22 Nov 2024, 06:18 pm

বান্দরবানে প্রকল্পের চেয়ে ৩৫ কোটি টাকা কম খরচে সড়ক তৈরি করলো সেনাবাহিনী

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য জেলা বান্দরবান। এ জেলার অপরুপ সৌন্দর্যে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ব্যাপক আকৃষ্ট। সম্প্রীতির এই জেলার আলীকদম-পোয়ামুহুরীর যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই নাজুক। কিন্তু শিক্ষা সুবিধা ও স্থাপনা অপর্যাপ্ততার কারণে উপজেলার জালানিপাড়া-কুরুকপাতা ও পোয়ামুহুরী সড়কটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সড়কটি না হওয়ার আগে ওই সব এলাকায় যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌ-পথ। যেতেও সময় লাগতো ১ থেকে ২ দিন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যাতায়াতের অপ্রতুলতার কারণে সেখানকার মানুষ মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চি ছিল। কিন্তু সেই দৃশ্য এখন পাল্টে যেতে শুরু করেছে। আলীকদম-জালানিপাড়া-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী সড়ক নির্মাণ হওয়ার ফলে দুর্গমতার সেই চিত্র বদলে গেছে। এই সড়কটি নির্মাণের ফলে সম্ভাবনা জেগেছে এখানকার পর্যটনের। পর্যটনকে কেন্দ্র করে প্রসারিত হবে এসব অঞ্চলের অর্থনীতিও।
জানা গেছে, ২০১৭ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারি আলীকদম-জালানিপাড়া-কুরুকপাতা ও পোয়ামুহুরী সড়কের উন্নয়ন প্রকল্পটি একনেকে পাস হয়। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটির কাজ দ্রুত সম্পাদনের জন্য বাস্তবায়নের দায়িত্ব সেনাবাহিনী ওপর অর্পিত হয়।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্সের ৩৪ ইসিবি অধীনে ১৬ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই এবং প্রকল্পের প্রায় ৩৫ কোটি টাকা কম খরচে ৪৭৪ কোটি ৪০ লাখ টাকার ব্যয়ে কাজের গুনগত মান বজায় রেখে সম্পন্ন করা হয়।

প্রকল্পটিতে রয়েছে ৩৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার কার্পেটিং রাস্তা, ১০টি ব্রিজ, ১১টি কালভার্ট ও ৪টি ভিউ পয়েন্ট। রাস্তার আনুষাঙ্গিককরণ হিসেবে ক্রস ড্রেন, সাইট ড্রেন, রিটেইনিং ওয়াল, আর্থ ওয়াটার ড্যামসহ রোড সাইড নির্মাণ করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৪নং কুরুকপাতা ইউনিয়নে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার পরিবারের বসবাস। জালানিপাড়া-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী এই সড়কের দুর্গম এলাকার পাহাড়ি জনপদে বসবাস করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ম্রো সম্প্রদায়। ক্ষুদ্রতম জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে ত্রিপুরা, চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা।

এসব এলাকায় সবাই এক সময় ছিল জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম ছিল নৌ-পথ। সড়ক হওয়ার আগে আলীকদম উপজেলার মাথাপিছু আয় জাতীয় আয় থেকে শতকরা ৩০ ভাগ কম ছিল। শিক্ষা সুবিধা ও স্থাপনার অপর্যাপ্ততার কারণে আলীকদমের দক্ষিণে বসবাসরত উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর স্বাক্ষরতার হার ছিল খুবই কম।

ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডাক্তারের অপ্রতুলতার কারণে এ জনপদের মানুষ আগে ব্যাপক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ছিল। কুরুকপাতা ইউনিয়নের সঙ্গে উপজেলা সদরের যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিল খুব নাজুক। পাশাপাশি দুর্গম অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং নিরাপত্তা অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনায় এ সড়কটি নির্মাণ করা ছিল খুবই জরুরি।

