26 Nov 2024, 07:24 pm

তুরস্ক-সিরিয়া ভূমিকম্প ; দানের অর্থ যেভাবে হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকরা

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : তুরস্ক ও সিরিয়াতে হয়ে যাওয়া ভয়াবহ ভূমিকম্পকে ব্যবহার করে প্রতারকরা লোকজনের দেওয়া দানের অর্থ কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে বলে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন। এ ধরনের প্রতারণার ঘটনায় ভূমিকম্প থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন, যাদের কাছে বিদ্যুৎ পানি কিছুই নেই, তাদের জন্য অর্থ সংগ্রহের কথা বলা হচ্ছে।

এই ভূমিকম্পে এখনও পর্যন্ত ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে সংগৃহীত অর্থ তাদের কাছে পৌঁছে না দিয়ে, পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রতারকদের নিজেদের পেপাল ও ক্রিপ্টোকারেন্সি অ্যাকাউন্টে। এ ধরনের প্রতারণায় যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় তার কয়েকটি আমরা চিহ্নিত করেছি।

এছাড়াও আপনি কোথায় ও কাকে দান করছেন তা যাচাই করে দেখার কিছু প্রযুক্তি রয়েছে। দান করার আগে এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে আপনার দানের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেন। টিকটক লাইভে যারা কনটেন্ট তৈরি করছেন, তারা ‘ডিজিটাল গিফ্ট’ গ্রহণের মাধ্যমে অর্থ আয় করতে পারেন।

বর্তমানে টিকটক অ্যাপে ভূমিকম্পের নানা ধরনের কনটেন্ট পোস্ট করা হচ্ছে যার মধ্যে রয়েছে ধ্বংসযজ্ঞের ছবি, ভিডিও ফুটেজ, উদ্ধার তৎপরতার টিভি রেকর্ডিং ইত্যাদি। এসব দেখানোর সময় দুর্গতদের জন্য অর্থ দান করারও আহবান জানানো হচ্ছে।

এগুলোর ক্যাপশনে নানা ধরনের কথা লেখা আছে। যেমন ‘আসুন, তুরস্ককে সাহায্য করি’, ‘তুরস্কের জন্য প্রার্থনা’ এবং ‘ভূমিকম্পের দুর্গতদের জন্য সাহায্য করুন’ এরকম নানা স্লোগান। এ রকম একটি পোস্টের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে এই লাইভ হচ্ছিল, তাতে ওপর থেকে তোলা ভূমিকম্পে ধসে পড়া ভবনের ছবি দেখানো হচ্ছে, তার সঙ্গে যোগ করা হয়েছে বিস্ফোরণের কিছু সাউন্ড এফেক্ট।

কিন্তু ক্যামেরার পেছনে একটি পুরুষ কণ্ঠকে হাসতে ও চীনের ভাষায় কথা বলতে শোনা যাচ্ছে। এই ভিডিওটির ক্যাপশনে লেখা আছে: ‘আসুন, তুরস্ককে সাহায্য করি। দান করুন।’ আরেকটি ভিডিওতে একটি শিশুকে বিস্ফোরণ থেকে দৌড়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। ওই লাইভস্ট্রিমের বার্তায় বলা হচ্ছে: ‘এই লক্ষ্য অর্জনে অনুগ্রহ করে সাহায্য করুন।’

এই ক্যাপশনে উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার একটি শহরের কথা বলা হচ্ছে যেখানে তুর্কি বাহিনী ও তার মিত্ররা মিলে সে বছর একটি কুর্দি মিলিশিয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে। টিকটকে ‘গিফ্ট’ প্রেরণের ক্ষেত্রে আরো একটি বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। বিবিসির এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে এই অ্যাপের মাধ্যমে যতো ডিজিটাল গিফ্ট পাওয়া যায় তার ৭০% নিয়ে যায় টিকটক, যদিও টিকটক জানিয়েছে, তারা এর চেয়ে কম নেয়।

টিকটকের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছেন, ‘তুরস্ক ও সিরিয়াতে যে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে, তাতে আমরা গভীরভাবে দুঃখিত। সেখানে যে ধরনের ত্রাণ-তৎপরতা চলছে তাতেও আমরা সাহায্য করার চেষ্টা করছি। যারা সাহায্য করতে চাইছেন তাদেরকে প্রতারণা ও বিভ্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে আমরা সক্রিয়ভাবে কাজ করছি।’

