এডমন্ড বার্ক বলেছেন ‘পার্লামেন্টের তিনটি রাষ্ট্র রয়েছে। কিন্তু ঐ যে দূরে সাংবাদিকদের আসন সারি সেটি হচ্ছে পার্লামেন্টের চতুর্থ রাষ্ট্র এবং আগের তিনটি রাষ্ট্রের চেয়ে তা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ’। এডমন্ড বার্কের সে উক্তি থেকে সংবাদপত্রের গুরুত্ব অনুধাবন করলে সহজেই বোঝা যায় যে, পার্লমেন্ট ও সংবাদপত্র হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ স্মম্ভ। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা দু’টি ভিন্ন বিষয় হলেও পরস্পর পরস্পরের পরিপুরক। সংবাদপত্র ছাড়া সাংবাদিকতা যেমন ভাবা যায় না- তেমনই সাংবাদিকতাকে বাদ দিয়ে সংবাদপত্রেরও অস্থিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেননা সাংবাদিকতা হচ্ছে ব্যক্তি এবং সংবাদপত্র হচ্ছে প্রতিষ্ঠান।
সংবাদপত্রের জন্য কোন ব্যক্তি যখন সংবাদ সংগ্রহকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে তখন তাঁকে বলে সাংবাদিক। আর তাঁর পেশাকে বলা হয় সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতা হচ্ছে সেবামূলক একটি পেশা। পেশাটি খুবই সহজ বা আরামের বলে অনেকের কাছে প্রতীয়মাণ হলেও আদতে সাংবাদিকতা ব্যতিক্রমধর্মী পেশা- যা কষ্টসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় অন্য সব পেশার চাইতে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। দুনিয়ার তাবৎ সমাজ ও অস্থিতিশীল রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনে অনেক প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়- দায়িত্ব পালনও করতে হয় বিচক্ষণতার সাথে। আধাত্মিক জ্ঞান, প্রতিভা বা মেধা না থাকলে প্রকৃত সাংবাদিক যেমন হওয়া যায় না- তেমনই সমাজ বা রাষ্ট্রও তাদের দ্বারা উপকৃত হতে পারেনা।
উন্নয়নশীল দুনিয়ায় ক্ষুধা-দারিদ্রতার কারণে সমাজ ও রাজনীতি অস্থিতিশীল থাকায় দুর্নীতি শক্ত শেকড়ে বিশাল বটবৃক্ষের ন্যায় ক্রমশ: বিস্তৃত হওয়ায়- সৎ, বস্তুনিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার বিপরীতে পেশীশক্তিধারী অপসাংবাদিকদের দাপট-দৌরাত্ম্য এখন উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে; যা বাংলাদেশে এখন অপ্রতিরোধ্য।
চরম সত্যকথা, অর্থলোভী সাংবাদিক নামধারীরা অপসাংবাদিকতাসহ গুপ্তচরের ভূমিকায় অবর্তীর্ণ হওয়ার কারণেই মধ্যপ্রাচ্যসহ দুনিয়ার দেশে দেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা বৃদ্ধিসহ রক্তের হোলিখেলা চলছে- তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধলে এই অপসাংবাদিকদের কারণেই বাঁধতে পারে।
ফাস্টওয়ার্ল্ডে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে যতটা মর্যাদা দেয়া হয় থার্ডওয়ার্ল্ডে তা কল্পনাই করা যায় না। ফলে উন্নয়নশীল দুনিয়ায় অনেক কিছুই আর্থিক মানদন্ডে তুলনা করা হয়- বিধায় সাংবাদিকতা পেশায় সৎভাবে অর্থ উপার্জনের স্বল্পতার কারণে অনেকের কাছে পেশাটি এক্কেবারে নগন্য।
বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির এযুগে শিক্ষা, সংস্কৃতির তথা জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের পাশাপাশি সাংবাদিকতা পেশার মান বৃদ্ধি পেলেও মর্যাদাশীল বলতে যা বোঝায় তার স্বীকৃতি পাওয়া এখনো সম্ভব হচ্ছেনা। একজন সাংবাদিককে অনেকগুলো গুণের অধিকারী হতে হয়, তন্মধ্যে নিরহংকার, নির্লোভ ও অহিংসার মনোভাবসহ চরম ধৈর্য্য ও পরমত সহিষ্ণুতা তাঁর মধ্যে থাকতে হবে। কঠিন সাধনা ও অধ্যবসায়সহ সুকুমারগুণের অধিকারী না হলে- এ পেশায় বেশীদিন টিকে থাকাও সম্ভব নয়! পেশাগত দায়িত্ব পালনে ত্যাগ ও অবদানের তুলনায় বাংলাদেশে প্রাপ্তিটা এক্কেবারে নগন্য হওয়ায় সামাজিকভাবে মর্যাদাশীল ভাবা না হলেও আত্মতৃপ্তিটা বড়কথা হওয়ায় অনেকে এ পেশাকে বেছে নিয়েছেন এবং এখানো নিতে চাচ্ছেন।
