অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : সমালোচনার মুখে ও তদন্তের মাঝপথে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি বই প্রত্যাহার করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এই দুই বইয়ের বাইরে আরও কিছু বইয়ে সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
শুক্রবার(১০ ফেব্রুয়ারি) এনসিটিবি এ সংক্রান্ত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।
সংস্থাটি জানায়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির প্রণীত ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ পাঠদান থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর ফলে এ বছর এ দুইটি বই পড়তে পারবে না শিক্ষার্থীরা। এর বাইরে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির প্রণীত ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের অনুশীলনী পাঠ ও ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ে সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তবে এনসিটিবি যখন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যখন বইয়ের ভুল ও কর্মকর্তাদের দায় খুঁজতে দুটি তদন্ত চলমান আছে।
জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, আপত্তিকর ছবি ও দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে বই প্রত্যাহারের এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই দুই বই নিয়েই বেশি সমালোচনা ও আপত্তি উঠেছিল। যেকারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে দুইটি বই বাতিল করা হয়েছে।
এনসিটিবির এই সিদ্ধান্তে এবছর নতুন এই বই পড়ার আর সুযোগ পাবে না শিক্ষার্থীরা। এই বই পড়া বাদ দিয়েই তাদেরকে নতুন ক্লাসে উঠতে হবে। এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে এনসিটিবি সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, অনুসন্ধানী পাঠ বইটি পড়ার সুযোগ না থাকলেও অনুশীলনী পাঠ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে পারবে। এবার বইগুলো একটিভিটি বেজড। আমাদের পাঠ্যবইয়ে যে কন্টেন্ট আছে তা কিন্তু সব নয়। এর বাইরেও পড়ার সুযোগ শিক্ষার্থীদের আছে। ফলে দুটি বই স্থগিত করলেও শিক্ষার্থীদের পড়ার ক্ষেত্রে কোন বিঘ্ন ঘটবে না বলে দাবি করেন তিনি।
বই প্রত্যাহারের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, অনুসন্ধানী পাঠে আমরা যে তথ্য দিয়েছি তাতে প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিষয়ে সমাজে নানান কথা বার্তা হচ্ছে। সেজন্য এই দুটো বই স্থগিত করলেও আমাদের কারিকুলামের যে লক্ষ্য তা অর্জনে কোন বাঁধা সৃষ্টি হবে না। তিনি দাবি করেন, শিক্ষা মন্ত্রী ড. দীপু মনির সঙ্গে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
আগামী বছর এই বই থাকবে কী না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের বইগুলো সবই পরীক্ষামূলক। আমি আশা করছি আগামী বছর পরিমার্জন হয়ে বইগুলো আবারো কারিকুলামে যুক্ত হবে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি নতুন শিক্ষাক্রমের ভুলত্রুটি নিয়ে ইতমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে এ বিষয়টি বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর বাইরেও ধর্মভিত্তিক দলগুলোর চাপও ছিল।
এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি পাঠ্যপুস্তকের ভুল এবং সংশ্লিষ্টদের কেউ দায়ী থাকলে তা খুঁজে বের করতে দুটি কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে একটি কমিটি সাত সদস্যের আরেকটি পাঁচ সদস্যের।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, সাত সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. ওয়াহেদুজ্জামান চানকে। এ কমিটির কাজ হবে পাঠ্যপুস্তকের ভুল ও বিতর্কিত বিষয় খুঁজে বের করা। ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। অন্য কমিটির আহ্বায়ক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খালেদা আক্তার।
এ কমিটি ভুল-ভ্রান্তির জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কোন কোন কর্মকর্তা জড়িত তাদের খুঁজে বের করবে। দ্বিতীয় কমিটির প্রতিবেদন দিতে হবে ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে।
ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠবইয়ে ১১তম অধ্যায়ের ‘মানব শরীর’ শিরোনাম অংশে কিশোর-কিশোরীর বয়ঃসন্ধিকালে তাদের শরীরের নানা অঙ্গের যেভাবে বর্ণনা দেয়া হয়েছে প্রকাশ্যে তা পড়ার উপযোগী নয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে এই অংশটুকু আর থাকবে না বলেও সূত্র নিশ্চিত করেছে।
ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ৯৫ পৃষ্ঠায় বাংলায় প্রায় ৬০০ বছরের মুসলিম শাসনকে আগেকার মৌর্য ও গুপ্ত সাম্রাজ্য এবং পরের ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে সুলতানি শাসনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক আলোচনা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে একাধিক মহল।
এবার পাঠ্যপুস্তকে ভুলের ছড়াছড়ি, ইন্টারনেট থেকে হুবহু কপি করে পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা, ভুল তথ্য, ইতিহাস বিকৃতি, ইসলামবিরোধী ছবিসহ নানা বিষয়ে আলোচনা সমালোচনার সূত্রপাত হয়। এরমধ্যেই মানুষ বানর থেকে তৈরি, যৌণতা ও নগ্ন ছবি বইয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও গুজব ছড়ানো হয়। সর্বশেষ সমালোচনার মুখো এনসিটিবি দুটি বই প্রত্যাহার ও তিনটি বই সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিলো।
এর আগে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান এ বিষয়ে জানিয়েছিলেন, পাঠ্যপুস্তকের অনেকগুলো বৈশিষ্ট। তবে প্রধান বৈশিষ্ট দুইটি। একটি হলো ভুলত্রুটি মুক্ত এবং অন্যটি ইমপারসিশাল। অর্থাৎ কোন ধর্ম, বর্ণ গোত্রকে আঘাত করবে না। এসব ভুলের জন্য এনসিটিবির ভিন্ন রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু কর্মকর্তা জড়িত বলেও ইঙ্গিত করেছিলেন তিনি। এনসিটিবি চেয়ারম্যান অভিযোগ করেন, কারিকুলাম কমিটির মেম্বাররা বইটি সম্পাদনা শাখার হাতেও দেননি। এখানে বামপন্থী একটি দল অতি সক্রিয় আছে।
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছিলেন, কারও ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত দেয়া নিশ্চয় কাঙ্খিত নয়। এটি আমাদের কাজও নয়। সে যে ধর্মই হোক না কেন। বইয়ের দিকে সমালোচনার আঙ্গুল উঠতে সে বিষয়ে অবশ্যই বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। তবে এবার বইয়ের পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করার আগে যেসব ছবি বাদ দেয়ার কথা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল তা থেকে গিয়েছে বলেও অভিযোগ উঠে। সর্বশেষ সরষের মধ্যেও ভূত খুঁজতে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের তদন্ত চলমান আছে।
Leave a Reply