টুইটারে লোকজন আবেগ ঘন ছবি শেয়ার করছে। এর পাশাপাশি ক্রিপ্টোকারেন্সি অ্যাকাউন্টেরও লিঙ্ক শেয়ার করে এর মাধ্যমে অর্থ সাহায্য দান করার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। একটি অ্যাকাউন্ট থেকে মাত্র ১২ ঘণ্টায় একই আবেদন আটবার পোস্ট করা হয়েছে।

এই পোস্টে একটি ছবি দেওয়া হয়েছে যাতে দেখা যাচ্ছে দমকল বাহিনীর একজন কর্মী ধসে পড়া কয়েকটি ভবনের সামনে ছোট্ট একটি শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন। এটি আসল কোনো ছবি নয়। ওয়েমা নামের একটি গ্রিক সংবাদপত্র জানিয়েছে, এজিয়ান দমকল বাহিনীর মেজর জেনারেল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মিডজার্নি সফটওয়্যার ব্যবহার করে এই ছবিটি তৈরি করেছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সাহায্যে ছবি তৈরির সময় প্রায়শই ভুল হয়ে থাকে। এক্ষেত্রেও টুইটার ব্যবহারকারীরা খুব দ্রুতই ধরে ফেলেন, এই ছবিটি আসল নয়। তারা দমকল বাহিনীর কর্মীর ডান হাতে ছয়টি ডিজিট দেখতে পান। এই ছবির সত্যতা যাচাই করার জন্য বিবিসির প্রযুক্তি গবেষণা বিভাগ ‘ব্লু রুম’ কে একই সফটওয়্যার ব্যবহার করে ঠিক একই ধরনের চিত্র তৈরি করতে বলা হয়।

এরপর সফটওয়্যারটিকে বলা হয় ‘দমকল বাহিনীর একজন কর্মী, যার মাথায় থাকবে গ্রিক পতাকা আঁকা হেলমেট, ভূমিকম্পের পর তিনি ছোট্ট একটি শিশুকে উদ্ধার করছেন’ এরকম একটি ছবি তৈরি করে দিতে।

এছাড়াও এসব পোস্টের সঙ্গে ক্রিপ্টোকারেন্সির যেসব ওয়ালেটের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে তার একটি ২০১৮ সালের প্রতারণামূলক টুইটেও ব্যবহার করা হয়েছিল। অন্য ঠিকানাগুলো পোস্ট করা হয়েছে রুশ সোশাল মিডিয়া ওয়েবসাইট ভিকে তে। সেখানে পর্নোগ্রাফি কনটেন্টও পোস্ট করা হয়েছে।

অর্থ সহায়তার আবেদন জানিয়ে যে ব্যক্তি টুইটারে এই আপিল পোস্ট করেছেন, বিবিসির পক্ষ থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তিনি জানিয়েছেন, এটি প্রতারণামূলক কোনো পোস্ট নয়। ‘গুগল ট্রান্সলেট’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা টুইটারে আমাদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন।

তারা বলেছেন, ‘আমি যদি কোনো অর্থ সংগ্রহ করতে পারি, তাহলে আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে ভূমিকম্পে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের সাহায্য করা। দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় লোকজন এখন প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে বসবাস করছে। বিশেষ করে শিশুদের জন্য কোনো খাবার নেই। আমি রসিদ দিয়ে এই প্রক্রিয়াকে প্রমাণ করতে পারবো।’

তবে তারা এখনও পর্যন্ত কোনো ধরনের রসিদ প্রেরণ করেনি এবং তাদের পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য কোনো প্রমাণও পাঠায় নি। প্রতারণাকারীরা অর্থ তোলার জন্য টুইটারে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলে এবং তাতে পেপ্যালের লিঙ্কও পোস্ট করা হয়।

সোনাটাইপের সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আক্স শর্মা বলছেন এসব অ্যাকাউন্ট থেকে সংবাদ প্রতিবেদনগুলো রিটুইট করা হয়। এছাড়াও এগুলো যাতে বেশি লোকজনের কাছে পৌঁছায় সেজন্য তারা জনপ্রিয় ব্যক্তি ও পরিচিত প্রতিষ্ঠানের টুইটেরও রিপ্লাই করে থাকে।

বিবিসিকে শর্মা বলেন, ত্রাণ সাহায্যের কথা বলে তারা ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরি করে যেগুলোকে বৈধ সংস্থা কিম্বা সংবাদ প্রতিষ্ঠানের মতো দেখায়। তারপর তারা সংগৃহীত অর্থ তাদের পেপ্যাল অ্যাকাউন্টে নিয়ে যায়।

