24 Nov 2024, 07:23 pm

সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় বাড়ছে বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা : মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : শিক্ষাগ্রহণ ও সতর্ক না হওয়া এবং তদন্তের সুপারিশ পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পর পরই একাধিক সংস্থা তদন্ত কমিটি গঠন করে। শুরু হয় নানা রকম আলোচনা৷ আগুনের সূত্রপাত, ক্ষয়ক্ষতির হিসাব ও বেশ কিছু সুপারিশ সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পৌঁছায়। কিন্তু মাস ঘুরে বছর যায়, সেই সুপারিশ আর বাস্তবায়ন হয় না বলে মনে করছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।

‘অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণজনিত দুর্ঘটনা : নাগরিকের মানবাধিকার প্রেক্ষিত’ শীর্ষক কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে এসব তুলে ধরেন মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ।

রোববার(৪ জুন) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এ কর্মশালার আয়োজন করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।

কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতায় একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মামলা হয়নি। আবার দুই-একটি ক্ষেত্রে মামলা হলেও সাজার কোনো নজির নেই! অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ীদের চিহ্নিত করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

অগ্নি নির্বাপণ বিশেষজ্ঞদের মতে, বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন ফাইলবন্দি থেকে যায় বছরের পর বছর। কমিটির সুপারিশগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আলোর মুখ দেখে না। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া এবং সুপারিশমালা বাস্তবায়িত না হওয়ায় নাশকতাকারীরা উৎসাহিত হয়। আমাদের দেশে নাশকতা নতুন কিছু নয়।

কমিশন মনে করে, অগ্নিনির্বাপণে শুধুমাত্র দমকল বিভাগই নয়, পানি-গ্যাস-বিদ্যুৎ পরিষেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান, পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন দপ্তরসমূহের সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে। এসব বিভাগ সমন্বিতভাবে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণ মোকাবিলায় একটি রূপরেখা তৈরি করে সে অনুসারে অগ্নিনির্বাপণ কর্মকাণ্ড সমন্বয় করতে কেন ব্যর্থ হচ্ছে সেটি বিশ্লেষণ প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠান ও দপ্তরসমূহের সমন্বয়হীনতার বলি হচ্ছে কতগুলো তাজা প্রাণ, এ থেকে উত্তরণ আবশ্যক!

অতীতের নানা অগ্নিদুর্যোগ, হতাহত, সমন্বয়হীনতা এবং নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে প্রবন্ধে বলা হয়, চলতি বছরের ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজারের শপিং কমপ্লেক্সে প্রায় ৫ হাজার দোকান পুড়ে গিয়েছে। ১১ এপ্রিল চকবাজারের বিসমিল্লা টাওয়ারের পাশে বহুতল ভবনের চতুর্থ তলায় সিরামিক ওয়ার হাউস ভস্মীভূত হয়েছে। ১৩ এপ্রিল নবাবপুরের মোহাম্মাদিয়া মার্কেটে ২০টি দোকান ও ওয়ার হাউস পুড়ে গিয়েছে। ১৫ এপ্রিল ঢাকা নিউ মার্কেট সংলগ্ন নিউ সুপারমার্কেটে প্রায় ৩০০ দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি ঈদের পূর্বে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ২৪ ঘণ্টায় ২২টি স্থানে আগুন লেগেছে।

আমাদের বসবাসের এলাকাগুলো এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে মৃত্যুঝুঁকিপূর্ণ। সড়ক-ফুটপাত, মসজিদ-উপাসনালয়, আবাসিক ভবন, শিল্প কারখানার, বাণিজ্যিক ভবন বিপণি-বিতান কিংবা খাবারের রেস্টুরেন্ট- কোনো স্থানই আর আমাদের জন্য অগ্নি ও বিস্ফোরণের ঝুঁকি হতে নিরাপদ নয়। সর্বত্র আহাজারি, হাহাকার আর বিপন্ন মানুষের উন্মাদনা অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো এখন আর দৈবদুর্বিপাক হিসেবে থাকছে না। নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতকরণের জন্য সরকার কর্তৃক বিশেষায়িত যে প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানের গাফিলতিতে, অদক্ষতা আর খামখেয়ালিপনায় হারিয়ে যাচ্ছে অনেকগুলো প্রাণ।

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে জনঘনত্ব বেশি, ফলে জনবসতিও বেশি৷ এখানে মানুষের বসবাস তথা জনঘনত্ব বেশি থাকার দরুন বহুতল ভবনের আধিক্য রয়েছে। আর এর সঙ্গে থাকে বিবিধ অর্থনৈতিক-সামাজিক ও বহুবিধ কর্মকাণ্ডের সমাহার ফলে নাগরিকের জীবনযাপনকে নিরাপদ করতেই রাষ্ট্র বিভিন্ন বিশেষায়িত সংস্থা গড়ে তুলেছে, যাদের মূল দায়িত্ব হলো-ভবন, সড়ক ও বিভিন্ন পরিসরে জীবনকে নিরাপদ করার জন্য ইমারত, পরিষেবা ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়মিত পরিদর্শন, রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির সার্বিক দায়িত্ব পালন করা, যা নাগরিক জীবনকে নিরাপদ ও নির্ভার করো বাস্তবিক পক্ষে আমাদের নাগরিক জীবন কতটুকু নির্ভার?

অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের বিভিন্ন নগর এলাকায় নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ভবনের মিশ্র ব্যবহারের কারণে একই ভবনের বিভিন্ন তলায় খাবারের রেস্টুরেন্ট, রাসায়নিক বা বিভিন্ন দাহ্য বস্তুর গুদাম, শিল্প কারখানা ও আবাসিক বসবাস। সব মিলিয়ে যেকোনো মুহূর্তেই যেকোনো ধরনের অগ্নিকাণ্ড জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা আছে ভয়ানক। বিগত বছরগুলোতে জলাশয়-জলাভূমি ভরাট করে এবং ইমারত নির্মাণের আইন ও বিধিবিধান উপেক্ষা করে ভবন নির্মিত হয়েছে। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুসরণ করা হচ্ছে না। কিছু ঘটনায় দেখা গেছে মূল নকশা পরিবর্তন করে বিপণি-বিতান সম্প্রসারণ করা হয়েছে।

অধিকাংশ বিপণি-বিতানে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। ভবনের ভেতরেও ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক ওয়ারিং, যত্রতত্র মালামাল রয়েছে এবং ভবনের চারিদিকে ফুটপাতে বসেছে অসংখ্য দোকান, সেখানে উন্মুক্ত অবস্থায় বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়া হয়েছে। বৈদ্যুতিক তার ঝুলে আছে যেখানে সেখানে। এ কারণে আগুন লাগলে দ্রুততম সময়ে পুরো ভবনে তা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। ঢাকা ট্রেড সেন্টারের উত্তর ও দক্ষিণ অংশের দুটি মালিক সমিতিকেই এসব বিষয় অবগত করে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা বাস্তবায়নে তাদের কোনো উদ্যোগ নেই। মালিকরাও এসব ক্ষেত্রে উদাসীন।

অপরদিকে ভবনে নিরাপদ বসবাস নিশ্চিত করতে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, এসি, ড্রেনেজ, সুয়ারেজ প্রভৃতি পরিষেবার সংযোগ ও নেটওয়ার্ক নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা অত্যাবশ্যক। ভবন মালিক ও বসবাসকারীদের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের এবং সেবা সংস্থাগুলোর নিয়মিত তদারকির অভাবের ফলে ভবনে যেকোনো সময় যেকোনো ধরনের দুর্যোগ-অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। যা নাগরিক জীবনে স্বস্তির বদলে যোগ করেছে শঙ্কা, ভীতি আর উদ্বেগ।

২০১৯ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরির চার বছর পরও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। রাজধানীর ৫৮টি বিপণি-বিতানকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। এসব মার্কেটে অগ্নি নিরাপত্তা আইন মানার ক্ষেত্রে চরম অবহেলা দেখা গেছে।

২০১৮ সালে রাজধানীর ১৫১৭টি মার্কেট ও শপিং মল, রেস্টুরেন্ট ও আবাসিক হোটেলে জরিপ চালানো হয়। এর মধ্যে ১৪৬৩টি ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। ফায়ার সার্ভিস মনে করে, তাদের কাজ সচেতনতা বৃদ্ধি করা, ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করা, এরপর সচেতন করতে তারা ব্যানার টানিয়ে দেয়৷ ভবন মালিক ব্যবস্থা না নিলে তারা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন ও রাজউককে জানায়। যে প্রতিষ্ঠান ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয় তারাই আইন প্রয়োগ করার কথা। আইন অমান্য করা হলেও ফায়ার সার্ভিস কারও উপর জোর করতে পারে না। তাই ফায়ার সার্ভিস আইনেরও সংশোধন করার প্রয়োজন বলে মনে করে মানবাধিকার কমিশন।

সায়েন্সল্যাব এবং গুলশানের বিস্ফোরণজনিত দুর্ঘটনায় ২২ জন প্রাণ হারিয়েছেন, ১৫০ জন আহত হয়েছেন। মগবাজার বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশ উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।
বিস্ফোরণের বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তারা বলেন, পরিত্যক্ত লাইনের বের হওয়া গ্যাস জমে এ বিস্ফোরণ ঘটে। বিশেষজ্ঞের মতে, যদি লিকেজ থেকে বের হওয়া গ্যাস কোন একটি বদ্ধ স্থানে বা পকেটে সঞ্চিত হয় এবং এর ঘনত্ব যদি শতকরা পাঁচ ভাগের ঊর্ধ্বে হয় তাহলে একটি বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। ঢাকা শহরের সাম্প্রতিক বিস্ফোরণগুলো এর মাধ্যমেই হয়েছে।

কমিশন মনে করে, দেশে বিদ্যমান প্রায় ৫৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণ নিয়ে পাঠ্যসূচি থাকা আবশ্যক। ‘ফায়ার সেফটি ম্যানেজমেন্ট’ বা ‘ফায়ার সেফটি ইঞ্জিনিয়ারিং’ শিরোনামে পৃথক কোর্স চালু করা গেলে অগ্নিকাণ্ড, বিস্ফোরণ ও সমজাতীয় ঘটনার কারণ অনুসন্ধান সহজে সম্ভব হবে। অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের মতো দুর্বিপাকে দেশের উচ্চ শিক্ষায়তন ও প্রকৌশল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক অনুশীলনের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করে কমিশন।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 13979
  • Total Visits: 1294677
  • Total Visitors: 4
  • Total Countries: 1668

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ রবিবার, ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
  • ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)
  • ২২শে জমাদিউল-আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরী
  • এখন সময়, সন্ধ্যা ৭:২৩

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
    123
252627282930 
       
15161718192021
293031    
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018