01 May 2024, 08:37 pm

ক্ষমতালোভী পাকিস্তানে চলছে গৃহযুদ্ধ !

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : পাকিস্তানে এখন যেন সমস্যার অন্ত নেই। রাজনীতি ভেঙে পড়েছে, কারণ রাজনীতিকেরা তাদের ক্ষমতা হারাতে রাজি নন। অর্থনীতি এখন খাদের কিনারে। এক মাসের রিজার্ভ নিয়ে টিকে আছে। শত চেষ্টা করেও আইএমএফের ঋণ মিলছে না। ঋণখেলাপি হওয়ার আশঙ্কাও বাড়ছে। যদিও দেউলিয়াত্ব ঠেকাতে শেষ ভরসা চীন বলেও আভাস দিয়েছে সরকার। অর্থনীতি আর রাজনৈতিক সংকটের মাঝে সুযোগ বুঝেই সন্ত্রাস মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। কিছু বিশ্লেষক এই পরিস্থিতিকে মূলত একটি রাজনৈতিক সংকট হিসেবে দেখছেন, যা এমনিতেই সমাধান হয়ে যাবে।

অনেকে আবার কম আশাবাদী। তারা মনে করছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক মন্দা ও নিরাপত্তার হুমকি পাকিস্তানকে বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তারা এটাকে বলছেন ‘পলিক্রাইসিস’ (বহু দুর্যোগ বা সংকটের মাঝে ডুবে থাকা)। তারপর আছে বাস্তববাদীরা, যারা এজন্য উদ্বিগ্ন যে পাকিস্তানের বর্তমান লড়াই গৃহযুদ্ধে রূপ নিতে পারে। সাবেক মার্কিন কূটনীতিক জালমে খলিলজাদ তো সতর্ক করে বলেছেন, পাকিস্তানের পরিস্থিতি আঞ্চলিক অস্থিরতা বাড়াতে পারে। এমনকি সন্ত্রাসবাদ বাড়ানোর পাশাপাশি এই অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে এবং যুদ্ধের দিকেও নিয়ে যেতে পারে।

কীভাবে গৃহযুদ্ধের দিকে পাকিস্তান : পাকিস্তানের প্রভাবশালী পত্রিকা ডন সম্প্রতি তার এক সম্পাদকীয়তে লিখেছে, ‘জাতি বিপজ্জনকভাবে গৃহযুদ্ধের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এটি তার নিজস্ব দ্বন্দ্বের ভারে নিজেকে ছিন্নভিন্ন করছে।’ সম্প্রতি দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তো বলেই দিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে পাকিস্তান ভেঙে যেতে পারে। পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ডনে এক নিবন্ধ লিখেছেন দেশটির সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও ডিপ্লোম্যাটিক ফুটপ্রিন্টসের লেখক আইজাজ আহমেদ চৌধুরী। তিনি লিখেছেন, পাকিস্তান ঠিক কোন দিকে যাচ্ছে এবং সুড়ঙ্গের শেষে আলো আছে কি? দেশটি ক্রমবর্ধমান গৃহযুদ্ধের কবলে পড়েছে এবং এর সর্বজনীন স্থানগুলো নিয়মিত প্রতিবাদ, সংঘর্ষ ও দাঙ্গার স্থান হয়ে উঠেছে।

সামাজিক অস্থিরতা এখন নাগরিক অব্যবস্থাপনা, অবাধ্যতা ও ধর্মঘটের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। তার আশঙ্কা, যদি এটি অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলতে থাকে, তবে দেশটি একটি বিপর্যয়কর গৃহযুদ্ধের দিকে চলে যেতে পারে। তিনি লিখেছেন—সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তান, সুদান বা রুয়ান্ডায় যা হয়েছে, তা এখানে ঘটতে পারে না এমনটা ভাবা বোকামি হবে। যদিও প্রতিটি ক্ষেত্র ভিন্ন। কিন্তু প্রধান যোগসূত্র হচ্ছে, অসহিষ্ণুতার একটি তীব্র সংস্কৃতি, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে এবং অবশেষে রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে ভেঙে দেয়। এই দেশগুলোর অন্য একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো টেকসই রাজনৈতিক অস্থিরতা, যেখানে শাসক বা বিরোধী দল সমঝোতায় আসতে রাজি নয়। ‘বাঁচো এবং বাঁচতে দাও’—এই চেতনা তাদের মধ্যে নেই। ফলে বাইরের শক্তি দ্বারা নেতিবাচক চেতনার বীজ ধীরে গাছ তথা বিশৃঙ্খলার বড় বৃক্ষে রূপ নেয়।

সুদানের কথাই ধরুন। ৪ কোটি ৬০ লাখ মানুষ কয়েক দশক ধরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে ভুগছে। সম্প্রতি দেশটি নিয়মিত সেনাবাহিনীর সামরিক নেতৃত্ব এবং একটি আধাসামরিক বাহিনীর মধ্যে একটি ভ্রাতৃঘাতী ক্ষমতার লড়াই প্রত্যক্ষ করেছে। পরিস্থিতি বিশৃঙ্খলার দিকে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লুকিয়ে থাকা বিদেশি হাত গৃহযুদ্ধকে বাড়িয়ে তোলে। ফলে চূড়ান্তভাবে হেরে গেছে সুদানের মানুষ।

