অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : সাম্প্রতিক সময়ে যেসব ফিলিস্তিনি বন্দি ইসরাইলি কারাগারগুলো থেকে মুক্তি পাচ্ছেন তাদের শারীরিক অবস্থা এতটা শোচনীয় যে, এসব বন্দির সঙ্গে ইহুদিবাদীদের আচরণ নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সম্প্রতি এক বিবৃতিতে ইসরাইলি কারাগারগুলোতে ফিলিস্তিনি বন্দি নির্যাতনের খবর দিয়ে বলেছে, এসব বন্দির ওপর এত বেশি নির্যাতন চালানো হচ্ছে যে, তারা প্রতি মুহূর্তে জীবন্মৃত্যুর সম্মুখীন। পার্সটুডে ফার্সি জানাচ্ছে, ইসরাইলি কারাগারগুলোতে বন্দিদের আটক রাখার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনগুলো ভয়ঙ্করভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এরকম একটি ভয়ঙ্কর কারাগার হচ্ছে নেগেভ মরুভূমিতে অবস্থিত একটি সেনা ঘাঁটিতে অবস্থিত সেডি টিমান (sedi timan) কারাগার। কারাগারটিতে ফিলিস্তিনি বন্দিদের ওপর যে পাশবিক নির্যাতন চালানো হয় তা এর আগে কেবল গুয়ান্টানামো বের বন্দিশিবিরেই চালানো হতো। এ সম্পর্কে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে:
ইসরাইলি কারাগার ও বন্দিশিবিরগুলো আমেরিকার নিয়ন্ত্রণাধীন গুয়ান্টানামো বে’র বন্দিশিবিরের চেয়েও রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে। এখানে পাশবিক অত্যাচার, অসভ্য ব্যবহার, অপমান ও লাঞ্ছনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেডি টিমান কারাগারের ভেতরে চালানো যেসব নির্যাতনের খবর এর চার দেয়াল পেরিয়ে বাইরে আসতে পেরেছে সেসবের মধ্যে রয়েছে, পেটাতে পেটাতে মেরে ফেলা, অকথ্য নির্যাতন, খাঁচায় বন্দি করে রাখা, হাত বেঁধে ফেলে রাখা এবং কয়েকদিন খেতে না দিয়ে প্রচণ্ড অভুক্ত অবস্থায় বন্দিদেরকে খরকুটো খেতে দেয়া। তবে নির্যাতনের যে চিত্রগুলো বন্দিশিবিরের চার দেয়াল থেকে বের হতে পারেটা সেগুলো আরো অনেক বেশি ভয়ঙ্কর।
দৈনিক আল-আরাবি আল-জাদিদ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই কারাগারসহ ইসরাইলের অন্যান্য বন্দিশিবির থেকে মুক্তি পাওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরও ভয়াবহ নির্যাতনের ক্ষত নিয়ে ফিলিস্তিনি বন্দিরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে এতটা ভেঙে পড়েছেন যে, কবে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন তা হলফ করে বলা যাচ্ছে না।
ইহুদিবাদী ইসরাইল এসব নির্যাতনে খবর প্রকাশের সব পথ আটকে রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিদের জবানবন্দি এবং নেগেভ মরুভূমির সেডি টিমান কারাগারে নির্যাতনে আহত ফিলিস্তিনি বন্দিদের চিকিৎসা সেবা দেয়া একজন ইসরাইলি ডাক্তারের বয়ান থেকে এসব নির্যাতনের খবর প্রকাশ পেয়েছে। তেল আবিব থেকে প্রকাশিত হারেতজ পত্রিকা ওই ডাক্তাদের জবানবন্দি প্রকাশ করেছে।
