অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বোর্ড অব গভর্নরসে ইউরোপের ত্রয়ী (ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রিটেন) এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইরানবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এক যৌথ ফ্রন্ট গঠিত হয়েছে।
চীন, রাশিয়া ও ইরানসহ আটটি দেশ আইএইএ’র বোর্ড সভায় এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে। এতে ইরানের পরমাণু স্থাপনার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের হামলা এবং একটি নতুন ইরান-বিরোধী প্রস্তাব পাস করার চেষ্টার তীব্র নিন্দা জানানো হয়। এছাড়া, সদস্য দেশগুলোকে ইরানের শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি বিষয়ে রাজনৈতিক কারসাজির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এবং এই খসড়া প্রস্তাবটি সমর্থন না করার আহ্বান জানানো হয়।
ইরানও “স্ন্যাপব্যাক” প্রক্রিয়ার বৈধতা প্রত্যাখ্যান করে জোর দিয়ে বলেছে, পশ্চিমা রাজনৈতিক চাপ ও প্রস্তাবগুলো কারিগরি বিষয়গুলোর সমাধান করতে তো সাহায্য করেই না, বরং সংস্থার সাথে সহযোগিতার প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তোলে।
বেলারুশ, চীন, কিউবা, ইরান, নিকারাগুয়া, রাশিয়া, ভেনেজুয়েলা ও জিম্বাবুয়ে— এই আট দেশ তাদের বিবৃতিতে ইরানের দীর্ঘদিনের পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধে অঙ্গীকার এবং এনপিটির অধীনে শান্তিপূর্ণ পরমাণু শক্তি ব্যবহারের অবিচ্ছেদ্য অধিকারের ওপর জোর দেয়। তারা জাতিসংঘের ২২৩১ নম্বর প্রস্তাবের সব ধারার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ইরানি পরমাণু স্থাপনায় বেআইনি হামলার তীব্র নিন্দা জানায় এবং বর্তমান পরিস্থিতিকে এসব হামলা ও ইউরোপীয় ত্রয়ীর অসহযোগিতার সরাসরি ফল বলে উল্লেখ করে।
ইউরোপীয় ত্রয়ী ও যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাব তুলে ধরেছিল, যেখানে আইএইএকে ইরানের ঘোষিত পরমাণু উপাদানের মজুত সংক্রান্ত আরও বিস্তারিত তথ্যের তাৎক্ষণিক প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি জোর দিয়ে বলা হয়। এ প্রস্তাবে পশ্চিমা দেশগুলো দাবি করে যে, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কিছু সিদ্ধান্ত “পুনর্বহাল” হওয়ায় ইরানকে সব রকমের সমৃদ্ধকরণ ও পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ কার্যক্রম— এমনকি গবেষণা, উন্নয়ন এবং ভারী পানির প্রকল্পগুলো— স্থগিত করতে হবে। ইরানকে প্রটোকল অ্যাডিশনাল (অতিরিক্ত প্রটোকল) অনুসরণ করে সম্পূর্ণ তথ্য আইএইএকে দেওয়ারও দাবি করা হয়।
পশ্চিমা–ইসরায়েলি চাপের মুখে এই প্রস্তাবটি ২০ নভেম্বর আইএইএ বোর্ডে গৃহীত হয়। ৩৫ সদস্যের মধ্যে ১৯ দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়, রাশিয়া, চীন ও নাইজার এর বিরোধিতা করে; ১২ দেশ ভোটদানে বিরত থাকে এবং একটি দেশ ভোটে অংশ নেয়নি।
ভিয়েনায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগেই সতর্ক করে বলেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ত্রয়ীর এই পদক্ষেপ “বড় ভুল” এবং বোর্ডকে রাজনৈতিকীকরণের “ইচ্ছাকৃত চেষ্টা”। তারা জানিয়েছিলেন, এ ধরনের মুখোমুখি অবস্থান পশ্চিমাদের কোনো উপকার করবে না। ইরান স্পষ্ট করে বলেছে— এমন একটি প্রস্তাব গৃহীত হলে তা আইএইএ ও ইরানের চলমান ইতিবাচক সহযোগিতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
যৌথ ফ্রন্ট গঠনের কারণ
১. পশ্চিমাদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের প্রতিক্রিয়া: জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্যসহ অনেক দেশ মনে করে, পশ্চিমা দেশগুলো একটি প্রযুক্তিগত বিষয়কে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করছে। তাদের মতে, আইএইএকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে।
২. ইরানের ন্যায্য অধিকারের প্রতি সমর্থন: ইরান বহুবার বলেছে তার পরমাণু কর্মসূচি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। বহু দেশ এই অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে ইরানের পাশে দাঁড়িয়েছে।
৩. বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার সুরক্ষা: অনেক দেশ মনে করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের এই প্রস্তাব একতরফা চাপ প্রয়োগের আরেকটি প্রচেষ্টা। তাই তারা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে দুর্বল হওয়া থেকে রক্ষা করতে যৌথ অবস্থান নিয়েছে।
৪. আঞ্চলিক পরিস্থিতির প্রভাব: পশ্চিম এশিয়ায় (মধ্যপ্রাচ্য) ইসরায়েলের আগ্রাসী নীতির কারণে অঞ্চলটি অস্থিতিশীল। এ পরিস্থিতিতে অনেক দেশ চায় না যে ইরানকে অন্যায়ভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হোক, যা অঞ্চলকে আরও অস্থিতিশীল করতে পারে।
যৌথ ফ্রন্টের ফলাফল
পরিশেষে বলা যায়, ইউরোপীয় ত্রয়ী ও যুক্তরাষ্ট্রের ইরানবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে যে যৌথ ফ্রন্ট গঠিত হয়েছে, তা পশ্চিমাদের রাজনৈতিকীকরণের প্রচেষ্টার প্রতি শক্ত প্রতিক্রিয়া। এটি শুধু ইরানের কূটনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করেনি, বরং ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পশ্চিমাবিরোধী দেশগুলোর ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে— এমন ইঙ্গিতও দিয়েছে।