24 Nov 2024, 09:33 pm

কতিপয় ব্যবসায়ী রক্তচোষা বাদুরের ভুমিকায় ; বিশ্ববাজারে কমলেও দেশে বাড়ছে গমের দাম

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : বাংলাদেশের কতিপয় ব্যবসায়ী রক্তচোষা বাদুরের ভুমিকার কারণে বিশ্ব বাজারে গমের দাম কমলেও দেশে আটা, ময়দা ও সুজির দাম বেড়েই চলেছে। বিগত এক বছরে দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। বর্তমান খুচরা বাজার থেকে প্রতিকেজি প্যাকেট আটা ৭৫ টাকা এবং খোলা আটা কিনতে ভোক্তাকে ব্যয় করতে হচ্ছে ৬৫ টাকা, যা গত এক বছর আগে প্রতিকেজি প্যাকেট আটা ৩৮-৪০ এবং খোলা আটা ৩০-৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা আমদানি কমে যাওয়ার সুযোগ নিয়ে গমের দাম বাড়াচ্ছেন। ডলার স্বল্পতায় গম আমদানিতে ব্যাংকগুলোর অর্থায়নে অনীহার কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এতে লাগামহীনভাবে বাড়ছে আটার দাম। পাশাপাশি আটা-ময়দা বিক্রি করা বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানও প্যাকটজাত করে অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়িয়ে চলেছে।
এদিকে দিন দিন বাড়ছে আটা-ময়দার চাহিদা। দাম শীঘ্রই কমবে, এ সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে বরং মূল্য আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এতে আটা-ময়দার বাজারে অস্থিরতা বাড়ছে। তবে আটা-ময়দার উৎপাদন, সরবরাহ বাড়ানো এবং দাম কমানোর পদক্ষেপ হিসেবে রাশিয়া-ইউক্রেনের বাইরে বিকল্প বাজারের খোঁজ করছে সরকার। এ লক্ষ্যে ব্যবসায়ীদেরও নতুন বাজারের অনুসন্ধানের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

একই সঙ্গে সরকারি মজুত বাড়াতে জি টু জিভিত্তিতে গম আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরবরাহ বৃদ্ধি ও আটা-ময়দার উৎপাদন বাড়াতে গম আমদানি করা হবে আটটি দেশ থেকে। নতুন করে বুলগেরিয়ার সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে।
দেশে বর্তমানে গমের চাহিদা রয়েছে ৭৫ লাখ টন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মোতাবেক দেশে উৎপাদন হয় বছরে ১১ লাখ ৬৭৩ টন। দেশের চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর গম আমদানি করতে হচ্ছে প্রায় ৬৫ লাখ টন।
দেশে দিন দিন গমের চাহিদা বাড়ছে। ভাত ছাড়া সারাদিন আমরা যা যা খাই, তাতে গমের তৈরি খাবারই বেশি। সকালের নাশতায় রুটি-পরোটা, দুপুর-বিকেলে চায়ের সঙ্গে বিস্কুট, বাসা বা রেস্তোরাঁয় নানা  বৈচিত্র্যময় খাবারে মিশে আছে গম। আর উচ্চবিত্ত হলে ভাতের বদলে থাকতে পারে একবেলা রুটি। দুই দশক আগেও গমের রুটি ছিল গরিবের খাবার। রেশনের পণ্য হিসেবে পরিচিত গম এখন সব শ্রেণির মানুষের খাদ্যাভ্যাসে জড়িয়ে গেছে।
সরকারি রেশন, ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি, কাজের বিনিময়ে খাদ্য নানা কর্মসূচিতে ছিল শুধু গম আর গম। গ্রামে গ্রামে ছোট ছোট মেশিনে গম ভেঙে আটা তৈরি হতো। সকালের নাশতায় লাল আটার রুটি দিয়ে লাল চা ছিল গরিবের খাদ্যতালিকায়। চাহিদা বেশি ছিল না বলে আমদানিও হতো কম। দেশীয় উৎপাদন আর অনুদানের গম দুইয়ে মিলে মিটে যেত চাহিদা। আমদানি বলতে ছিল সরকারি খাতে।
খাদ্য বিভাগের তথ্যমতে, ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে খাদ্যসহায়তা হিসেবে ১৫ লাখ ৩০ হাজার টন গম পেয়েছিল বাংলাদেশ। সরকারি আমদানি ছিল ৩০ হাজার টন। আর দেশে উৎপাদন ছিল ১০ লাখ টন। এই ২৫ লাখ ৬০ হাজার টনে ১১ কোটি ১৫ লাখ মানুষের চাহিদা মিটেছে। জনপ্রতি দৈনিক গমের সরবরাহ ছিল ৬৩ গ্রাম। সে সময় সিংহভাগই সরকারি খাদ্য বিতরণ পদ্ধতিতে সরবরাহ করা হতো।
দুই দশক আগ পর্যন্ত গমের সরবরাহের বড় অংশই ছিল মূলত খাদ্যসহায়তার ওপর নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় কমিশন, কানাডা এবং বিশ্বখাদ্য কর্মসূচি ছিল প্রধান দাতা। আর ১৯৯১-৯২ অর্থবছর পর্যন্ত আমদানিতে একচেটিয়া আধিপত্য ছিল সরকারের। ১৯৯৩ সালে সরকার বেসরকারি খাতকে গম আমদানির সুযোগ দেয়।

