অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : ইহুদিবাদী ইসরাইলের জন্য সবচেয়ে বড় ভয়ানক স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন হল জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে জাহান্নামের দরজাগুলো খুলে যাওয়া।
কড়া নিরাপত্তা জোরদার ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সত্ত্বেও ইসরাইল রক্ষা করতে পারছে না অবৈধ ইহুদি বসতিগুলোতে থাকা সব ইহুদিবাদীকে ও পিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদেরও সনাক্ত করতে পারছে না।
ইসরাইলি সমরবিদ ও সেনা কমান্ডারদের মতে ইসলামী ইরান ও প্রতিরোধ অক্ষের সদস্যরা যুদ্ধের বৃত্ত বা ফ্রন্টগুলোর ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে যাতে নানা ফ্রন্টে ইসরাইলের ওপর প্রলম্বিত যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া যায়। যুদ্ধের তিনটি বলয় ইসরাইলি স্বার্থে আঘাত হানবে প্রতিনিয়ত। এই তিন বলয়ের প্রথমটি হল পশ্চিমতীর ও গাজার বলয়। প্রতিরোধ যোদ্ধারা এসব অঞ্চলে ইহুদিবাদীদের জন্য জীবন অনিরাপদ করে তুলবে। যুদ্ধ-বিরতির আলোচনায় নেতানিয়াহুর নেতিবাচক ও অগঠনমূলক ভূমিকা বুঝতে পেরে হামাস ও ইসলামী জিহাদ আন্দোলন অধিকৃত অঞ্চলে সর্বশক্তি দিয়ে শাহাদাত-পিয়াসী অভিযানগুলো জোরদারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে যাতে নেতানিয়াহু রাজনৈতিক আলোচনায় পিছু হটতে বাধ্য হয়।
পশ্চিম তীরের উত্তরাঞ্চলেও ইসরাইলের সামরিক ও বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলোর ওপর ঝটিকা ও আকস্মিক হামলার প্রক্রিয়া শুরু করেছে প্রতিরোধ অক্ষ। ইসরাইল কি এ অঞ্চলে প্রতিরোধ মোকাবেলায় প্রস্তুত?
ইসরাইলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াসরাইল কাত্জ পশ্চিম তীরে ইসরাইলের সাম্প্রতিক আগ্রাসী অভিযানের অজুহাত হিসেবে সশস্ত্র ফিলিস্তিনিদের দমনের কথা উল্লেখ করেছে। সশস্ত্র এই ফিলিস্তিনি গ্রুপগুলো জর্দানের ভূমির মাধ্যমে ইরানের পক্ষ থেকে মদদপুষ্ট ও সশস্ত্র হচ্ছে বলে ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরাইল কাত্জ্ দাবি করেছে। এই দানবীয় ঘাতক খুব স্পষ্টভাবে বলেছে যে পশ্চিম তীরেও গাজার মতই সব পদক্ষেপ নেয়া তথা পশ্চিম তীর থেকেও বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চালানোর মত সামরিক পদক্ষেপ নেয়া ইসরাইলের জন্য অপরিহার্য। ইসরাইল এরিমধ্যে জর্দান সীমান্তে নজরদারি জোরদার করেছে। আর এ থেকে বোঝা যায় ইসরাইল পশ্চিম তীরের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আনতে চায়।
আগস্ট মাসের শেষের দিকে শাহাদাত-পিয়াসী অভিযান জোরদারের বিষয়ে খালেদ মাশআলের বক্তব্যের অডিও ফাঁস হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর ইসরাইল পশ্চিম তীরের উত্তরাঞ্চলে আগ্রাসন শুরু করে। নুরুশশামস, জেনিন, তুলকারাম, নাবলুস ও তুবাস অঞ্চল এই আগ্রাসনের শিকার। এই আগ্রাসনে অন্তত দশ জন ফিলিস্তিনি শহীদ হয়েছে যাদের মধ্যে পশ্চিমতীর অঞ্চলে ইসলামী জিহাদের অন্যতম প্রধান কমান্ডার মুহাম্মাদ জাবেরও ছিলেন। ফিলিস্তিনি স্বশাসন কর্তৃপক্ষ পশ্চিম-তীরে বাস্তবে নিষ্ক্রিয় থেকেছে কিংবা কখনও ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞের সহযোগী হয়েছে!
তিন ধাপে যুদ্ধ-বিরতি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত যে প্রস্তাব মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন দিয়েছেন তা মেনে নেয়নি ইসরাইল। গাজার সঙ্গে ফিলাডেলফিয়া ও মিশর সীমান্ত অঞ্চলে ইসরাইলি সেনা উপস্থিতি অব্যাহত থাকার অগ্রহণযোগ্য দাবি জানিয়ে নেতানিয়াহু হামাস ও ইসলামী জিহাদকে দক্ষিণ তেলআবিবে শাহাদাত-পিয়াসী হামলা শুরুর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে।
ত্রিশ আগস্ট হামাসের ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামীরা দুটি গাড়ী বোমা ব্যবহার করে বেশ কয়েকজন ইসরাইলি সেনাকে আহত করেছে এবং এ সফল অভিযানের পর নেতানিয়াহুর আগ্রাসী নীতি অব্যাহত থাকলে এ ধরনের অভিযান জোরদার করা হবে বলে হামাস হুঁশিয়ারি দিয়েছে। ওই অভিযানের কয়েক ঘণ্টা পর আরেকটি শাহাদত-পিয়াসী অভিযানে আলখলিল অঞ্চলে তিন ইসরাইলি সেনা নিহত হয়।
কোনো কোনো বিশ্লেষক বলছেন, ইসমাইল হানিয়া ইসরাইলের হামলায় শহীদ হওয়ার পর ইরান, ইসলামী জিহাদ ও হামাস নিরাপত্তাহীনতার বদলে সমগ্র অধিকৃত অঞ্চলে নিরাপত্তাহীনতা ছড়িয়ে দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। এভাবে তেহরান হানিয়া হত্যার অনিবার্য প্রতিশোধ নেয়ার ওয়াদা পূরণের পথে আধা-যুদ্ধ তৈরির কৌশল কার্যকর করছে। অথচ ইসরাইল ভেবেছিল যে সে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে!
