অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : নানা সমস্যায় জর্জরিত টাঙ্গাইল ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল। হাসপাতালটিতে বেডের চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় সেবা নিতে আসা রোগীরা যেমন দুর্ভোগে পড়ছেন তেমনি চিকিৎসকেরা সেবা দিতে হিমশিমে খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষের।
নোংরা আর দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে দালালদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এছাড়াও শয্যা ও চিকিৎসক সংকটসহ নানা সমস্যা রয়েছে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে। ইনডোর, আউটডোর ও ইমারজেন্সিতে সেবা নিতে আসা রোগীরা তাদের কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইল জেনারেল হাসাপাতালে অনুমোদিত জনবলের প্রশাসনিক ও পরিসংখ্যান কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন খাতে কর্মচারীর পদ রয়েছে ৪০১টি। এর মধ্যে চিকিৎসকসহ ৭২টি পদ শূন্য। হাসপাতালে ৫৮ জন চিকিৎসক পদের মধ্যে ১৮টি পদ শূন্য। সিনিয়র কলসালটেন্ট (মেডিসিন) ও সিনিয়র কলসালটেন্ট (সার্জারি) দুইটি পদই শূন্য, সিনিয়ন কলসালটেন্ট (স্কিন ভিডি) পদও শূন্য, সিনিয়র নার্সের ৬টি পদই শূন্য, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর ৭২টি পদের বিপরিতে শুন্য রয়েছে ৩৫টি পদ। এ প্রতিষ্ঠানে ৭৭জন আউটসোর্সিং জনবলের মধ্যে লোক নিয়োগ করেছে মাত্র ৪৮ জন, ১৬ জন সুইপার পদের বিপরিতে ৯টি পদ শূন্য। এত স্বল্প সংখ্যক আয়া, সুইপার ও পরিচ্ছন্নকর্মীর কারনে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্য দিকে ডায়াবেটিক রোগীর তিন মাসে সার্বিক অবস্থা জানার একমাত্র এইচবিএওয়ানসি মেশিনটিও অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
ফলে ডায়াবেটিক রোগীদের পরিপূর্ণ চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না। হাসপাতালটির মোাট ২৫০টি বেডের বিপরিতে বর্তমানে মোট রোগী ভর্তি থাকে ৪৪০ থেকে ৪৮০ জন। জনবল সংকটের কারনে মূলত হাসপাতালটি পরিচালনায় নানা জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতালের পুরুষ, নারী, শিশু, ডায়রিয়া এবং গাইনিসহ সবগুলো ওয়ার্ডেই বেডের সংকট প্রকট। সেই সঙ্গে পরিবেশও নোংরা। হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের ভেতরে ও বারান্দার মেঝেতে গাদাগাদি করে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে রোগীদের। হাসপাতাল চত্ত্বর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়েও উদাসীন কর্তৃপক্ষ। রোগী ও স্বজনের অতি প্রয়োজনীয় বাথরুমের অবস্থাও বেহাল। অন্য দিকে হাসপাতালটিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থ খুবই দুর্বল হওয়ায় প্রায়ই সেখানে টাকা-পয়সা ও মোবাইল চুরির ঘটনা ঘটছে। বেশ কয়েকজন রোগী অভিযোগ করেন, হাসপাতালের ডাক্তার প্রেসক্রিপশনে ৫টি ওষুধ দিলে ১টি ওষুধ পাওয়া যায়। বাকী ওষুধ বাহিরে থেকে তাদের কিনে আনতে হয়। হাসপাতাল ওষুধ থাকলেও প্রায় সময় রোগীদের ওষুধ দেওয়া হয় না। ডিজিটাল এক্সরে মেশিনসহ ল্যাবে আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকায় কাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা।
চিকিৎসক রোগীকে কোন রোগের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে লিখে দিলেই চেপে ধরেন বেসরকারি হাসপতাল ও ক্লিনিকের দালালরা। কোন কোন দালাল আবার গ্রাম থেকে আসা নিরক্ষর মানুষজনকে ভুলভাল বুঝিয়ে হাসপাতালের ভেতর পর্যন্ত আসতেই দেন না। বাইরে থেকেই রোগীদের নিয়ে যান বিভিন্ন ক্লিনিকে।
হাসপাতালটিতে দালাল ও অ্যাম্বুলেন্স চালকদের দৌরাত্ম চোখে পড়ার মতো। হাসাপাতালের তিনটি অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে একটি অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে।
হাসপাতলের মহিলা ওয়ার্ডে ডায়াবেটিক রোগের চিকিৎসা নিতে ভর্তি হয়েছেন আছমা বেগম (৫০)। বেড না পেয়ে তার জায়গা হয়েছে হসপাতালের মেঝেতে। স্বামী বাদশা মিয়া জানান, ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রন না থাকার কারনে তার স্ত্রী অসুস্থ হওয়ায় জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। দুইদিন কেটে গেলেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা না পেয়ে চলে যাচ্ছেন তারা।
হাসপাতালে পুরুষ ওয়ার্ডের ভর্তি গনি মিয়া (৬০)। সাথে থাকা তার নাতি রানা মিয়া জানান, বেড না পাওয়ায় মেঝেতে রোগী রাখতে বাধ্য হয়েছি। বারান্দা ও মেঝের চারপাশে ময়লা আর দুর্গন্ধে টিকে থাকা মুশকিল। এ সময় পুরুষ ওয়ার্ডের রোগী ও তাদের স্বজনরা জানান, হাসপাতালের বারান্দা ও মেঝের চারপাশে ময়লা আর দুর্গন্ধ, টিকে থাকা মুশকিল।
