সময়ের সমষ্টিই জীবন। ঈসায়ী ক্যালেন্ডারে ২০২২ সাল শেষ হয়েছে। নতুন বছর আসা মানে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হওয়া। নতুন বছর আসা মানে জীবনের নির্ধারিত আয়ু থেকে একটি বছর চলে যাওয়া। বিগত সময়ের ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন উদ্যমে নতুনের কেতন ওড়ানোর আনন্দ উপভোগ করা। অকল্যাণের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে অবারিত কল্যাণের পথে ধাবিত হওয়ার শুভযাত্রা শুরু করা। নতুন মাস দিয়ে শুরু হয় নতুন বছর। সময়ের সঙ্গে অমঙ্গল কিংবা অকল্যাণের কোনো সংযোগ নেই; ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। কল্যাণ-অকল্যাণ ও মঙ্গল-অমঙ্গল মানুষের কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেহেতু নববর্ষ হলো সময়ের একটি অংশ থেকে অন্য অংশে পদার্পণ, তাই এটিও নিজেকে পরিবর্তন ও উন্নয়নের একটি সুযোগ। সুতরাং এ সময়ে আমাদের যা করা উচিত তা হলো জীবনকে নবায়ন করা। নববর্ষ হলো সময়ের একটি অংশ পার হয়ে অন্য অংশে গমন করা। একটি নতুন বর্ষের সূচনা শুধু আগমন নয়, বিদায়ও। জীবনের সময়-সম্পদ থেকে একটি পূর্ণ বছর ব্যয় হয়ে গেল। তাই নতুন বছরের আগমন বিদায়েরই বার্তাবাহক। আমরা যেমন বিস্মৃত হই, তেমনি নতুন নতুন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হই। পক্ষান্তরে সময়-সম্পদে শুধু বিয়োগ, কোনো যোগ নেই। আমাদের জীবন থেকে দিন-রাত, সপ্তাহ, মাস ও বছর শুধু বিয়োগই হচ্ছে, যোগ হচ্ছে না। নতুন বছরের ধারণা চেতনা দেশ সমাজ অর্থনীতি ভেদে আর্থসামাজিক পরিবেশ ও ভূগোল ভেদে, অবকাঠামো অবয়ব ভেদে, একেক ধরনের আবেগ উৎকণ্ঠা আনন্দ উৎসব উপলক্ষের উচ্ছ্বাসে রণনতুলেই আসে।
এই শীতে বিশেষ করে যখন খ্রিস্টীয় নববর্ষ আসে তখন পালাপার্বণ পৌষের পিঠাপুলি খাবার ধুম, বেড়াবার বহর সবই এবার আসল করোনার পর তার আরেক ভ্যারিয়েন্ট আসার অজানা আশঙ্কায়, জেলেনস্কি-পুতিনের পাতানো যুদ্ধের দামামায়। এ যেন অবরুদ্ধ সময়ের সাম্পানে নিরুদ্দেশের পানে পাল তুলে যাত্রা করা। প্রকৃতির সৌন্দর্য প্রদর্শনের মোক্ষম মুহূর্তগুলো নানান বাধার বাঁধনে আটকে যাচ্ছে। একশ বছর আগে, স্প্যানিশ ফ্লু মহামারীর সময়, ১৯২০ সালের শুরুটাও যেমন প্রথম বিশ^সমরের অশুভ চলাচলে বিশ্ববাসীকে নিরামিষ নিরানন্দময় করে তুলেছিল, একশ বছর পরের করোনাক্লিষ্ট এই পৃথিবীতে এখানে সেখানে এবারের নববর্ষ তেমনি এক যূথবদ্ধ দুর্ভাবনার দোসর হয়ে বিশেষ বিব্রতকর অবস্থায় হাজির।
