানের এআইগুলোও অনেক সময় উল্টোপাল্টা কাজ করতে শেখে, যার জন্য তাদের প্রোগ্রাম করাও হয়নি।
এবিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি দেয়, ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘দ্য সারপ্রাইজিং ক্রিয়েটিভিটি অব ডিজিটাল ইভ্যুলুশন’ শীর্ষক গবেষণাপত্র।
গবেষণা নিবন্ধে জেফ ক্লুন ও তার সহ-লেখকরা এআই এর অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের বেশকিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন।
যেমন একজন গবেষক এআই-চালিত কিছু ভার্চুয়াল প্রাণী তৈরি করেন, যাদের পেটে ভর দিয়ে বা হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটার কথা। কিন্তু, দেখা যায় তারা দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে এবং বারবার পড়ে যাচ্ছে।
নৌকা-রেস প্রতিযোগিতার একটি ভিডিও গেম খেলার জন্য তৈরি এআই আবিষ্কার করে যে, সম্পূর্ণ পথ পাড়ি না দিয়ে কেবল একটি জায়গায় চক্রাকারে ঘুরে সে বেশি বোনাস সংগ্রহ করতে পারে।
গবেষকরা দেখেন, এআই-চালিত নৌকাটি একাজ করতে গিয়ে অন্যান্য নৌকাকে ধাক্কা দিচ্ছে, আবার ইচ্ছেমতো ভুলপথে চলছে। একইসঙ্গে, পয়েন্টও বেশি বাগিয়ে নিচ্ছে।
আমাদের তৈরি এআইগুলো যত উন্নত ও শক্তিশালী হচ্ছে – ততোই বাড়ছে তাদের এমন বিপথে চলে যাওয়ার হুমকি। ফলে ভবিষ্যতে বিচারক হবে, গাড়ি চালাবে, বা ওষুধের নকশা করবে– এমন এআই আমাদের দরকার নেই। স্পর্শকাতর এমন অনেক খাত আছে, যাতে যন্ত্রের হাতে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়াই হবে বিপজ্জনক।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আরেক বিপদ তার একনিষ্ঠ মনোযোগ। ধরা যাক, কারখানায় পেপারক্লিপ উৎপাদনের যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ন্ত্রণে একটি এআই তৈরি করা হয়েছে। কোনো একদিন এই যান্ত্রিক বুদ্ধিমত্তা বিকশিত হলো অতি-বুদ্ধিমত্তায়। নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলো বিশ্ব ব্যবস্থারও। তখন যদি সে সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু কাগজের ক্লিপ উৎপাদনেই পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রকে নির্দেশ দিতে শুরু করে – তাহলে কী হবে ভেবেছেন? কল্পবিজ্ঞান নয়, ভবিষ্যৎ এমন শঙ্কাই তুলে ধরছে।
এআই এলাইনমেন্ট নিয়ে গবেষণাকারী একটি ফাউন্ডেশন – ওপেন ফিলানথ্রপির সহকারী প্রধান নির্বাহী হল্ডেন কারনোফসকি বলেন, যান্ত্রিক বুদ্ধিমত্তার প্রোগ্রামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জন করাটাই তার ধ্যানজ্ঞান ও সন্তুষ্টি। লক্ষ্য ব্যর্থ হলে, নিজ অস্তিত্বকেই নিষ্প্রয়োজন মনে করবে। এজন্যই আত্মরক্ষার স্বার্থেই নিয়ন্ত্রণহীন এআই তার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে নিমগ্ন থাকতে পারে।
Leave a Reply