গোপালপুরের সোহেল রানা মুমুর্ষ বাবাকে নিয়ে আসলে জরুরী বিভাগের ডাক্তার আইসিইউতে ভর্তি করান। কিন্ত প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল না থাকার কারনে বাবাকে আইসিইউ ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি। হতাশা নিয়েই চলে যেতে হচ্ছে রোগীর। তিনি জানান, সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ আছে কিন্ত দক্ষ জনবল না থাকার কারনে সেটা পরিচালনা করা যাচ্ছে না এটা খুবই দুঃখজনক বিষয়। রোগীর সেবার নামে এটা একধরনে প্রতারনার শামিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, কিছু সিনিয়র চিকিৎসকের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কারণে এখানে অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। হাসপাতালের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহারে জনবল নেই। এ কারনে বিভিন্ন পরিক্ষা নিরিক্ষাও ঠিকমত হচ্ছেনা। জনবলের অভাব হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ সচল যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অভাবে পড়ে আছে। বাধ্য হয়ে অধিকাংশ রোগী বাইরের বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে বিভিন্ন রোগের পরীক্ষা করছেন। আর এ ক্ষেত্রেও ওই সিন্ডিকেটের ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া হাসপাতালের ১জন রেডিওলজিস্ট দিয়ে কোনভাবে এত পরিমান রোগীর সেবা প্রদান করা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
হাসপাতালের নার্সিং সেবা তত্ত্বাধায়ক (ভারপ্রাপ্ত) পদ্মা সাহা জানান, হাসপাতালে প্রতিদিন এই বিপুল সংখ্যক রোগী সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। ২৫০ শয্যা রোগীর সেবা দিতে গিয়ে ৪০০-৫০০ রোগীর সেবা দিতে হয় আমাদের। কাঙ্খিত সেবা না পওয়ায় রোগীরা আমাদের ওপর ক্ষিপ্ত হন। অন্য দিকে নার্সদের বসার কোন নির্দিষ্ট রুম নেই।
হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. আগমগীর হোসেন বাসস কে জানান, হাসপাতালে পুরাতন এক্সরে মিশিন, এমআরআই, ফিজিও থেরাপি ও আল্টাস্নোগ্রাম মেশিন দিয়ে আধুনিক বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব না। এ গুলো কে ডিজিটার যন্ত্রপাতিতে রুপান্তর করা না গেলে আধুনিক বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের। জনবল সংকটের কথা স্বীকার করে তিনি জানান, পর্যাপ্ত জনবল ও লজিস্টিক সরবারাহ পেলে আমরা কাঙ্খিত সেবা দিয়ে পারবো। ডাক্তার, সবকিউরিটি, পর্যাপ্ত নার্স, সাপোর্টিং স্টাফ না থাকায় পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা দেয়া যাচ্ছে না। তিনি জানান, আয়া ও ওয়ার্ড বয় না থাকায় কি যে কষ্ট তা বুঝানো সম্ভব নয়। বিকেল এর পর পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের দেখা মিলে না। এ দিকে হাসপাতালে আউটডোরে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত মাত্র ৪জন মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট দিয়ে প্রায় ১৮০০ থেকে ২০০০ হাজার রোগীর পর্যাপ্ত সেবা দেওয়া কোনভা্েব সম্ভব নয়। এ সব বিষয়ে কর্তৃপক্ষের বিশেষ নজর দেয়া দরকার।
হাসপাতালের উপ-পরিচালত ডা. খন্দকার সাদেকুর রহমান বাসস কে জানান, টাঙ্গাইল সদর হাসপাতালটি ১৯৭৪ সালে ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে রুপান্তরিত হয়। এর পর থেকে হাসপাতালটি নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। বর্তমানে চিকিৎসকের ১৮ পদ শূন্য থাকার কারনে প্রতিদিন প্রায় ৫ শতাধিক রোগীর চিকিৎসা সেবা কি ভাবে দেওয়া সম্ভব, অন্য দিকে সিনিয়র কলসালটেন্ট (স্কিন ভিডি) ডাক্তার না থাকায় ও ডায়াবেটিক রোগীর তিন মাসে সার্বিক অবস্থা পরিমাপের একমাত্র এইচবিএওয়ানসি মেশিনটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় থাকার কারনে হাসাপাতালে শতশত ডায়াবেটিক রোগী চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এ দিকে এ হাসপাতালে ১০ বেডের আইসিইউ চালু থাকলেও আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় ডাক্তার এবং দক্ষ জনবল না থাকার কারনে রোগীদের সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও আরও একটি ১০ বেডের আইসিইউ প্রস্তুুত করা হয়েছে। সময় মতো সেটি চালু না করা গেলে মূল্যবান মেশিনগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। হাসপাতালে গড়ে উঠেছে দালালদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সমন্বয়ে মাঝে মাঝেই অভিযান চালানো হয়। তবে দালাল ও মেডিকেল রিপ্রেজেন্টিটিভদের পুরোপুরি দমন করা সম্ভব হচ্ছে না । এ ব্যাপারে উদ্ধর্তন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন তিনি।
Leave a Reply