এরকম একটি উদাহরণ @টার্কিরিলিফ। জানুয়ারি মাসে এই টুইটার অ্যাকাউন্টটি খোলা হয়েছে যার ফলোয়ারের সংখ্যা মাত্র ৩১। এখানে পেপ্যাল অ্যাকাউন্টে অর্থ সাহায্য দেওয়ার আহবান জানানো হয়েছে। এই পেপ্যাল অ্যাকাউন্টে এখনও পর্যন্ত দান হিসেবে ৯০০ মার্কিন ডলার জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৫০০ ডলার এসেছে এই পেজটি যিনি বানিয়েছেন তার কাছ থেকে।

শর্মা জানিয়েছেন, অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে তাদের উদ্যোগটি যে খাটি তা দেখানোর জন্য তারা নিজেরাই নিজেদের অ্যাকাউন্টে অর্থ পাঠিয়েছেন। ভূমিকম্পের পর দুর্গত লোকজনের জন্য অর্থ সাহায্য চেয়ে পেপ্যালে এরকম একশটিরও বেশি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ভুয়া অ্যাকাউন্টও রয়েছে।

শর্মা জানিয়েছেন, তুরস্কের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের জন্য যারা অর্থ দিতে চান তাদেরকে কিছু কিছু অ্যাকাউন্টের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। বিশেষ করে যেসব অ্যাকাউন্ট তুরস্কে বলে দাবি করা হচ্ছে সেগুলোর ব্যাপারে। কারণ পেপ্যাল ২০১৬ সাল থেকে তুরস্কে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে।

তিনি জানান, পেপ্যাল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে তুরস্কের বাইরে এরকম কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যেগুলো আসল। কিন্তু যখন তারা বলছেন যে তারা তুরস্কে আছেন, তখনই সাবধান হতে হবে। অজ্ঞাত উৎস থেকে আসা দান এবং যেসব আপিলে সামান্য পরিমাণে অর্থ সংগৃহীত হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে যে সত্যিকারের যেসব আপিল, সেগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অর্থ জমা হয়।

পেপ্যাল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে যারা অর্থ সংগ্রহ করছেন তাদের বেশিরভাগই এখনও পর্যন্ত ১০০ পাউন্ডের বেশি তুলতে পারেনি। পেপ্যাল প্রতারণামূলক অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে দিয়েছে। পেপ্যালের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে জানিয়েছেন, প্রচুর মানুষ আছেন যারা পেপ্যাল ব্যবহার করে দানের অর্থ গ্রহণ করছেন, তারা ভালো কাজের উদ্দেশ্যেই সেটা করছেন।

তবে কিছু অ্যাকাউন্ট আছে যেগুলো এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে থাকে। তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্পের পর অ্যাকাউন্টগুলোর ওপর নজর রাখা ও ভুয়া অ্যাকাউন্ট নিষিদ্ধ করার জন্য পেপ্যালের টিম নিরলসভাবে কাজ করছে, যাতে দানের অর্থ দুর্গত লোকজনের কাছে পৌঁছাতে পারে বলে জানান তিনি।

টুইটার @টার্কিরিলিফ এই অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে দিয়েছে, তবে তারা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। আপনার দেশে পরিচালিত দাতব্য উদ্যোগের খোঁজ নিন। কোনো উদ্যোগকে যদি আপনার প্রতারণামূলক বলে সন্দেহ হয়, তার ব্যাপারে আপনার দেশে অথবা সংশ্লিষ্ট সোশাল মিডিয়ার কাছে রিপোর্ট করুন।

আপনি যাতে দান করেন সেজন্য আবেগ-ঘন ভাষা, ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করা হয়। কোনো কোনো প্রতারক চক্র দাবি করে, তারা কোনো একটি দাতব্য সংস্থা বা সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আপনি যদি সেই চ্যারিটি কিম্বা সরকারি সংস্থায় দান করতে চান, তাদের ওয়েসবাইটে এসংক্রান্ত তথ্য খুঁজে দেখুন এবং সরাসরি সেখানে দান করুন।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 11021
  • Total Visits: 1319901
  • Total Visitors: 4
  • Total Countries: 1668

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ মঙ্গলবার, ২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
  • ১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)
  • ২৪শে জমাদিউল-আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরী
  • এখন সময়, সন্ধ্যা ৭:২৪

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
    123
252627282930 
       
15161718192021
293031    
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018