সৎভাবে সাহসী ভূমিকা নিয়ে বিবেকের দায়বোধে বা কর্তব্যের কঠোর শৃঙ্খলে আবদ্ধ থেকে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিতরা দেশ ও জাতির কল্যাণে ভূমিকা রাখতে পারলে জাঁতি তাঁর মাধ্যমে লাভবান হতে পারে। সংবাদপত্র জাতির দর্পণ- যদি প্রতিষ্ঠানটি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সাথে পেশার স্বকীয়তা ও পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখতে পারে। যিনি বা যাঁরা কর্তব্য পালনে নির্ভীক কেবল মাত্র তিনি বা তাঁরাই পারেন বা পারবেন সমাজের অনাচার পাপাচার আর দুর্নীতি-দুর্বৃত্তপনার তথ্যচিত্র সার্চ করে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর সংবাদ পরিবেশনে ভূমিকা রাখতে। শুধু তাই নয় সমালোচনার বিপরীতে গঠমূলক আলোচনার মাধ্যমে দেশ ও সমাজকে প্রগতির পথে এগিয়ে নেয়ার ভূমিকাও ‘জাতির বিবেক’ হিসেবে সাংবাদিকরা রাখতে পারেন।
দুনিয়ার বহু দেশে সাংবাদিকতা পেশাটি এখন প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা লাভ করলেও বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে সংবাদপত্রের ব্যাপক প্রসার ঘটার পরও রাজনৈতিক দুর্নীতির কারণে বস্তুনিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার বিপরীতে অপসাংবাদিকতার দাপট দৌরাত্ম্য অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েছে! বিশেষ করে চামচামি, দালালী ও অনৈতিকভাবে অর্থলোভের কারণে এ পেশাটি এখনো প্রথম শ্রেণীর মার্যাদা লাভ করতে পারছে না। তবে হ্যাঁ! বস্তুনিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতাসহ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা যেসব সংবাদপত্রের রয়েছে তারা ইতোমধ্যে প্রথম শ্রেণীর মার্যাদা লাভে সক্ষম হয়েছে।
আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডিলাসো রুজভেল্ট সংবাদপত্র প্রসঙ্গে স্বীয় অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন- ‘যদি কখনো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কার্যকরভাবে খর্ব করা সম্ভব হয়, তবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শিক্ষার স্বাধীনতা, বক্তব্য রাখার স্বাধীনতা ইত্যাদি মৌলিক অধিকারও হয়ে পড়বে অর্থহীন’! নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মতই জনগণ ও সরকারের মধ্যে সংবাদপত্রের যোগসূত্র। রাজনীতিবিদ সাধারণত: তাঁর নির্বাচনী এলাকার জনসাধারণের মুখপাত্র হিসেবে ভূমিকা রাখেন। কিন্তু সংবাদপত্রের ভূমিকা তাৎপর্যময় ও ব্যাপক। রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন এবং এতদসংক্রান্ত অনেক খবরাখবরপ্রচার করে সংবাদপত্র। একে যদি গণতন্ত্রের মূল অবয়ব বলা যায় তাহলে তার প্রাণ বলা যেতে পারে সাংবাদিককেই।
