26 Nov 2024, 06:23 am

শেখ হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশকে যে দৃষ্টিতে দেখছে ভারত সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : ঢাকায় শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও প্রধানমন্ত্রীর দেশ ছাড়ার ঠিক দিন ১৫ আগের কথা। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট বিতর্কিত কোটা পদ্ধতি বাতিল করার ঠিক পরদিন দিল্লিতে প্রথম সারির জাতীয় দৈনিক ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ এর সম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিল ‘ডিসটার্বিং ইন ঢাকা’।

ওই সম্পাদকীয়তে আরও লেখা হয়েছিল, ‘কোটা বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে যে সহিংসতা দেখা যাচ্ছে, তা আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী রাজনীতিরই উপসর্গ। ভারতের এখন সময় এসেছে হাসিনার পর কী, তা নিয়ে ভাবার!’

বিগত দেড় দশক ধরে ভারতের বাংলাদেশ নীতি আর শেখ হাসিনা যেভাবে প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছিল, তাতে দিল্লির একটি মূল ধারার শীর্ষস্থানীয় দৈনিক ভারতকে ‘বিয়ন্ড হাসিনা’ ভাববার পরামর্শ দিচ্ছে– সেটা তখনও কিন্তু প্রায় অকল্পনীয় ছিল।

ওই সম্পাদকীয় প্রকাশিত হওয়ার ঠিক দুই সপ্তাহের মাথায় ঢাকায় নাটকীয় পটপরিবর্তনের মাধ্যমে ভারতকে কিন্তু এখন ঠিক সেটাই করতে হচ্ছে– বা বলা ভালো, হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে ভারত কী কৌশল নিয়ে এগোবে- দিল্লি সেটা ভাবতে বাধ্য হচ্ছে।

শেখ হাসিনা চিরকাল ঢাকার ক্ষমতায় থাকবেন না, এটা জানা থাকলেও সেই দিন যে এত তাড়াতাড়ি আসবে ভারত মূলত তা ভাবতেই পারেনি।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার ওই সম্পাদকীয় থেকে আরও কিছুটা অংশ উদ্ধৃত করা যাক, ‘আজকের বাংলাদেশ আসলে গণতন্ত্রের মৌলিক চেক-বক্সগুলোতে টিক দিতেই ব্যর্থ হয়েছে– যেগুলো হলো একটি কার্যকরী বিরোধী পক্ষ, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন এবং নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচারবিভাগ। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান জনরোষ ভারতের জন্যও একটি নিরাপত্তাগত দ্বিধা বা সংকট তৈরি করেছে।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে অপসারিত হলে তার জায়গায় একটি পাকিস্তান-সমর্থিত সরকার আসুক, ভারত আর যাই হোক এটা কোনও মতেই চাইবে না। ফলে তাদের এখনই দিশা পাল্টাতে হবে, নিজেদের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ রক্ষা করতেই বাংলাদেশের সমাজের প্রতিটি শ্রেণির কাছেই তাদের রিচ আউট করতে হবে।’

ভারতে ক্ষমতার অলিন্দে শীর্ষ কর্মকর্তারা একান্ত আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন, তখন এ সতর্কবার্তা অনেকটা ‘প্রোফেসি’ বা ভবিষ্যদ্বানীর মতো শোনালেও, ওই সম্পাদকীয়র প্রায় প্রতিটি কথা এখন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে।

ফলে ভারতকে এখন তড়িঘড়ি বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের সেতুগুলো তৈরি করতে হচ্ছে। দিল্লি বোঝার চেষ্টা করছে, সরকারে কাদের প্রভাব বেশি, এবং সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগুলোকে তারা আদৌ চেনেন কি না!

পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ আপাতত অন্ধকার, এটাও বোঝা যাচ্ছে দিব্বি। সে বাস্তবতা থেকেই বিকল্প কোন রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা যেতে পারে এবং সেটা কীভাবে– ভাবতে হচ্ছে তা নিয়েও।

ক্ষমতার পালাবদলের পর দেশে জামায়াত বা হেফাজতে ইসলামের মতো ইসলামী শক্তিগুলোর দাপট ও রমরমাও ভারতের জন্য একটা উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠছে। তাছাড়া গত কয়েক বছরে ভারতের বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে শত শত কোটি টাকা লগ্নি করেছে, এই সংকটের মুহূর্তে সে বিনিয়োগ কীভাবে আর কতটা রক্ষা করা সম্ভব- সেটাও ভারতের আর একটা বড় দুশ্চিন্তা!