বিগত বছরের অর্থনীতি আগামী বছরের দিনমানের হিসাব-কিতাব বেহিসাবের খাতায় অলস অস্থির কর্মহীনের হীনমন্যতায় মূক বধির হয়ে উঠছে। সব দিনই সমান সব রাত সমান কিন্তু কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণকে সময় গণনার সুবিধার্থে সেকেন্ড মিনিট ঘণ্টা দিন তারিখ মাস বছর বিচার ও হিসাবায়নের প্রথা চালু হয়েছে। সেই থেকে নিত্য প্রস্থানপরায়ণ কোনো দিনতারিখকে পুরাতন সাব্যস্ত করে পরের দিনকে নতুন তারিখ ধরে নিয়ে নতুনের নামাবলি পরিয়ে আনন্দ আমেজ আবেগ আবেশ তৈরির চল চালু হয়েছে। ডিসেম্বরের পরই জানুয়ারিতে প্রকৃত প্রস্তাবে গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকার পাতায় নতুন একটি সাল সংযুক্ত হয়ে চিন্তাচেতনার চৌহদ্দীতে নতুন যাত্রা শুরুর সুযোগ তৈরি হয়। পুরাতনের প্রতিস্থাপনেই নতুনের আগমন ঘটে, সবাই ভাবে পুরাতন গ্লানি, জরা, ব্যাধি ও ব্যত্যয়, দুঃখ ও বেদনা ঘুচে যাক, আসুক নতুনের কেতন ওড়ানো নববর্ষ, ঘটুক তার সৌন্দর্য-শোভিত শুভাগমন। শুধু মানুষ কেন প্রকৃতিও বোঝে। গাছে নতুন পাতা আসে পুরাতন পাতাকে বিদায় করতে। ভোল পাল্টানোর এই ব্যাপারটি না থাকলে প্রকৃতির সৌন্দর্য বিলাস, তার সাজবদলের আর কোনো উপলক্ষ থাকে না। নতুন সব সময়ই নতুন, নতুনের সমাদর সম্ভাষণে পুরাতনকে পাততাড়ি গুটিয়ে তাই চলে যেতে হয়। নতুনের এই শুভাগমন এই অনুপ্রবেশ নিঃশব্দ হয়ে সরবে, সময়ের অবসরে হয়েও নিয়মিত, অনিত্যতার মাঝে নিত্যতার নৈতিক নৃত্য, তাল ও লয় মিলিয়ে যেখানে সুর সাধন সাঙ্গীতিক পরিবেশ তৈরী করে।
দুই হাজার বাইশ কেমন কেটেছে? একজন দিনমজুরের, ছা-পোষা কেরানির, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীর, হাসপাতাল ও ক্লিনিক মালিকের, ব্যবহারজীবীর, কলম সৈনিকের, সংস্কৃতিসেবীর, বড় মজুদদার সিন্ডিকেটের, স্টক মার্কেটের অর্থ লোপাটকারীর, ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া ধুরন্ধর ব্যবসায়ীর, মুদ্রা পাচারকারীর? এসব কথা এমন এক সময় ভাবা হচ্ছে যখন চারদিকে কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে ভোরের দিকে এগুচ্ছে বাংলাদেশ আর এর সমাজ। কুয়াশার ধোঁয়াটে পরিস্থিতিতে সবার চোখের ভিজিবিলিটি যথেষ্ট অস্পষ্ট। এই হালকা পাতলা কুয়াশারাও যে এত শক্তিশালী এদেশের মানুষ এর আগে ঠাওর করতে পারেনি। এই কুয়াশা আকাশের বিমানকে মাটিতে নামতে দেয় না, লঞ্চ, স্টিমার এমনকি জাহাজকেও নদী সাগর মাঝে নোঙর করতে বাধ্য করে, সড়কপথে গাড়ির গতিমাত্রা নামিয়ে দেয়। সবাই লক্ষ করে ভোরে প্রাদোষকালে কুয়াশা যতটা দেখা যায় বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই কুয়াশা কেটে যাওয়ার পরিবর্তে তা যেন বেড়েই চলে।
ভোর দেখে দিনের অবস্থা ঠাওর করার যে মহাজন বাক্য শিখেছিল সবাই এখন তা যেন আর খাটছে না। যাদের জন্য, যাদের দিয়ে, যারাই সেই ভোরে যে সব স্বপ্নজাগানিয়া গান শুনিয়েছিল ভৈরবী রাগে তা যত বেলা বেড়েছে, পশ্চিমের আকাশে ঢলেছে সূর্য, সামনে অস্তাচলের পথে এসে তার বাস্তবায়নের ভিজিবিলিটি তত অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যেন। সহজ সরল বিশ্বাসে, আস্থায় বুক বাঁধে সবাই বারবার আর তা কেনজানি খান খান হয়ে যায় অতি চালাকিবাজদের ধড়িবাজদের ধান্দায়। বেশ কয়েক বছর ধরে সবাই শুনেছে ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে কোনো কোনো অতি চালাক চতুরেরা এবং এখন একে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে চালাকেরা আরও বোকা সাজার ভান করছে। যেন কিছুই হয়নি, কেউ কিছু করেনি এমন একটা ভাব-ভাবনা দিয়ে পার পেতে চাইছে। ইস্যুর পর ইস্যু তৈরি হয়ে আগেরটা বেমালুম ভুলে যাচ্ছে মানুষ। এর দোষ ওর দোষ যাই বলা হচ্ছে শেষমেষ গিয়ে যত দোষ তা তো নন্দ ঘোষের ঘাড়েই চাপছে।
অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে সবার সামনে এই একুশ বাইশেও, তবে সামান্য এ ক্ষতি নিয়ে এত হা-পিত্তেশ কেন অতি নিরাপদ ভাবেন যারা নিজেদের তারাই বলেছেন এন্তার। মানুষের আয় তত্ত্ব জিডিপির জাত্যাভিমান নিয়েও অনেক ব্যাখ্যান মিলেছে। জীবনমানের নৈমিত্তিকতায় তার উপস্থিতি না মিললেও বিদেশি সনদে পদকে প্রচার পেয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রমোশন পাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের রাশ টেনে ধরতে চেষ্টার কমতি ছিল না, কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। সরবরাহ ও চাহিদায় বল ব্যাটের মিল হয়েও হয়নি, সিন্ডিকেটের ছুড়ে দেয়া স্পিনিং বল বরাবরই রান আউট করে দিয়েছে ক্রেতাকে, নাকাল হতে হয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে।
করোনাযুদ্ধের আপাত অবসানের এই পর্যায়ে দেশে দেশে মানুষের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য বাড়াবার চেষ্টা চলছে। বেশ কয়েকমাস স্থবির হয়ে পড়ে থাকা ব্যক্তি পরিবার সমাজ ও অর্থনৈতিক জীবনযাত্রায় জীবন ও জীবিকা সমন্বয় সাধনের অনিবার্যতা উপস্থিত। কিন্তু পণ্য ও সেবা উৎপাদনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি চাহিদা অনুযায়ী না বাড়ায় সরবরাহে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বড় বৈসাদৃশ্য ও বেমানান বাড়াবাড়িতে সমাজ ও অর্থনীতির দৈন্য ও দুর্দশা ফুটে উঠেছে। সরবরাহ ও চাহিদার এই মহামহিম দূরত্বের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীরও দাম হু হু করে বাড়ে, চড়া আকাশচুম্বী দাম হাঁকা হয়ে থাকে। এই অবস্থায় সমাজে আর্থিক বৈষম্যের বিবর আরও বেদনাদায়কভাবে উন্মোচিত হয়। বাংলাদেশ অর্থনীতির চালচিত্র, এর আবহমান সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ করোনাকালে কিংবা করোনা-উত্তর পরিবেশে ভেদাভেদ ভুলে পুরনো দিনের বেদনা ও বৈষম্যের জঞ্জাল সরিয়ে নতুন বছরেও যেন গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা ও পরিতৃপ্তিকে উপভোগ করার চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয় পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধির, ধর্ষণ ও প্রতারণা, সামাজিক অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধির মতো নানান খাত ও ক্ষেত্রে অতি অস্বাভাবিক আচরণে।
