এম এ কবীর, ঝিনাইদহ : ঝিনাইদহ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মকর্তার পদ শূণ্য রয়েছে বিগত ৬ বছর। এরই মধ্যে ত্রাণ বিতরনে অনিয়মের অভিযোগ ওঠেছে ওই দপ্তরের বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে। ত্রাণের মালামাল নয়-ছয় করে খালি করে ফেলা হয়েছে গুদাম।
গত ১৪ আগস্ট গুদামের দরজা বন্ধ করে শেখ হাসিনা লেখা চটের বস্তা (মিনি প্যাকেট) গোপনে পাল্টিয়ে শত শত সাদা রঙের প্লাস্টিকের বস্তায় ভর্তি করে পরবর্তীতে সরিয়ে ফেলা হয়। এতে জড়িত দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের কয়েকজন ওই দপ্তরেরই কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কয়েকজন দালাল।
তথ্য নিয়ে জানা গেছে সেই অনিয়ম, দুর্নীতি আর স্বেচ্ছারিতার চিত্র। তবে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক আতিকুল মামুন বলেছেন গুদামের চাবি সংরক্ষণ করেন ওই দপ্তরের (জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন) বড় বাবু।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ১৪ আগস্টের আগে ভোজ্যতেল (বোতলজাত সয়াবিন) এবং কিছু কিছু প্যাকেট থেকে চিনি সরিয়ে ফেলা হয়। সাবেক পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসাবে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে বিতরণের জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেনা হয় ৮ ধরনের প্রয়োজনীয় পণ্য। এর মধ্যে এসিআই ফুড লিমিডেট ২০২২ সালের ১৭ জুলাই পণ্যগুলো প্যাকেট (চটের মিনি বস্তা) ভর্তি করে খুলনা থেকে সরবরাহ করে। প্রতিটি বস্তায় ছিল ১০কেজি মিনিকেট চাল (৫ কেজি করে দুই প্যাকেট), দেশি মসুর ডাল এক কেজি, আয়োডিনযুক্ত লবণ এক কেজি, চিনি এক কেজি, ভোজ্যতেল এক কেজি, মরিচের গুঁড়া (১০০ গ্রাম) হলুদ (২০০ গ্রাম) ধনিয়ার গুড়া (১০০ গ্রাম)।
পণ্যগুলো বিতরণের কাজ দুই অর্থবছরেও (২০২২-২০২৩ ও ২০২৩-২০২৪) শেষ করা হয়নি। উলটো গুদাম থেকে বিভিন্ন সময়ে পণ্যগুলো গোপনে সরিয়ে ফেলা হয়। ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে সেই সিন্ডিকেট। গোপনে তারা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপহার সামগ্রীর বস্তা ভর্তি করে সরিয়ে ফেলে।
এদিকে গত ৭ সেপ্টেম্বর শনিবার সকালে কোটচাঁদপুর উপজেলার জন্য বরাদ্দ করা ৩০ বান্ডিল ঢেউটিন গুদাম থেকে বের করার সময় বেরিয়ে আসে অনিয়ম-লুটপাটের ভয়াবহ চিত্র। নতুন করে শুরু হয় তোলপাড়। সূত্র মতে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের ঝিনাইদহের ৬টি উপজেলার জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িঘর মেরামত/পুনঃনির্মাণের লক্ষ্যে মানবিক সহয়তা হিসাবে তিন‘শ বান্ডিল ঢেউটিন এবং বান্ডিলপ্রতি তিন হাজার টাকা করে মঞ্জুরি দেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। কিন্তু ওই টিন বিতরণ করা হয়নি।
ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরে খাতাকলম ঠিক করে অর্থবছর ২০২৪-২০২৫ এর ৭ সেপ্টেম্বর বিতরণ দেখানো হয়। খবর পেয়ে এই প্রতিবেদক ঝিনাইদহ ডিসি অফিস সংলগ্ন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের গুদামে উপস্থিত হলে হইচই পড়ে যায়।
দেখা যায়, গুদামের ভেতর থেকে বান্ডিল বান্ডিল ঢেউটিন বের করা হচ্ছে। সেখানে উপস্থিত রয়েছেন দপ্তরের (জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তর) বড় বাবু খ্যাত জল্পনা রানী সরকার ও অফিস সহায়ক রবিউল এবং কোটচাঁদপুর পিআইও দপ্তরের অফিস সহায়ক রবিউল ইসলাম। কয়েকজন শ্রমিক দিয়ে টিন তোলা হচ্ছে সামনে রাখা রিকশা ভ্যানে। সেসময় গুদামের ভেতরে রাখা শত শত বস্তা পণ্য সামগ্রী গেল কোথায়? এমন প্রশ্নে বড় বাবু (জল্পনা রানী সরকার) নানা অজুহাত দেখান। এক পর্যায়ে তিনি জানান, বন্যার্দুগতদের মাঝে সেগুলো বিতরণ করা হয়েছে। অথচ ঝিনাইদহে কোথাও বন্যা বা দুর্যোগের ঘটনা ঘটেনি।
অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে বর্তমান জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) বনি আমিন বলেন, বন্ধের দিনে ত্রাণের গুদাম খোলা যাবে না এমন কোনো বিধান নেই। ঝিনাইদহ জেলার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক (অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক) আতিকুল মামুন জানান পণ্য ও টিন বিতরণের কার্যক্রম শনিবার বিকাল থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ঝিনাইদহ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরে ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ডিআরও পদে (জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা) কোনো কর্মকর্তা নেই। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনারকে ভারপ্রাপ্ত হিসাবে দপ্তর পরিচালনা করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, বড় বাবু জল্পনা রানীর অফিস সহকারী জাকিয়া সুলতানা (কুষ্টিয়া জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রী) ইচ্ছাতেই পরিচালিত হয় এই দপ্তর। এই দপ্তরের ত্রাণের মাল পাইয়ে দেয়ার জন্য বশে কয়েকজন দালালের আনাগোনো আছে বলেও অভিযোগ করা হয়।
Leave a Reply