অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে গণপিটুনি দিয়ে মানুষ হত্যা এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস ২০২৫ উপলক্ষে দেওয়া বিবৃতিতে সংগঠনটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে মানবাধিকারকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
সংগঠনটি বলছে, এ বছরের মানবাধিকার দিবস এমন সময়ে পালিত হচ্ছে, যখন বাংলাদেশে ছাত্র–জনতা একটি রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন ঘটিয়েছে এবং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। এই অভ্যুত্থান জনগণের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক অঙ্গনে অনৈক্য দেখা যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেছে অধিকার। সংগঠনটির মতে, রাজনৈতিক সহিংসতা অব্যাহত থাকায় নির্বাচন প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ইতোমধ্যে বহু প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।
অনলাইনে নারীদের ওপর হয়রানি এবং বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা অব্যাহত আছে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আশানুরূপ উন্নতি করতে না পারায় নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বহাল রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে গণপিটুনির ঘটনা এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
অধিকার মনে করে, বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অপরিহার্য। তাই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।
গত ৩০ অক্টোবর প্রকাশিত প্রতিবেদনে ‘অধিকার’ জানায়, জুলাই অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের ১৪ মাসে ৪০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ৯টি ঘটনা ঘটেছে গত বছরের সেপ্টেম্বরে। আর ২০২৫ সালের শেষ তিন মাসে ঘটেছে ১১টি।
২০২৪ সালের ৯ আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৪ মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ধরন অনুযায়ী—নির্যাতনে মৃত্যু ১৪ জন, গুলিতে নিহত ১৯ জন এবং পিটিয়ে হত্যা ৭ জন।
২০২৫ সালের জুলাই–সেপ্টেম্বর তিন মাসে ১১টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ পাওয়া গেছে—এর মধ্যে তিনজন পুলিশের হাতে, একজন সেনাবাহিনীর হাতে এবং সাতজন যৌথবাহিনীর হাতে নিহত। নিহতদের মধ্যে তিনজন নির্যাতনে, ছয়জন গুলিতে এবং দুজন পিটিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
গত বছরের আগস্টে (৯–৩১ আগস্ট) কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড না ঘটলেও, সেপ্টেম্বরে ৯টি, অক্টোবর–ডিসেম্বরে প্রতিমাসে একটি করে, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ৫টি, ফেব্রুয়ারিতে ৩টি, মার্চ–এপ্রিলে প্রতিমাসে ২টি, মে মাসে ৪টি, জুনে ৩টি, জুলাইয়ে ৬টি, আগস্টে ৩টি এবং সেপ্টেম্বরে ২টি ঘটনা রেকর্ড করা হয়।
অধিকারের হিসাব অনুযায়ী, গত ১৪ মাসে সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা হয়েছে ২৪২টি। এর মধ্যে আহত ১২৯ জন, নিহত ১ জন, লাঞ্ছিত ৪৩ জন, আক্রমণ ৫, হুমকি ৩১ এবং মামলা হয়েছে ৩৩ জনের বিরুদ্ধে। মাত্র জুলাই–সেপ্টেম্বর তিন মাসে নিহত ১ জন, আহত ৩৪, লাঞ্ছিত ১১, হুমকি ৯ এবং মামলা হয়েছে ২০ জনের বিরুদ্ধে।
এ সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে ৭ হাজার ৯৭৯টি—নিহত ২৮১ এবং আহত ৭ হাজার ৬৯৮ জন। ২০২৫ সালের জুলাই–সেপ্টেম্বরে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ৪৬ জন এবং আহত ১ হাজার ৫৩৭ জন। একই সময়ে বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংঘাত ৮২টি, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাত ১টি—যেখানে বিএনপির সংঘাতে নিহত ৮ জন এবং আহত ৭৪০ জন; আওয়ামী লীগের সংঘাতে আহত ১২ জন।
১৪ মাসে ১৫৩ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে ১৮টি; আগের বছরের সেপ্টেম্বরে ১৭টি। শুধু জুলাই–সেপ্টেম্বর তিন মাসেই গণপিটুনির ঘটনা ৪৫টি।
তিন মাসে নারী–শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৮৮ জন—নারী ৭৭ জন এবং শিশু ১১১ জন। ৭৭ জন নারীর মধ্যে ১৮ জন গণধর্ষণের শিকার এবং ২ জন ধর্ষণের পর নিহত। ১১১ কন্যাশিশুর মধ্যে ১৩ জন গণধর্ষণের শিকার এবং ৬ জন ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।
জুলাই–সেপ্টেম্বরে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ৮ জন নারী–শিশু। এই সহিংসতার প্রতিবাদ করতে গিয়ে আহত ২ জন পুরুষ এবং নিহত ৩ জন নারী।
তিন মাসে যৌতুক–সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১২ নারী—যার মধ্যে হত্যা ৬ জন, নির্যাতন ৫ জন এবং আত্মহত্যা ১ জন।
এক বছরে সীমান্তে বিএসএফের হাতে নিহত ৩৫ জন, আহত ৩৪ এবং পুশ ইন ২ হাজার ৩৩৩ জন। জুলাই–সেপ্টেম্বরে নিহত ১০ জন—৭ জনকে গুলি করে এবং ৩ জনকে নির্যাতনে হত্যা করা হয়; আহত ১৪ জন।
এ সময়ে জোর করে বাংলাদেশে পুশ ইন করা হয়েছে ৫৪৪ জনকে—নারী, শিশু এবং বৃদ্ধসহ।