সম্প্রতি আলজাযিরা টেলিভিশনে ফিলিস্তিনি বক্সার মোয়াজ্জাজ আবিয়াতের একটি ভিডিও প্রকাশ পেয়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে, ইসরাইলি কারাগারে মেরে মেরে তার হাত-পা ভেঙে দেয়া হয়েছে। তার হাত দু’টি বেঁকে আছে এবং তিনি ঠিকমতো হাঁটতে পারছেন না। ইসরাইলি কারাগার থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত আবিয়াত তার ওপর চালানো নির্যাতন সম্পর্কে বলেন: “নেগেভ কারাগারে আমার ভাইরা প্রতিদিন শহীদ হয়ে যাচ্ছেন। ইসরাইলি কারারক্ষীরা সেখানে তিন হাজার বন্দির ওপর প্রতিদিন পাশবিক অত্যাচার চালায়। খাবার দেয় না। গোসল করার তো প্রশ্নই আসে না। সেখানে আমাদের সঙ্গে এমন আচরণ করা হয় যা মুখে বলা সম্ভব নয়। এক কথায় অবিশ্বাস্য ও অকথ্য নির্যাতন।”
এই ভিডিওর প্রতিক্রিয়ায় দৈনিক আল-খাবার আল-জাযায়ের লিখেছে: গোটা বিশ্ব গাজা উপত্যকার ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ফিলিস্তিনি বন্দিদের সঙ্গে ইহুদিবাদীদের পাশবিক অত্যাচারের ব্যাপারে কপট নীরবতা অবলম্বন করছে। প্রতিদিনই ইসরাইলি কারাগারগুলোতে ফিলিস্তিনি বন্দিদের ওপর নতুন নতুন নির্যাতনে খবর প্রকাশি হচ্ছে। এমনিক বিবিসি আরবি পর্যন্ত মুয়াজ্জাজ আবিয়াতের করুন দশার ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হয়েছে। এটি বলেছে, আবিয়াতের অবস্থা দেখে ইসরাইলি কারাগারগুলোর পরিস্থিতি সম্পর্কে ভয়ঙ্কর সব প্রশ্ন সামনে এসেছে।
আলজাযিরা টেলিভিশন আরেকজন ফিলিস্তিনি বন্দির উদ্ধৃতি দিয়ে এক বিশ্লেষণে জানিয়েছে, ইসরাইলি কারাগারে বন্দি নির্যাতনের সঙ্গে কেবর আমেরিকার গুয়ান্টানামো বন্দিশিবিরের কয়েদিদের ওপর নির্যাতনের তুলনা চলে। এতে আরো বলা হয়েছে, যারা ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাদের হাতে বন্দি হয়েছিলেন কেবল তারাই ইহুদিবাদীদের হাতে আটক ফিলিস্তিনি বন্দিদের কষ্ট উপলব্ধি করবেন।
মুয়াজ্জাম বেগ নামক একজন মানবাধিকার কর্মীকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই তিন বছর গুয়ান্টানামো কারাগারে আটকে রেখেছিল আমেরিকা। তিনি এক সাক্ষাৎকারে গুয়ান্টানামোর নির্যাতনের সঙ্গে ইসরাইলি কারাগারগুলোর নির্যাতনের সাদৃশ্য বর্ণনা করেছেন। মুয়াজ্জাম বলেন: ইসরাইলি কারাগারে বন্দিদের নগ্ন করাসহ অন্যান্য যেসব নির্যাতনের কথা শোনা যায় তার সঙ্গে গুয়ান্টানামোর অদ্ভুত মিল রয়েছে।
লুয়ি আল-তাওয়িল নামক একজন ফিলিস্তিনি বন্দি বেশ কয়েক বছর ইসরাইলি কারাগারে আটক থাকার পর সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছেন। তিনি ইহুদিবাদীদের বন্দিশিবিরগুলোর নির্যাতন সম্পর্কে বলেন: ইসরাইলি কারাগারগুলোতে কুখ্যাত আবু গারিব ও গুয়ান্টানামো বের বন্দিশিবিরের মতো নির্যাতন চালানো হয়। আমাকে অন্য একটি কারাগার থেকে নির্যাতন চালানোর জন্য নেগেভ কারাগারে আনা হয়। সেখানকার ফিলিস্তিনি বন্দিদের নগ্ন করে প্রচণ্ড গালিগালাজ করা হয় এবং অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইহুদিবাদী ইসরাইল তার কারাগারগুলোর পরিস্থিতি গোপন রাখার শত চেষ্টা করেও নির্যাতনের বিষয়টি গোপন রাখতে পারেনি। এখন সময় এসেছে সেইসব আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কিছু করার যারা সারাক্ষণ মানবাধিকারের বুলি আউড়িয়ে বেড়ায়।
Leave a Reply