অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : সাম্প্রতিক মাসগুলোতে, ইসরাইল সরকার ইহুদিবাদীদের ইসরাইল ছাড়ার প্রবণতাসহ বেশ কয়েকটি সংকটের মুখোমুখি হয়েছে।
ইসনা-এর উদ্ধৃতি দিয়ে পার্সটুডে জানিয়েছে, ইরানের “আল্লামা তাবাতাবাই” বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক প্যানেলের সদস্য “হোসেন মির্জাই” তার এক নিবন্ধে অধিকৃত অঞ্চল থেকে দলে দলে ইহুদিদের চলে যাওয়ার ওপর বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেছেন। এখানে সে বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।
আল্লামা তাবাতাবাই ইউনিভার্সিটির একাডেমিক প্যানেলের সদস্য “হোসেন মির্জাই” এ প্রসঙ্গে লিখেছেন: সাম্প্রতিক দিনগুলোতে পশ্চিম এশিয়ায় দ্রুত গতিতে যেসব পরিবর্তন ঘটেছে তাতে এ অঞ্চলের দখলিকৃত ভূখণ্ডের ব্যাপারে সবার নজর কাড়তে শুরু করেছে। নজর কাড়ার এ প্রক্রিয়া গত বছর থেকে শুরু হয়েছে এবং এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে ইসরাইল থেকে দলে দলে ইহুদিদের এই ভূখণ্ড ত্যাগের ঘটনা অবৈধ এ রাষ্ট্রের জন্য গুরুতর মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে কতজন ইসরাইল ছেড়ে চলে গেছে যা যাচ্ছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কখনই প্রকাশ করা হয় না। এ অবস্থার জন্য ইসরাইলি সেনাদের নির্মম হত্যকাণ্ড নাকি তাদের নিরাপত্তাহীনতা দায়ী সেটাই এখন প্রশ্ন।
এমন কোনো সপ্তাহ নেই যে, ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠী ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন আইন ও নির্দেশনা পাশ করে না। বর্ণবাদী অন্য সব শাসকের মতো দখলদার ইসরাইলও ফিলিস্তিনি এবং ইসরাইলিদের জন্য আলাদা নিয়ম প্রণয়ন করে কিন্তু পরবর্তীতে, গাজায় নৃশংস গণহত্যা এবং এই গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীর অব্যাহত প্রতিবাদ আন্দোলনের কারণে এই নিয়মগুলো এখন খোদ ইসরাইলি ইহুদিদের জন্যও সমস্যা তৈরি করবে ও তাদেরকে কোণঠাসা করবে।
কেননা বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসরাইল যদি গণহত্যা ও যুদ্ধ বন্ধ না করে তাহলে ইসরাইলিদেরকে বিশ্বাসঘাতক ও অপরাধী হিসাবে গণ করা হতে পারে। মিডিয়া কর্মীরা, চলচ্চিত্র পরিচালক, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনকারীরা ইসরাইল বিরোধী তৎপরতায় ভূমিকা রাখছেন। এ কারণে গত গ্রীষ্ম থেকে এখন পর্যন্ত, নেতানিয়াহু সরকারকে দুর্বল করার চেষ্টা চলছে এমন অজুহাত দেখিয়ে ইসরাইলের বেশ কয়েকটি সিনেমা হল আপাতত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
গত ১৬ অক্টোবর, ইসরাইলের সংসদে একটি আইন পাশ করা হয় যাতে বলা হয়, একজন সন্ত্রাসী বা অপরাধীকে বহিষ্কার করা হলেও তার আত্মীয়স্বজন, পিতামাতা, সন্তান, ভাই বা বোনেরা নিরাপদ থাকবে। লক্ষণীয় যে এই পদক্ষেপটি শুধুমাত্র ইসরাইলি নাগরিকদের লক্ষ্য করে গ্রহণ করা হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে এ আইন প্রযোজ্য নয়।
এই আইনের উদ্দেশ্য হল “বিশ্বাসঘাতক ইহুদীদের” চিহ্নিত করা। গত প্রায় দুই মাস আগে ইসরাইলে আরেকটি আইন প্রণয়ন করা হয়। ওই আইন অনুযায়ী যদি কোনো শিক্ষক কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের প্রতি “সহানুভূতি” দেখায় তাহলে তাকে তার কর্মস্থল থেকে বরখাস্ত করা যেতে পারে। আমরা খুব ভালো করেই জানি যে ইসরাইলে ফিলিস্তিনিদের জন্য যে কোনো সমর্থনকে “সন্ত্রাসী” হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইসরাইলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইতিহাসের শিক্ষকদেরকে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদের বিষয়ে কথা বলা উচিত হবে না বরং শিক্ষকদের বলা হয়েছে তারা যেন ছাত্রদেরকে এটা শেখায় যে ইসরাইল কোনো আরবকে বহিষ্কার করেনি এবং ফিলিস্তিনিরা সকলেই নিজেদের ইচ্ছায় এই ভূমি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এ ছাড়াও ইসরাইলে আরেকটি আইন পাশ করার প্রক্রিয়া চলছে। ওই আইন পাশ হলে কেউ যদি ফিলিস্তিনি পতাকা বা তাদের কোনো প্রতীক কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রদর্শন করে তাহলে তাকে ভারী জরিমানা করা হবে এবং এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া হবে। বিশেষ করে এই আইনের লক্ষ্য কেবল শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও, হারেৎজ পত্রিকার উপর চাপ সৃষ্টি করাও আরেকটি উদ্দেশ্য। কেননা এই পত্রিকা ইসরাইলি সমাজে নেতানিয়াহুর নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে ভূমিকা রাখছে।