তৃতীয় ইন্তিফাদা শুরু: প্রতিরোধের অস্ত্র কেবল ইট বা পাথর নয় : অর্থনৈতিক সূচকগুলোর পতন, ইসরাইল-বিরোধী আন্তর্জাতিক ঐক্যমত্য, জননিরাপত্তার বিলোপ -এসবই ছিল ১৯৮৭-৯৩ সালের ও ২০০০-২০০৫ সাল পর্যন্ত চলা ইন্তিফাদার কিছু প্রভাব বায়তুল মুকাদ্দাস দখলদার ইসরাইলের জন্য। সেসময় ইহুদিবাদীরা প্রলম্বিত সংকট থেকে মুক্ত হতে কিছু ছাড় দেয়ার ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছিল। বর্তমানে গাজায় প্রায় ১১ মাসের যুদ্ধের পর মুসলমানদের প্রথম কিবলা আল-আকসার অবমাননার ঘটনা ঘটিয়েছে বেন গিভর্। এ ছাড়াও অধিকৃত অঞ্চলের উত্তরাঞ্চলে ইসরাইলি সেনা অভিযান ফিলিস্তিনিদের জাগরণকে আগের চেয়েও জোরদার করতে পারে। পূর্ব রণাঙ্গন খুলে যাওয়ায় এবার সেখানকার ফিলিস্তিনিদের অস্ত্র কেবল পাথর বা ইট বা কাঠ নয়, বরং তাদের হাতে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, স্নাইপার, কাঁধ থেকে গ্রেনেড নিক্ষেপযোগ্য গ্রেনেড-প্রপেলার, হ্যান্ড গ্রেনেড। এইসব অস্ত্র নিয়ে তারা ইসরাইলি সেনাদের সঙ্গে সমমানের লড়াইয়ে জড়াচ্ছেন। পশ্চিমতীরের বিশেষ পরিস্থিতির কারণে হামাস ও জিহাদের সদস্যরা এখন সরাসরি ইসরাইলের রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তিত্বদের টার্গেট করতে সক্ষম।
নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ইহুদিবাদী সরকার স্বেচ্ছায় খাদে পড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে সবচেয়ে কার্যকর পন্থায় শহীদদের রক্তের প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ এসেছে।
ইহুদিবাদীদের বড় রকমের দুঃস্বপ্ন : ইহুদিবাদী ইসরাইলের জন্য সবচেয়ে বড় ভয়ানক স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন হল জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে জাহান্নামের দরজাগুলো খুলে যাওয়া। কড়া নিরাপত্তা জোরদার ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সত্ত্বেও ইসরাইল রক্ষা করতে পারছে না অবৈধ ইহুদি বসতিগুলোতে থাকা সব ইহুদিবাদীকে ও প্রতিরোধ যোদ্ধাদেরও সনাক্ত করতে পারছে না। তেলআবিবসহ কয়েকটি স্থানে অভিযান চালিয়ে ফিলিস্তিনিরা এটা বুঝিয়ে দিয়েছে যে প্রতিরোধ থেমে যাবে না। দখলদার হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ধরণ নির্ভর করবে স্থান, সময় ও নানা উপকরণ বা সুবিধার আলোকে।
নেতানিয়াহু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য হয় গাজায় যুদ্ধ অব্যাহত রাখবে অথবা পশ্চিম তীরেও সংকট রপ্তানি করবে। কিন্তু শেষোক্ত পদক্ষেপ ইসরাইলিদের ঘরোয়া নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জের শিকার করবে। অন্য কথায় প্রতিরোধ যোদ্ধারা আত্মগোপনে থেকে ও টার্গেট-ভিত্তিক অভিযানগুলো চালিয়ে ১৯৪৮ সালে দখল-করা অঞ্চলে দখলদারদের জীবন-যাপনকে অসম্ভব করে তুলবে। প্রথম ও দ্বিতীয় ইন্তিফাদার পুনরাবৃত্তি ঘটার ভয় ইসরাইলি বিশ্লেষকদের মনে এই প্রশ্ন জাগিয়েছে যে কেন নেতানিয়াহু গাজার যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই পশ্চিম তীরে সামরিক পদক্ষেপ নিচ্ছে? ফিলিস্তিনিরা আগামী দিনগুলোতে ইসরাইলি সেনাদের ওপর নতুন কোনো হামলা চালায় কিনা তা এখন দেখার বিষয়।
Leave a Reply