সিরিয়ার বেসামরিক অস্থিরতা শুরু হয়েছিল ২০১১ সালের মার্চে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকার নির্মমভাবে বিক্ষোভকারীদের দমন করেছিল। এটা দ্রুত গৃহযুদ্ধ এবং একটি সশস্ত্র সংঘাতের দিকে চলে যায়, যেখানে ছিল দেশি ও বিদেশি স্বার্থ আর হস্তক্ষেপের জটিল মিশ্রণ। ফলাফল হয়েছে লাখ লাখ সিরীয়র মৃত্যু ও বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনা। ১২ বছর ধরে লড়াইয়ের পর প্রেসিডেন্ট আসাদ সিরিয়ার অনেক অংশের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছেন। কিন্তু একসময়ের সুন্দর দেশটি ধ্বংস হয়ে গেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গল্পটি হলো রুয়ান্ডার গৃহযুদ্ধের। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হুতু ও সংখ্যালঘু তুতসিরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছিল, পরে যা গণহত্যায় গিয়ে শেষ হয়েছিল। ১৯৯৪ সালের ঐ গণহত্যায় ১০০ দিনের মধ্যে প্রায় ৮ লাখ লোকের প্রাণ গিয়েছিল। ২০০৩ সাল পর্যন্ত চলা গণহত্যায় প্রায় ৫০ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছে।

সাবেক পররাষ্ট্রসচিবের মতে, ‘পাকিস্তানিদের ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের দেশ যত বারই রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে, তার পরিণতি জনগণই বহন করেছে।’ তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালে তত্কালীন রাজনৈতিক নেতারা গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফলাফলকে সম্মান করতে ব্যর্থ হন, যখন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান একটি বেপরোয়া সামরিক অভিযানের দিকে যান। এটা ছিল পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় অংশের জন্য নিন্দনীয় এবং ফল হয়েছিল রক্তাক্ত বিচ্ছিন্নতা। আইজাজ চৌধুরী বলছেন, পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব কি নিজেদের ইতিহাসের সেই বেদনাদায়ক অধ্যায় থেকে শিক্ষা নিতে পারবে? সেই শিক্ষা নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের নেতৃস্থানীয়রা কি টেবিলে বসে তাদের সমস্যা সমাধানের যথেষ্ট সাহস ও ইচ্ছাশক্তি জোগাড় করতে পারেন? যদি তারা না করেন, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে যেভাবে এটি পূর্বে ঘটেছিল। এতে সবাই হারবেন, কেউ জিতবেন না।

সমাধান কী? : আইজাজ চৌধুরী লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন সরকার চায় পার্লামেন্ট তার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করুক। অন্যদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দ্রুত নির্বাচন চান। নির্বাচনের তারিখ নিয়ে সমঝোতা এত কঠিন হওয়া উচিত নয়। কারণ মে ও অক্টোবর মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধান। তার মতে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি নতুন সামাজিক সংহতি এবং আচরণের নিয়মের বিষয়েও একমত হওয়া উচিত। যেমন :সামরিক সংস্থা তার অরাজনৈতিক অভিপ্রায়ের কথা ঘোষণা করেছে এবং এটিকে রাজনীতিতে টেনে আনা উচিত নয়; সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে সবার সম্মান করা উচিত; নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করা যাবে না এবং প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে হেয় করার জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকে দায়মুক্তির সঙ্গে ব্যবহার করা উচিত নয়। অর্থাৎ, জবাবদিহি থাকতে হবে। নির্বাচনের জন্য সমঝোতার মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে একটি তারিখের বিষয়ে একমত হতে হবে। বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য সমঝোতায় আসার মধ্যে কোনো লজ্জা নেই। একটি সমঝোতা প্রতিটি দলকে খুশি না-ও করতে পারে, তবে এতে অবশ্যই পাকিস্তানের জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে, যারা এই শাসনব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখছে এবং আস্থা হারাচ্ছে। তালেবানের সঙ্গে সমঝোতায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নেতৃত্বদানকারী জালমে খলিলজাদ বলেছেন, পাকিস্তানে সামরিক ও বিচার বিভাগের ভেতরে রাজনীতিকীকরণ চরমে উঠেছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে পাকিস্তান নামের দেশটি ও তার জনগণের জন্য হবে একটি ট্র্যাজেডি। এর অর্থনীতি ধসে পড়বে, দারিদ্র্য আরো বাড়বে। সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে জীবনকে করে তুলবে অতিষ্ঠ। ফলে সামরিক বাহিনী, বিচার বিভাগ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে একটা সমাধানে আসতে হবে।

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 2967
  • Total Visits: 683888
  • Total Visitors: 2
  • Total Countries: 1124

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ বুধবার, ১লা মে, ২০২৪ ইং
  • ১৮ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল)
  • ২২শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরী
  • এখন সময়, রাত ৮:৩৭

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031  
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018