উপযুক্ত পরিবেশ ও নিরাপত্তা যে কোন সৃজনশীল কাজের জন্য সার্বাগ্রে প্রয়োজন। নিরাপত্তাহীন বা প্রতিকূল পরিবেশে সৃজনশীল কোন কাজ করাও সম্ভব নয়। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে সংবাদপত্র লাভজনক শিল্প হিসেবে এখন গণ্য হচ্ছে। সংবাদপত্র যদি শিল্প হয় তা’হলে সৎ ও দায়িত্বশীল সংবাদকর্মীরা অবশ্যই তার শিল্পী। সৃজনশীলতা প্রকাশের পূর্বশর্ত হচ্ছে অনুকূল পরিবেশ- যা বাংলাদেশে তেমন একটা নেই। আবার অর্থ ও পেশীশক্তির জোরে অনেক সময় সৃজনশীলতা পদদলিতও হয়। দুনিয়া সৃজনকর্তার সৃজনশীলতা ধ্বংস করার সাধ্য ক্ষমতা যেমন কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়- একমাত্র ¯্রষ্টাই তা ধ্বংসের ক্ষমতা রাখেন। ঠিক তেমনই কিছু সৃজনশীল মানুষও দুনিয়াতে জন্মাচ্ছেন- যাঁদের হত্যা করলেও তাঁর সৃজনশীল কর্ম আর্থিক দৈন্যতার কারণে সাময়িকভাবে পদদলিত করা সম্ভব হলেও নির্মূল করা সম্ভব নয়। ‘আর্থিক দৈন্যতার কারণে কবি নজরুলকে তখনকার কতিপয় অপসাংবাদিক কারাগারে পাঠালে তিনি আরো তেজোদ্বীপ্ত হয়ে উঠেছিলেন বলেই তিনি বিদ্রোহী কবির খেতাব পেয়েছিলেন। বাউল স¤্রাট খেতাব পাওয়া শাহ্ আবদুল করিম তাঁর গানের পান্ডুলিপির বানান শুদ্ধ-সম্পাদনার জন্য সাংবাদিক নামধারী অনেকের কাছে আকুতি জানিয়ে হিংসার বলি হতেও আমরা দেখেছি। কিন্তু হিংসার বলি হয়ে সৃজনশীলতা সাময়িকভাবে পদদলিত করা সম্ভব হলেও নির্মূল করা যে অসম্ভ-তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ অ্যাকাডেমিক শিক্ষার সার্টিফিকেধারী না হয়েও জনপ্রিয় গান আর সূর মৃত্যুর পূর্বেই শাহ্ আবদুল করিমকে বাউল স¤্রাট খেতাবসহ রাষ্ট্রীয় খেতাবও পাইয়ে দিয়েছে। এজন্য অনেক বড় মনের মানুষ জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মরহুম হুমায়ূন আহমদ এর অবদান অনস্বীকার্য’।
সৃজনশীল মেধা দেশ ও সমাজকে সমৃদ্ধ করার ভূমিকা রেখে ইতিহাসের জন্ম দেয়। কিন্তু যারা এর অধিকারীদের হিংসা বা ঈর্ষা করে ইতিহাসকে রাজহাঁস বা পাতিহাঁস ভেবে নিজের মত করে নিতে চায়- তারা যত সম্পদশালী বা অর্থবলে দালাল চামচা পরিবেষ্ঠিত হোন না কেন একদিন না একদিন ইতিহাসে তিনি বা তারা আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন। হিংসা প্রসঙ্গে মনোবিজ্ঞানী লর্ড আর্থার বলেছেন, ‘যারা নীতিতে বিশ্বাসী নয় বিশ্বাসী একমাত্র স্বার্থে; তাদের উন্নতি হয় বটে- কিন্তু পতনও আসে অপ্রতিরোধ্য গতিতে’! বহুল প্রচারিত পত্রিকার মালিক-সংবাদকর্মীদের অহংকারী মনোভাবসহ দাপট দৌরাত্ম্যের কথা ভূক্তভোগীদের কাছে বলার অপেক্ষা রাখেনা- তবে সবাই যে এমন তা-ও কিন্তু নয়! ভাল মানুষ আর বড় মনের সাংবাদিকরা না থাকলে দেশ ও সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে।
বর্তমান জটিল সমাজ ব্যবস্থায় একজন সাংবাদিক তাঁর চিন্তার স্বাধীনতাটুকুও অনেক সময় প্রয়োগ করতে পারেন না। কারণ এ ক্ষেত্রে তাঁর সামনে চারটি প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়- আর তা হচ্ছে ১. মালিক ২. সরকার ৩. প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ এবং ৪. অপরাধীচক্র। এর যে কোন একজনের বিরাগভাজন হলেই সমস্যা বা বিপদ। কেননা ঐ ৪টি বাধার সৃষ্টিকারীদেরই অনেক সময় দেখা যায় পরস্পর পরস্পরের বন্ধু-সুহৃদ! যার জন্য তৃণমূল পর্যায়েও সাংবাদিকরা গড়ে তুলতে বাধ্য হচ্ছেন সামাজিক সংগঠন বা প্রেসক্লাব। দুনিয়ার দেশে দেশে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে সাংবাদিকদের সামাজিক সংগঠন সমূহ গড়ে উঠছে ক্ষুদ্র থেকে বৃহদাকারে- কিন্তু দুর্ভাগ্য রাজনৈতিক দুর্নীতির কারণে ‘জাতির বিবেক’ বলে খ্যাত সাংবাদিকদের সামাজিক সংগঠনগুলোও উন্নয়নশীল দেশে বহুধা বিভক্ত। ফলে এক কাকের দুর্গতি দেখে হাজারো কাক কা কা করে সহানুভূতি জানালেও এক সাংবাদিকের দুর্গতিতে আরেকজন দেয় বাহবা অথবা নানান যুক্তি- এমনকি অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকলে ডেমকেয়ার মনোভাবও দেখায় অনেকে।
লেখক : এম এ কবীর, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি।
Leave a Reply