প্রভূত পরিসংখ্যান, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও পটভূমিতে আজ এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে দূরত্ব বাড়ছে অনেক ক্ষেত্রে সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের ও নাগরিকের মধ্যে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে, শিল্পমালিক ও শ্রমিকের মধ্যে, নীতি নির্ধারকের সঙ্গে পোষণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে, উৎপাদনকারীর সঙ্গে খুচরা ক্রেতার, ব্যাংকের আমানতকারীদের সঙ্গে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার, সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় প্রত্যাশার সঙ্গে আর্থিক খরচে কর্মনৈপুণ্যের, ব্যয় সংকোচন কৃচ্ছ্ব সাধন পরিবেশেও বল্গাহীন ব্যয়ের, সদাচার, সামাজিক ন্যায়নীতিনির্ভরতার সঙ্গে অসদাচার ও নীতিহীনতার, সুশৃঙ্খলা বোধের সঙ্গে উচ্ছৃঙ্খলতার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের। সামষ্টিক অর্থনীতিতে চড়াসুদ ও কড়া শর্তের ঋণের টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে অপব্যয়ের জৌলুশের চাকচিক্যের ডামাডোলকে মনে হতেই পারে এটি পুঁজিবাদী মানসিকতায় প্রস্তুত এবং বৈষম্য বিলাসী উদাসীন ঊর্ধ্বতনদের ইচ্ছা ও অভিলাষ উৎসারিত।
অর্থনৈতিক বৈষম্য বিভাজন থেকে মুক্তির সংগ্রামে জয়ী যেখানে একটি স্বাধীন সার্বভৌম অর্থনীতির প্রাণবায়ু, সেখানে জবাবদিহি, স্বচ্ছতা ও ন্যায়নীতি নির্ভরতা, নৈতিক মনোবল ও মূল্যবোধ তার সার্বিক অবস্থান ও উপস্থিতিকে আপাত প্রাণচাঞ্চল্যে ফিরে আসার অজুহাত অবয়বে নিরুৎসাহিত করা চলে না। রাতের পর দিন আসে আলোর পর অন্ধকার, অন্ধকারের পর আলো। আজ যে দিনকে মনে হবে অচলায়তনের অবয়বে সে দিনও একদিন চলে যাবে নতুন সম্ভাবনা ও সুযোগের সকালে উদিত হবে নতুন সূর্য নতুন বর্ষ। এই ভেঙ্গেচুরে খানখান হয়ে যাওয়া সব কিছু নতুন করে গোছাতে গিয়ে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে মানুষকে। আর তারই দেখানো পথে এগোতে হবে আগমনী নতুন কে নিয়ে। তাইতো বলতে হয়, রূপ রস ও গন্ধময়, পৃথিবী হতে বিদায় লয় পুরাতন বর্ষ শেষ হয়। পুরাতন বিদায় নেবে, নিতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। কবির ভাষায়- মুুকুলিত সব আশা, স্নেহ প্রেম-ভালোবাসা, জীবনে চির স্মৃতি হয়ে রয়, পুরাতন বর্ষ,বিদায় লয়, নববর্ষের আগমন হয়। পূর্বের গ্লানি, দুঃখ, ভুল-ভ্রান্তি মুছে নতুন করে শুরু করার নামই উদ্যম। আর উদ্যোমিদের জন্যই উজ্জ্বল আগামী। কে না চাইবে একটু ঝকঝকে, পরিষ্কার আগামীর সাক্ষী হতে?
লেখক : এম এ কবীর, সীমান্তবাণীর সিনিয়র সহকারী সম্পাদক, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি- ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি।
Leave a Reply