এই ধরনের বহু প্রকল্পের কাজ এখন থমকে আছে। এবং সর্বোপরি ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া’র মতো ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা আজ এক মাস হলো ভারতের মাটিতেই অবস্থান করছেন– কর্মকর্তারাই এখন একান্তে স্বীকার করছেন নানা কারণে ভারত তাকে ‘না পারছে গিলতে, না পারছে ওগরাতে!’

সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ঠিক এক মাস আগের নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহ কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক– দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নানা দিকেই ভারতকে এক অপ্রত্যাশিত সংকটে ফেলেছে। দিল্লি এই মুহূর্তে ঠিক কীভাবে সেগুলো সামলানোর চেষ্টা করছে– এই প্রতিবেদনে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে সেটাই!

অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে পরিচয় : বাংলাদেশে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা কতটা, তা নিয়ে সে দেশের ভেতরেও হয়তো প্রশ্ন উঠছে– তবে ভারত কিন্তু ওই সরকারকে স্বীকৃতি দিতে কয়েক মিনিটের বেশি সময় নেয়নি।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূস গত আট অগাস্ট শপথ নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক্স হ্যান্ডলে পোস্ট করে নতুন দায়িত্ব গ্রহণের জন্য তাকে শুভেচ্ছা জানান।

দুই দেশের মানুষের ‘স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে’ একযোগে কাজ করতে ভারত যে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকবে, ওই পোস্টে সে কথাও জানান মোদী। এর কিছুদিন পরে ভারত যে ‘গ্লোবাল সাউথ’ এর শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করেছিল, তাতেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মুহাম্মদ ইউনূসই যোগ দেন এবং সভায় ভার্চুয়ালি ভাষণ দেন। পরে দু’জনের মধ্যে টেলিফোনে কথাবার্তাও হয়েছে।

শুধু এই নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া নয়, শেখ হাসিনা যে বাংলাদেশের জন্য ‘অতীত’– সেটাও গত এক মাসে ভারত বারেবারেই বুঝিয়ে দিয়েছে।

গত ৬ অগাস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর পার্লামেন্টে জানান, ‘আপাতদৃষ্টে’ শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রিত্বে ইস্তফা দিয়েই ভারতে এসেছেন। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রও একাধিকবার শেখ হাসিনাকে ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী’ বলে উল্লেখ করেন।

সুতরাং ঢাকা থেকে শেখ হাসিনার বিদায়পর্ব যতই বিতর্কিত বা রহস্যে ঘেরা হোক– ভারত কিন্তু দেশের নতুন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে নতুন সরকারের সঙ্গেই সম্পর্ক গড়ার কাজে হাত দিয়েছে।

গত সপ্তাহে দিল্লিতে একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানান, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্ক নানা ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে গেছে– কিন্ত ঢাকাতে যখন যে সরকার ক্ষমতায়, দিল্লি তাদের সঙ্গেই সম্পর্ক রেখে চলবে ‘এটাই স্বাভাবিক’!

তিনি বলেন, আমাদের এটাও মেনে নিতে হবে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন হবেই এবং এই ধরনের পরিবর্তন কখনও কখনও ‘ডিসরাপ্টিভ’ হবে। সেরকম ক্ষেত্রে আমাদের স্পষ্টতই দেখতে হবে কোথায় আমাদের পারস্পরিক স্বার্থের মিল হচ্ছে।

ফলে বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গেও ভারতের ‘স্বার্থ’ কোথায় কোথায় মিলতে পারে, দিল্লি এখন সেই ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করার ওপরেই জোর দিচ্ছে। আর তারও আগে চলছে নতুন সরকারকে ভালো করে চেনাজানার পালা।

বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ : গত প্রায় দেড় দশক ধরে বাংলাদেশে ভারতের বিরুদ্ধে একটা প্রধান অভিযোগ ছিল, তারা শুধু শাসক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গেই সম্পর্ক রেখে চলেছে এবং ‘আওয়ামী প্রিজম’ দিয়েই বাংলাদেশের সব কিছুকে দেখার চেষ্টা করেছে।

মজার বিষয় হলো, দিল্লিও কিন্তু এই অভিযোগ কখনও পুরোপুরি অস্বীকার করেনি।

বরং তারা আত্মপক্ষ সমর্থনে বলার চেষ্টা করেছে, যে সব দল চিরকাল ভারত-বিরোধিতার রাজনীতি করে এসেছে কিংবা যাদের ট্র্যাক রেকর্ড বলে তারা ক্ষমতায় থাকাকালীন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে– তাদের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক গড়া সম্ভব?