গত অক্টোবরে, সমস্ত সরকারী বিভাগ এবং ইসরাইল সরকার সমর্থিত সমস্ত সংস্থাকে হারেৎজ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া এবং এর শেয়ার নেওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এই পদক্ষেপের পেছনে তাদের যুক্তি ছিল যে, এই পত্রিকাটির অনেক নিবন্ধ, রিপোর্ট ও বিশ্লেষণ নেতানিয়াহু সরকারের বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে।
এমনকি হারেৎজ পত্রিকার মালিক আমোস শকেনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়ারও অভিযোগ আনা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, এই সিদ্ধান্তের কয়েকদিন আগে, ইহুদিদের অংশগ্রহণে লন্ডনে এক বক্তৃতার সময় পত্রিকাটির মালিক “ফিলিস্তিনিদের উপর চাপিয়ে দেওয়া বর্ণবাদী শাসনের” কঠোর সমালোচনা করেছিলেন এবং ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের স্বাধীনতা সংগ্রামী বলে অভিহিত করেছিলেন যাদেরকে ইসরাইল সরকার সন্ত্রাসী বলে মনে করে। অবশ্য এর কিছু পরেই তিনি তার কথা প্রত্যাহার করে নেন।
একই সময়ে, ইসরাইলের বিচার মন্ত্রী “ইয়ারিভ লেভিন” পার্লামেন্টে আরেকটি আইন পাশের অনুমোদন চেয়েছেন। ওই আইন পাশ হলে কোনো ইসরাইলি নাগরিক যদি সরকার কিংবা রাজনীতিবিদের বয়কট করার আহ্বান জানায় বা জনমনে ঘৃণা ছড়ায় তাহলে তাকে কোনো ছাড় না দিয়ে সাধারণ পরিস্থিতিতে ১০ বছরের এবং যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ২০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
যদিও বর্তমানে, বহু ইসরাইলি নাগরিক অধিকৃত অঞ্চল ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে, তবে কেবল নিরাপত্তার অভাব কিংবা অধিকৃত অঞ্চলে ব্যাপক যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে নয় বরং গণতন্ত্র না থাকা এবং স্বাধীনতা না থাকার অনুভূতির কারণে। বিশেষ করে এক ধরনের “সরকারি বর্ণবাদ” সৃষ্টিই দলে দলে ইহুদিদের ইসরাইল ছাড়ার অন্যতম কারণ। অবশ্য এটাও সত্য যে, নতুন নতুন ইহুদি উপশহরগুলোতে বসতি স্থাপনকারীদের নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। এদের নিম্ন শ্রেণীর ইহুদি হিসাবে গণ্য করা হয় এবং তাদের ইসরাইল ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ কিংবা সম্ভাবনা খুবই কম।
দীর্ঘ সময় ধরে, ইসরাইল পশ্চিম এশিয়ার একমাত্র গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে নিজেকে দেখানোর চেষ্টা চালিয়ে এসেছে এবং দৃঢ়ভাবে এটিকে সর্বত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। কিন্তু খোদ ইসরাইলি সমাজে এই মিথ্যাচারের বিষয়টি আজ সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে এবং রাষ্ট্রীয় বর্ণবাদ দিন দিন ছড়িয়ে পড়ছে। অনেক ইহুদিদের জন্য, এমন একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্রে থাকা আতঙ্ক ও যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠেছে। অথচ তারা অনেক আশা এবং আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ইসরাইলে পাড়ি জমিয়েছিল। একদিকে অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রীয় বর্ণবাদ অন্যদিকে সম্প্রতি পশ্চিম এশিয়া জুড়ে চরম নিরাপত্তাহীনতা ও যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইহুদিরা তাদের ভবিষ্যৎ জীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখতে পাচ্ছে। এসব কারণে ইহুদিদের ইসরাইল ছাড়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। এটি ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য এমন এক হুমকি যা ইসরাইলি সমাজকে ভেতর থেকে ধসিয়ে দিতে পারে।
Leave a Reply