শুধু তাই নয়, দুর্গমতার কারণে ওই এলাকার উৎপাদিত ফসল এক সময় নষ্ট হয়ে হতো। কৃষক বঞ্চিত হতো পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে। কিন্ত এখন খুব কম সময়েই সেইসব কৃষিপণ্য সহজে বহন করে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে বাজারে। কৃষক পাচ্ছে নায্য দামও। সড়কটি নির্মাণের ফলে মুরুং, ত্রিপুরাসহ সেই সব দুর্গম এলাকায় বসবাসরত পাহাড়ি জনগোষ্ঠির জীবনে লেগেছে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জোয়ার।
কুরুকপাতা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মেনরত ম্রো বলেন, আগে পাহাড়ের জিনিসপত্র নিয়ে হেঁটে যেতে সময় লাগতো ১ থেকে ২ দিন। এখন সড়কটি হওয়ার পর আলীকদম যেতে সময় লাগে মাত্র ১ থেকে ২ ঘণ্টা। সড়কটি হওয়ার ফলে আমাদের জীবনযাপন এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে।

কুরুকপাতা গ্রামের বাসিন্দা জন ত্রিপুরা বলেন, সড়কটি না হওয়ার আগে আমরা পণ্যের নায্যমূল্য পেতাম না। কম টাকায় জিনিসপত্র বিক্রি করতে হতো। মাঝে মাঝে ফলমূল পচে নষ্ট হয়ে যেত। সব কিছু থেকে আমরা বঞ্ছিত ছিলাম। এখন সড়কটি হওয়ার পর আমাদের অনেক উপকার হয়েছে।

আলীকদম রিপোর্টাস ক্লাবের সভাপতি শুভ রঞ্জন বড়ুয়া বলেন, ওইসব দুর্গম এলাকায় আগে যোগাযোগ বিছিন্ন ছিল। কোনো অঘটন ঘটলে সহজে খবর পেতাম না। আসা যাওয়া ছিল ব্যয়বহুল। সড়কটি হওয়ার ফলে এখন সহজভাবে দ্রুত সময়ে পৌঁছে যেতে পারছি। এছাড়াও দুর্গম এলাকায় বসবাসরত বাসিন্দাদের জীবনযাপনও অনেকটাই পাল্টে যাবে বলে আমি মনে করি।

এ বিষয়ে ১৬ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নের (১৬ ইসিবি) মেজর ও প্রকল্প কর্মকর্তা মো. ইশরাকুল হক বলেন, নবনির্মিত আলীকদম-জালানিপাড়া-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী সড়কটি ৩১৭ কিলোমিটারের সীমান্ত সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে। সড়কটি নির্মাণের ফলে মুরুং, ত্রিপুরাসহ বৃহত্তর করুকপাতা ইউনিয়নে বসবাসরত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনে আর্থ-সামজিক উন্নয়ন ঘটবে। এছাড়াও কৃষিজাত পণ্যের বিপণন এবং কৃষি নির্ভর শিল্পোন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণে সহায়ক হবে। দেশের ভূখণ্ড রক্ষা ও সীমান্তে নিরাপত্তা বৃদ্ধিতেও এটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। সড়কটি এ অঞ্চলের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উন্নতির পাশাপাশি সুখী, সমৃদ্ধ, সুষম উন্নয়নের বাংলাদেশ গড়ার পথে এক বড় অর্জন।

এ বিষয়ে আলীকদম উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাবের মো. সোয়াইব বলেন, আলীকদমের সঙ্গে পোয়ামুহুরীর দূরত্ব ৪১ কিলোমিটার। সড়কটা হওয়ায় শহরের সঙ্গে পুরো কানেক্টিভিটি হয়ে গেছে। আলীকদম-জালানিপাড়া- কুরুকপাতা ও পোয়ামুহুরী সড়কটির কারণে পিছিয়ে পড়া পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের যাতায়াতে অনেক সুবিধা হয়েছে। এখন কৃষকরা তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস আলীকদমে এনে বিক্রি করতে পারছেন। যেখানে আলীকদম থেকে কুরুকপাতা ও পোয়ামুহুরী যেতে দুই দিন লাগতো সেখানে এখন তারা এক ঘণ্টার মধ্যে পোয়ামুহুরী চলে যেতে পারছে বলে জানান তিনি।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 9434
  • Total Visits: 1270260
  • Total Visitors: 4
  • Total Countries: 1668

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ শুক্রবার, ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
  • ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)
  • ২০শে জমাদিউল-আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরী
  • এখন সময়, সন্ধ্যা ৬:১৮

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
    123
252627282930 
       
15161718192021
293031    
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018