প্রথম বছরেই আমদানি সাড়ে তিন লাখ টন ছাড়ায়। প্রায় এক দশকের মাথায় প্রথম অনুদানের গম ছাড়িয়ে আমদানি বাড়ে। এরপর এক মিলিয়ন, দুই মিলিয়ন করে এখন সাত মিলিয়ন বা ৭০ লাখ টন ছাড়িয়েছে গম আমদানি। অর্থাৎ ধীরে ধীরে বেসরকারি খাতের হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে।
স্বাধীনতার আগে দেশে গম উৎপাদিত হতো এক লাখ টনের মতো। স্বাধীনতার পর এক দশকে বেড়ে দশ লাখ টন হয়। ১৯৯৮-৯৯ সালে দেশে গম উৎপাদনে রেকর্ড হয়, সে বছর উৎপাদিত হয়েছিল ১৯ লাখ ৮৮ হাজার টন। এখন উৎপাদন কমছে, আমদানি বাড়ছে। বর্তমানে মোট উৎপাদন ১১ লাখ ৬৭৩ টন। দেশের উৎপাদন দিয়ে বড় জোড় ৯ শতাংশ চাহিদা মিটছে। বেসরকারি খাতে চলে যাওয়ার পর দুই দশকের ব্যবধানে আমদানি বেড়েছে ছয় গুণেরও বেশি। আমদানি আর সামান্য উৎপাদন মিলে এখন দেশে গমের চাহিদা বছরে ৮৫-৮৬ লাখ টন।

বিশ্বে গম উৎপাদনে শীর্ষ পাঁচ দেশ- চীন, ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। বাংলাদেশ এ তালিকায় ৫১তম অবস্থানে। গম রপ্তানিতে শীর্ষে আছে রাশিয়া-ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও কানাডার মতো দেশ। বাংলাদেশের চাহিদার সিংহভাগ গম আসত রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে।
গত অর্থবছরে মোট আমদানি করা গমের মধ্যে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে শতকরা ৪৫ ভাগ, কানাডা থেকে ২৩ ভাগ এবং ভারত থেকে ১৭ ভাগ গম আমদানি করা হয়েছে। বাকি ১৫ ভাগ গম আমদানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা ও অস্ট্রেলিয়াসহ আটটি দেশ থেকে। ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আমদানি চিত্র পাল্টে যায়।

১ মার্চ থেকে ১২ মে পর্যন্ত গম আমদানির যে হিসাব তাতে ভারত শীর্ষে আছে? এই সময়ে ছয় লাখ ৮৭ হাজার টন গম আমদানি করা হয়? যার মধ্যে ভারত থেকে শতকরা ৬৩ ভাগ, কানাডা থেকে ১৪ ভাগ আর অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা হয় ২৩ ভাগ?
বেসরকারি খাত ছাড়াও সরকার তার বিভিন্ন কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্পের জন্যও গম আমদানি করে? গত অর্থবছরে সরকার সরাসরি গম আমদানি করেছে প্রায় চার লাখ ৫০ হাজার টন? চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত আমদানি করেছে চার লাখ ৭৮ হাজার টন? বর্তমানে সরকারের কাছে মজুত আছে এক দশমিক এক-আট লাখ টন ?
গত মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জমা দেওয়া একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, মে থেকে অক্টোবরে গম আমদানির পরিমাণ ৪৯ শতাংশ কমে ১৭ লাখ ২০ হাজার টন হয়েছে। প্রতিবেদনে রয়টার্সের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ২৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম এর আগের বছরের তুলনায় পাঁচ দশমিক চার শতাংশ কমে প্রতিটনে ৩৭১ দশমিক ৪৮ ডলার হয়েছে। কিন্তু দেশে আটার দাম কমছে না, বরং বাড়ছে।
গত এক মাসেই গমের দাম ছয় দশমিক ১৩ শতাংশ কমেছে। ২৩ অক্টোবর এক টন গমের দাম ৩৯৫ ডলার ছিল। এই সময়ের মধ্যে ঢাকায় আটার দাম প্রতি কেজিতে ৯ শতাংশ বেড়ে ৬০ থেকে ৬৩ টাকা হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই মূল্যবৃদ্ধি বৈশ্বিক ধারার বিপরীতে যাচ্ছে।
নিত্যপণ্য আমদানিকারক ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আটার দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ডলারের ঊর্ধ্বমুখী দরকে দায়ী করেছেন। তবে কর্মকর্তা ও ভোক্তা অধিকার সংস্থাগুলো জানিয়েছে, শুধুমাত্র ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে স্থানীয় বাজারে আটার দাম বৃদ্ধি হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের কারসাজিও রয়েছে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 14167
  • Total Visits: 1296060
  • Total Visitors: 4
  • Total Countries: 1668

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ রবিবার, ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
  • ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)
  • ২২শে জমাদিউল-আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরী
  • এখন সময়, রাত ৯:৩৩

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
    123
252627282930 
       
15161718192021
293031    
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018