তা ছাড়া, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী পার্টি বা বিএনপি সম্পর্কে ভারতের আর একটা বক্তব্য ছিল, যতদিন না তারা সুস্পষ্টভাবে জামায়াত ইসলামীর সঙ্গ ত্যাগ করছে ততদিন তাদের সঙ্গেও ভারতের কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে না।

আসলে জামায়াতের রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতাদর্শ ভারতের কাছে এতটাই ‘অস্পৃশ্য’ যে জামায়াতের কোনও রাজনৈতিক সঙ্গী বা শরিককেও বিশ্বাস করা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়– মোটামুটি এ যুক্তিটাই দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক সার্কিটে ও অ্যাকাডেমিয়াতে এতদিন ধরে দেওয়া হত। তবে ঢাকায় গত এক মাসের ঘটনাক্রম ভারতের জন্য বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ গড়ে তোলার পথ প্রশস্ত করেছে বলেও অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করছেন।

বিশেষ করে, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে যেভাবে সম্প্রতি নানা ইস্যুতে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে, সেটাকেও ভারতের নীতিনির্ধারকরা ইতিবাচক লক্ষণ হিসেবে দেখছেন। ‘জামায়াত-মুক্ত’ বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গড়ার কাজ অনেক সহজ হতে পারে বলেও তাদের অভিমত।

আর একটা বিষয় হলো, বিএনপি নেতৃত্বের সঙ্গে সবপর্যায়ে ভারতের সব ধরনের যোগাযোগ এতদিন ধরে সম্পূর্ণ স্তব্ধ ছিল, এটাও ঠিক নয়- বলে ভারতের অনেক বিশ্লেষকই জানাচ্ছেন।

সব সময় প্রকাশ্যে না-হলেও যোগাযোগের কিছু চ্যানেল চালু ছিল বলে তাদের দাবি।

সম্ভবত এরকমই একজন হলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জিয়া পরিবারের আস্থাভাজন নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ– দীর্ঘ প্রায় এক দশক ভারতে কাটিয়ে যিনি সদ্যই বাংলাদেশে ফিরে গেছেন। শেখ হাসিনার পতনের দু-চারদিন পরেই, সালাউদ্দিন বাংলাদেশে ফেরার ঠিক আগে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে তার দীর্ঘক্ষণ কথাবার্তা হয়।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, ভারতে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশ’ এর সব মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পরও তিনি যে বছরের পর বছর দেশে ফিরতে পারেননি, সেজন্য তিনি সেদিন একবারও কিন্তু দিল্লিকে দোষারোপ করেননি– বরং যাবতীয় দায় চাপিয়েছিলেন শেখ হাসিনা সরকারের ওপরেই।

পাশাপাশি ভারতে তার সুদীর্ঘ ‘প্রবাসজীবনে’ ভারত সরকার যেভাবে সহযোগিতা করেছে, শিলংয়ে তার গেস্টহাউসে স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের এসে নিয়মিত দেখা করার সুযোগ করে দিয়েছে, কিংবা দিল্লিতে গিয়ে চিকিৎসা করানোরও অনুমতি দিয়েছে– তাতে তিনি যে ভারতের প্রতি এক ধরনের কৃতজ্ঞ, কথাবার্তায় সেটাও গোপন করেননি।

ভারতের পর্যবেক্ষকরা কেউ কেউ মনে করছেন, এহেন সালাউদ্দিন আহমেদ আগামী দিনে ভারতের সঙ্গে বিএনপির সেতু রচনার ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। তবে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হলে দীর্ঘদিনের বন্ধু আওয়ামী লীগের সম্পর্কে ভারতের মনোভাব কী হবে?

দিল্লির একজন প্রথম সারির কর্মকর্তা বলেন, এটা তো আর কোনও ‘বাইনারি’ নয়, যে একটা থাকলে অন্যটা থাকতে পারবে না! ভারত অবশ্যই চাইবে সে দেশের পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যাতে অংশ নেয় এবং সেখানে একটা সুষ্ঠু প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ থাকে। সূত্র: বিবিসি

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 12941
  • Total Visits: 1314154
  • Total Visitors: 4
  • Total Countries: 1668

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ মঙ্গলবার, ২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
  • ১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)
  • ২৩শে জমাদিউল-আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরী
  • এখন সময়, সকাল ৬:২৩

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
    123
252627282930 
       
15161718192021
293031    
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018